More

Social Media

Light
Dark

বিশ্বখ্যাত বিতর্কের বিশ্বকাপ

চার বছর ধরে ফুটবলার এবং সমর্থকরা আশায় থাকেন বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য। তবে রেফারির একটি বাজে সিদ্ধান্ত কিংবা ছোট্ট প্রতারণা ধূলিসাৎ করে দিতে পারে একটি গোটা জাতির স্বপ্ন। আসুন দেখে নেয়া যাক বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনাগুলো।

  • কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত

কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন ফিফার তখনকার প্রেসিডেন্ট স্বয়ং সেপ ব্ল্যাটারও। স্টেডিয়াম নির্মাণে শ্রমিকদের মৃত্যু, সমকামী আইন, নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সর্বোপরি ফুটবলীয় ঐতিহ্য কোনোদিক থেকেই বিশ্বকাপ আয়োজনের উপযুক্ত দেশ ছিল না কাতার।

তাছাড়া কাতারের কারণেই প্রথমবারের মত শীতকালীন মৌসুমে আয়োজিত হচ্ছে বিশ্বকাপ। যেসকল ফিফা কর্মকর্তা কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য রাজি ছিলেন তাঁদের বেশিরভাগই এখন দায়িত্বে নেই। ফলে ফিফা কর্মকর্তারা দায়সারাভাবে এবারের বিশ্বকাপ শেষে কলংকের এই অধ্যায় চাপা দিতে চান চিরতরে।

ads

  • ল্যাম্পার্ডের গোল বাতিল

২০১০ বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় জার্মানির বিপক্ষে ফ্রাংক ল্যাম্পার্ডের গোল বাতিলের ঘটনা ফিফাকে বাধ্য করেছে বিশ্বকাপে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে।

সেই ম্যাচে ২-১ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় দূরপাল্লার শটে অসাধারণ এক শটে গোল করেন ল্যাম্পার্ড। কিন্তু বল গোল লাইন ক্রস করেনি এই অজুহাতে রেফারি সেই গোল বাতিল করে দেন। জার্মানি সেই ম্যাচ জিতে নেয় ৪-১ গোলে। কিন্তু কে জানে হয়তো ল্যাম্পার্ডের সেই গোল বাতিল না হলে হয়তো ম্যাচ জিততে পারতো ইংল্যান্ডও।

সেই ম্যাচের পরই মূলত ফিফা নড়েচড়ে বসে। পরবর্তী বিশ্বকাপ থেকেই চালু করা হয় গোল লাইন টেকনোলজি।

  • ইংল্যান্ডের ভৌতিক গোল

বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই গোলের বিতর্ক আজও শেষ হয়নি। ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল পশ্চিম জার্মানি। সে ম্যাচে ১০২ মিনিট শেষে ২-২ সমতায় থাকা অবস্থায় ইংলিশ স্ট্রাইকার জিওফ হার্স্টের দুর্দান্ত এক শট বারে লেগে লাইনের উপর বাউন্স করে ফিরে আসে। কিন্তু রেফারি গডফ্রে ডিয়েন্সড গোলের বাঁশি বাজান এবং ইংল্যান্ড এগিয়ে যায় ৩-২ গোলে। পরবর্তীতে ম্যাচটাও জিতেছিল তাঁরা।

সেই সময়টাতে প্রযুক্তি তেমন উন্নত ছিল না। ফলে জানা যায়নি আসলেও গোল হয়েছিল কিনা। তবে পরবর্তীতে নানা ভিডিও দেখে সবাই একমত হয়েছিলেন বলের ৯৭% অংশ গোললাইন ক্রস করেছিল। অর্থাৎ সেটি আসলে গোল হয়নি। জার্মান সমর্থকরা আজও ক্ষমা করতে পারেননি রেফারি এবং লাইন্সম্যানকে।

  • শুমাখার-ব্যাটিস্তন সংঘর্ষ

খুব সম্ভবত বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে রেফারিং এর সিদ্ধান্ত এটাই। ১৯৮২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে সেদিন ফ্রান্সের মুখোমুখি হয়েছিল পশ্চিম জার্মানি।
মিশেল প্লাতিনির বাড়ানো বল ধরতে ছুটছিলেন বদলি হিসেবে প্যাট্রিক ব্যাটিস্তন। অন্যদিকে জার্মান কিপার শুমাখারও গোললাইন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ৷ দুজনের সংঘর্ষে শুমাখারের হাঁটুতে আঘাত লেগে মাঠেই কোমায় চলে যান ব্যাটিস্তন।

হাসপাতালে নেবার পর কোমা থেকে ফিরলেও তাঁকে হারাতে হয়েছিল দুটি দাঁত। পাশাপাশি ভেঙে গিয়েছিল পাঁজরের হাড়ও। আশ্চর্যজনকভাবে রেফারি চার্লস করভার কোনো কার্ড দেখাননি শুমাখারকে। এমনকি ফাউলের বাঁশিও বাজাননি!

  • গিজনের কলংক

১৯৮২ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত খেলতে এসেছিল আলজেরিয়া। প্রথম ম্যাচেই শক্তিশালী জার্মানিকে ২-১ হারিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দেয় তাঁরা। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচের আগে সমীকরণ দাঁড়ায় পশ্চিম জার্মানিকে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ জিততেই হবে, অন্যদিকে অস্ট্রিয়াকে তিন বা কম গোলের ব্যবধানে হারলেই চলবে। অন্যথায় দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে আলজেরিয়া।

দুইটি ম্যাচ ভিন্ন সময়ে হওয়ায় আলজেরিয়া-চিলি ম্যাচের ফলাফল জেনেই মাঠে নেমেছিল ইউরোপের দুই দল। ম্যাচে আলজেরিয়া ৩-২ গোলে জিতে যাওয়ায় তাঁদের জন্য সমীকরণ আরও সহজ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম দশ মিনিটেই জার্মানি এগিয়ে যাওয়ার পর দুই দল খেলেছিল লজ্জাজনক ফুটবল। কোনো আক্রমণ কিংবা ডিফেন্স, পরের ৮০ মিনিট দুই দল স্রেফ নিজেদের মধ্যে পাস খেলে গিয়েছে, ইচ্ছে করে বল বাইরে মেরেছে।

পরবর্তীতে বিশ্ব ফুটবলে নিন্দার ঝড় ওঠে এই দুই দলকে নিয়ে। ফিফাও নড়েচড়ে বসে, এরপর থেকেই মূলত একই গ্রুপের শেষ ম্যাচগুলো একই সময়ে চালু হওয়ার নিয়ম করা হয়।

  • সুয়ারেজের হ্যান্ডবল

২০১০ বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে সেমিফাইনাল খেলার দ্বারপ্রান্তে ছিল ঘানা। জোহানেসবার্গে ম্যাচের শেষ মিনিটে স্টিফেন আপিয়াহর হেডটা গোল হয়েই যাচ্ছিল, কিন্তু গোললাইন থেকে সেটিকে হাত দিয়ে ফিরিয়ে দেন লুইস সুয়ারেজ।

রেফারি তৎক্ষণাৎ সুয়ারেজকে লালকার্ড দেখানোর পাশাপাশি পেনাল্টির বাঁশি বাজান। কিন্তু চাপের মুখে সেই পেনাল্টি পোস্টে রাখতে ব্যর্থ হন আসমোয়াহ জিয়ান। পরবর্তীতে টাইব্রেকারে ম্যাচ জিতে নেয় উরুগুয়ে। ক্রন্দনরত সুয়ারেজের পেনাল্টি মিসের পর উল্লাসে ফেটে পড়ার দৃশ্য আজও স্মরণ করেন ফুটবলপ্রেমীরা।

  • আর্জেন্টিনা বনাম পেরু

১৯৭৮ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ ম্যাচে স্বাগতিক আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল পেরু। সেমিতে উঠতে স্বাগতিকদের ম্যাচ জিততে হত চার গোলের ব্যবধানে। আর্জেন্টিনা সেই ম্যাচ জিতেছিল ৬-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে।

আর্জেন্টিনায় সে সময় চলছে জেনারেল ভিদেলার স্বৈরশাসন। জনগণকে অন্যদিক থেকে সরিয়ে রাখতে সেবারের ফুটবল বিশ্বকাপটা প্রয়োজন ছিল তাঁর। ফলে আর্জেন্টিনাকে যে কোনো মূল্যে বিশ্বকাপ জেতাতে চেয়েছিলেন তিনি।

শোনা যায় সেই ম্যাচের হাফ টাইমে পেরুর ড্রেসিংরুমে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি হুমকির পাশাপাশি ম্যাচ ছেড়ে দেয়ার জন্য টাকার প্রলোভন দেখান। এছাড়া রাজনৈতিকভাবেও নাকি চুক্তি হয়েছিল দুই দেশের মাঝে, ম্যাচ ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে নাকি খাদ্যশস্য এবং অস্ত্র সহায়তা করেছিলেন ভিদেলা।

  • দক্ষিণ কোরিয়ার সেমিফাইনাল যাত্রা

বিশ্বকাপে স্বাগতিকদের সুবিধা দেয়ার ঘটনা ফুটবলে নতুন নয়। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে অতীতে সফলতা পেয়েছে ইতালি, ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনার মত দলগুলো। ২০০২ সালে প্রথমবারের মত এশিয়াতে আয়োজিত বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়াও প্রয়োগ করেছিল পুরনো পদ্ধতি।

বিশেষ করে নক আউট পর্বের ম্যাচগুলোতে এতটাই সুবিধা পেয়েছিল কোরিয়ানরা ফিফার তৎকালীন সভাপতি সেপ ব্ল্যাটারকে পর্যন্ত বিবৃতি দিতে হয়েছিল কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। ইতালির বিপক্ষে গোল বাতিলের পাশাপাশি ফ্রান্সেস্কো টট্টিকে অন্যায়ভাবে লালকার্ড দেখানো হয়েছিল শেষ আটে। এছাড়া দ্বিতীয় রাউন্ডে স্পেনের দুইটি গোল বাতিল করা হয়। তবে শেষ চারে জার্মানির বিপক্ষে আর পেরে ওঠেননি দক্ষিণ কোরিয়ানরা।

  • জিদানের ঢুঁস

২০০৬ বিশ্বকাপে পুরো ফুটবল বিশ্বের নজর ছিল জিনেদিন জিদানের উপর। অবসর ভেঙে ফিরে এসে ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি।

এক প্রকার পুরো দলকে একাই টেনে নিয়েছেন ফাইনাল পর্যন্ত। নক আউট পর্বে ব্রাজিলের বিপক্ষে গোল করেছেন, স্পেনের বিপক্ষে অ্যাসিস্ট। এছাড়া শেষ চারে পর্তুগালের বিপক্ষে পেনাল্টিতে গোল করে ফাইনালের রাস্তাটা পরিষ্কার করেছেন তিনিই।

ফাইনালেও গোল করে দলকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইতালির হয়ে সমতা ফেরান মাতেও মাতেরাজ্জি। অতিরিক্ত সময় শেষের ছয় মিনিট আগে ফাইনালের দুই গোলদাতা জড়িয়ে পড়েন বচসায়। কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে জিদান ঢুঁস মেরে বসেন মাতেরাজ্জির বুকে। এই ঘটনায় রেফারি সরাসরি লালকার্ড দেখান জিদানকে।

মাতেরাজ্জি পরবর্তীতে স্বীকার করেছিলেন মা-বোনকে কথা বলে উত্যক্ত করছিলেন জিদানকে। টাইব্রেকারে সেই ম্যাচে হেরে গিয়েছিল ফ্রান্স। ধারণা করা হয় জিদান শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকলে বিশ্বকাপটা আসতো ফ্রান্সের ঘরেই।

  • দ্য হ্যান্ড অব গড

ডিয়েগো ম্যারাডোনা এবং বিতর্ক যেন একে অন্যের পরিপূরক। ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় ছিলেন সংবাদ মাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রে। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যান্ড অব গডের জন্যই।

১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হাত দিয়ে গোল করেন ফুটবল ঈশ্বর। মাঝমাঠ থেকে বাড়ানো বল ইংরেজ গোলকিপার পিটার শিলটনের আগে ধরতে পারবেন না বুঝতে পেরেই হাত দিয়ে বল জালে জড়ান তিনি।

রেফারিসহ দর্শকরা কেউই বুঝতে পারেননি তাঁর এই কারসাজি, ফলে ইংরেজ ফুটবলারদের আপত্তি সত্ত্বেও গোলের বাঁশি বাজান রেফারি। ম্যারাডোনা পরবর্তীতে একে আখ্যায়িত করেন ‘হ্যান্ড অব গড’ নামে। ইংরেজ সমর্থকরা আজও ক্ষমা করতে পারেননি ম্যারাডোনাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link