More

Social Media

Light
Dark

ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ট্রফি ও অজানা আর্নি ম্যাক’কর্মিক

১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মেলবোর্নের সবচাইতে পুরনো ক্রিকেট ক্লাব রিচমন্ড। ১৮৭৭ সালে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচের একাদশেও দুজন প্রতিনিধি ছিলেন রিচমন্ড ক্লাবের; টম কেন্ডাল আর জন হজেস।

১৯২৬ সালের কথা। স্থানীয় মফস্বল থেকে লম্বা, ছিপছিপে গড়নের একটি ছেলে এলো রিচমন্ড ক্লাবে, ট্রায়াল দিতে। ছেলেটি উইকেটকিপিং করত, পাশাপাশি টুকটাক বোলিংটাও ঝালিয়ে নিত। যেন তেন বোলিং নয়, রীতিমতো ফাস্ট বোলিং! তো কিপিংয়ের ট্রায়াল শেষে ছেলেটি যখন নেটে প্রথম বলটি করল, রিচমন্ড ক্লাবের তৎকালীন অধিনায়ক লেস কিটিংয়ের তো চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার উপক্রম!

তিনি অবশ্য মুখে কিছু বললেন না। কিছু সময় ধরে ছেলেটির বোলিং উপভোগ করলেন, তারপর ক্লাবের নিউজলেটারে একটি নোট লিখলেন। তা কী লেখা ছিল সেই নোটে?

ads

‘আজ নেটে একটা নতুন ছেলেকে দেখলাম। যেমন লম্বা, তেমনই সুঠাম দেহের গড়ন। কিপার কাম ফাস্ট বোলার, ওর বলের গতি দেখে আমি জাস্ট ভড়কে গেছি। এত জোরে বোলিং করে ছেলেটা! ওকে খেলতে গিয়ে ব্যাটসম্যানদের অস্বস্তিটা খুব ভালমতো টের পাচ্ছিলাম। একটা নতুন পেসার খুঁজছিলাম অনেকদিন ধরেই, আমরা সেটা পেয়ে গিয়েছি । আর হ্যাঁ, ওকে আর কখনও কিপিং করতে দেব না। ও শুধু বোলিং করবে।’

রিচমন্ড ক্লাব ছেলেটির জীবনের বাঁকটাই ঘুরিয়ে দিল। উইকেটকিপিং ছেড়ে সে হয়ে উঠল পুরোদস্তুর ফাস্ট বোলার! ক্লাব ক্রিকেটে আলো ছড়াতে থাকল নিয়মিতই। যেখানেই খেলতে যেত, গতি দিয়ে চমকে দিত সবাইকে।

মেলবোর্ন গ্রেড ক্রিকেটে (স্থানীয় ক্লাব ক্রিকেট কম্পিটিশন) নিয়মিত আলো ছড়ানো ছেলেটির রাজ্যদল ভিক্টোরিয়ার হয়ে খেলাটা একসময় হয়ে উঠল সময়ের ব্যাপার। দ্রুত চলেও এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯২৯ সালে ফার্স্ট ক্লাস অভিষেকেই ছেলেটি গায়ে জড়ালো ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়ার জার্সি। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের অসংখ্য নামীদামী তারকা উঠে এসেছেন এই ক্লাবে খেলেই।

 

ও হ্যাঁ, ছেলেটির নামই তো বলা হয়নি এতক্ষণ। কী মুশকিল! নামটা বলছি তবে শুনুন, আর্নেস্ট লেসলি ম্যাক’কর্মিক ওরফে আর্নি ম্যাক’কর্মিক।

অনেকে হয়ত ভাবছেন, যাব্বাবা এ আবার কে? এর নাম তো শুনিনি কোনদিন! অনেকে হয়ত গুগলে ঘাঁটাঘাটি আরম্ভ করে দিয়েছেন। পরিসংখ্যান দেখে নিশ্চয়ই হতাশও হচ্ছেন কেউ কেউ। ১২ টেস্টে মাত্র ৩৬ উইকেট! একে নিয়ে আবার এত আদিখ্যেতার কী আছে বাপু?

ম্যাক’কর্মিকের ফার্স্ট ক্লাস রেকর্ডটাও তেমন আহামরি নয়। ৮৫ ম্যাচে ২৪১ উইকেট, বোলিং গড় ২৭। সেরা বোলিং ৪০ রানে ৯ উইকেট। সমসাময়িক ক্রিকেটবোদ্ধাদের মতে, আর্নির ছিল ক্ল্যাসিকাল হাই আর্ম অ্যাকশন। সুইং খুব বেশি ছিল না, তবে উচ্চতার কারণে ভাল বাউন্স পেত। প্রধান সম্পদ বা এক্স ফ্যাক্টর যেটাই বলি, সেটা ছিল ওর ফিয়ারসাম স্পিড। ‘হি ওয়াজ ইভেন ফাস্টার দ্যান দি গ্রেট ডুয়ো অব রে লিন্ডওয়াল অ্যান্ড কিথ মিলার!’ এটা আমার কথা নয়, বিখ্যাত চ্যাপেল ভাইদের ‘নানা’ সাবেক টেস্ট অধিনায়ক ভিক্টর রিচার্ডসনের কথা।

অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের কাছে ‘ব্যাগি গ্রিন’ একটি আবেগের নাম। ১৯৩৫-৩৬ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আর্নি ম্যাক’কর্মিকেরও সুযোগ হয়েছিল ব্যাগি গ্রিন মাথায় তোলার। লেট থার্টিজের ওই সময়টাতে অস্ট্রেলিয়া ছিল সম্পূর্ণ স্পিন নির্ভর দল। জেনুইন ফাস্ট বোলারের একটা সংকট চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরেই।

ডারবানের কিংসমিডে অভিষেক ম্যাচে ম্যাক’কর্মিক পেয়েছিলেন মাত্র এক উইকেট, অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল নয় উইকেটের ব্যবধানে। পাঁচ ম্যাচ সিরিজের সব কটিতে খেলে মাত্র ১৫ উইকেট নিলেও গড় খারাপ ছিল না, ২৭.৮৬। নতুন বলে নিয়মিত ব্রেকথ্রু এনে দিতেন বলেই বিল ও’রাইলি, ক্ল্যারি গ্রিমেটদের জন্য কাজটা আরও সহজ হয়ে যেত।

১৯৩৬-৩৭ সালের অ্যাশেজ। আর্নির জন্য সিরিজের শুরুটা ছিল এককথায় দুর্দান্ত। সিরিজের প্রথম বলটাই ছিল নিখুঁত ইনসুইঙ্গার, ইংলিশ ওপেনার স্যাম ওয়ার্দিংটন হয়েছিলেন ক্লিন বোল্ড। ওভার ছয়েক বাদে আবারও আর্নির আঘাত! আর্থার ফ্যাগ এবং ওয়ালি হ্যামন্ডকে ফিরিয়ে দেন পরপর দুই বলে! উল্লেখ্য, এটা ছিল ইংরেজ ব্যাটিং আইকন ওয়ালি হ্যামন্ডের ক্যারিয়ারে প্রথম অ্যাশেজ ডাক!

মাত্র ২০ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড তখন রীতিমতো কাঁপছে। তবে দুর্ভাগ্য অস্ট্রেলিয়ার, দুর্ভাগ্য ম্যাক’কর্মিকের। শরীরের নিম্নাঙ্গের মাংসপেশিতে টান ও তীব্র ব্যথা অনুভব করায় মাত্র ৮ ওভার বোলিংয়ের পর ওই টেস্টে আর বলই হাতে নিতে পারেন নি তিনি! অস্ট্রেলিয়াও হেরেছিল ৩২২ রানে!

ইনজুরির কারণে আর্নি মিস করেন পরের ম্যাচটাও। তবে তৃতীয় টেস্টে ফিরে এসে সাক্ষী হন একটি ইতিহাসের। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম টেস্ট থেকে তুলে নেন আরও আট উইকেট; ব্র‍্যাডম্যান ম্যাজিকে ভর করে (পাঁচ ম্যাচে ৮১০ রান) প্রথম দুই ম্যাচ হেরেও শেষ তিন ম্যাচ জিতে অবিশ্বাস্য এক প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখেছিল অস্ট্রেলিয়া।

১৯৩৮ অ্যাশেজের প্রাক্কালে শেফিল্ড শিল্ডের গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ভিক্টোরিয়া ও সাউথ অস্ট্রেলিয়া। সে ম্যাচে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করেন আর্নি ম্যাক’কর্মিক। ৪০ রানে নয় উইকেট, মাত্র ১১ ওভারে! সবচেয়ে মূল্যবান উইকেটটা ছিল ব্র‍্যাডম্যানের, আট রান করে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন লিন্ডসে হ্যাসেটের হাতে।

১৯৩৮ অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার পেস আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আর্নি ম্যাক’কর্মিক। ক্ল্যারি গ্রিমেটের বিদায়ের পর অস্ট্রেলিয়া তখন ‘রিস্ট স্পিন ত্রয়ী’ বিল ও’রাইলি (লেগি), ফ্রাঙ্ক ওয়ার্ড (লেগি) এবং চাক ফ্লিটউড-স্মিথের (চায়নাম্যান) ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। পেস ডিপার্টমেন্টে বলা যায় সবেধন নীলমণি ছিলেন আর্নি ম্যাক’কর্মিক। মরা উইকেটেও গতির ঝড় তুলতে পারতেন বলে অনেকে তাঁকে হ্যারল্ড লারউডের সাথেও তুলনা করছিল।

এদিকে উস্টারশায়ারের বিপক্ষে সফরের প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচে ঘটে যায় এক অপ্রীতিকর ঘটনা। হারবার্ট বল্ডউইন নামের এক স্থানীয় আম্পায়ার ম্যাক’কর্মিককে এক ইনিংসেই ১৯ বার নো ডাকেন! ম্যাচ শেষে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫-এ!

ক্রীড়ালেখক ডেভিড ফ্রেজারের মতে, ‘আম্পায়ারের বেশিরভাগ নো কলই ছিল সন্দেহজনক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর্নিকে যতদূর চিনি, ওর পক্ষে এতগুলো নো বল করা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবে এ নিয়ে আর্নির মনে কোন ক্ষোভ বা অসন্তোষ ছিল না। সে খুশি মনেই মেনে নিয়েছিল সব। উল্টো আম্পায়ারদের কাছে বারবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছিল! ও সর্বদা বিশ্বাস করত যে মাঠে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই শেষকথা, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে সেটা ক্রিকেটীয় চেতনায় আঘাত করা।’

দুঃখজনক ব্যাপার হল, ওটাই ছিল আর্নি ম্যাক’কর্মিকের ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজে। ৩ টেস্ট খেলে নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। লর্ডসে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে বলতে গেলে একাই লড়েছিলেন বল হাতে, প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসে নেন তিন উইকেট।

ইনজুরির কারণে মাত্র ৩২ বছর বয়সেই সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান আর্নি ম্যাক’কর্মিক। ক্রিকেট ছেড়ে যোগ দেন পারিবারিক জুয়েলারির ব্যবসায়। আর্নি নিজেও ছিলেন একজন দক্ষ, পেশাদার জহুরি।

১৯৬০ সালে ঐতিহাসিক ব্রিসবেন টেস্ট যখন ‘টাই’ হলো, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের তরফ থেকে গৃহীত হল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার দ্বৈরথকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যানের পরামর্শে একটি স্মারক ট্রফি বানানোর দায়িত্ব দেয়া হল আর্নি ম্যাক’কর্মিককে।

মাত্র এক সপ্তাহের নোটিশে অসম্ভব সুন্দর দেখতে একটি ট্রফি বানিয়ে ফেললেন আর্নি। স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যান, জনি ময়েস, রিচি বেনোদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে ট্রফির নামকরণ করা হল ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওরেলের নামে।

অ্যাশেজের মতই মর্যাদাপূর্ণ ‘ফ্রাঙ্ক ওরেল’ ট্রফির ডিজাইনে আর্নি ব্যবহার করেছিলেন ঐতিহাসিক ‘টাই’ টেস্টে ব্যবহৃত একটি লাল রঙের বল। সিরিজ শেষে মেলবোর্নের গ্যালারিভর্তি দর্শকের সামনে বিজয়ী দলের অধিনায়ক রিচি বেনোর হাতে নিজ নামে নামাঙ্কিত এই ট্রফি তুলে দেন স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল।

১৯৯১ সালের ২৮ জুন, নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন আর্নি ম্যাক’কর্মিক। খুব বিখ্যাত কেউ হয়ত ছিলেন না, তবে ফ্রাঙ্ক ওয়ারেল ট্রফির স্থপতি হিসেবে ক্রিকেট তাঁকে আজীবন মনে রাখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link