More

Social Media

Light
Dark

দশক সেরা পাঁচ ওয়ানডে

এক দশক পর হিসেবের খাতা নিয়ে সকলেই বসছেন। আমরাও বসি। তবে দশক সেরা দল অনেকেই বানাচ্ছেন, তাই সেই পথ দিয়ে হাঁটছি না। টেস্ট ও ওয়ানডের নিরিখে, দশকের সেরা পাঁচ ম্যাচ, সেরা পাঁচ ইনিংস, সেরা পাঁচ স্পেল ইত্যাদি বেছে নেবো।

এবারের আয়োজনে থাকছে সেরা পাঁচ ওয়ানডে ম্যাচ। এই তালিকায় বিশ্বকাপের ম্যাচের আধিক্য বেশি থাকবে এবং তার জন্যে অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে রাখছি। তার কারণ ওই মঞ্চের মতো চাপ বা নাটকীয়তা সাধারণ দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিদেশীয় সিরিজে থাকেনা। তবে আর দেরি না করে শুরু করা যাক।

  • অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ড, ২০১৫ বিশ্বকাপ, অকল্যান্ড (লিগ পর্যায়ের ম্যাচ)

ছোট মাঠ, তড়িৎ আউটফিল্ড, পাটা পিচ এবং ব্যাটসম্যানদের উপযোগী নিয়ম কানুন। এই সব কারণের জন্যে এই ম্যাচ শুরুর আগে ক্রিকেট পন্ডিত থেকে সাধারণ ভক্ত- সকলেই মনে করেছিলেন বহু রান উঠতে চলেছে সেই ম্যাচে। দুই দলেই ব্যাট হাতে প্রচুর মাহারথিসম ব্যাটসম্যান বিদ্যমান। এদিকে ম্যাককালাম, টেলর, উইলিয়ামসন তো ওদিকে ওয়ার্নার, ফিঞ্চ, ক্লার্ক, ম্যাক্সওয়েল। সমীকরণের প্রায় বাইরে থাকা বোলাররাই কিন্তু এই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করেন।

ads

১৩ ওভারে ৮০ রানে ২ উইকেটে, এই অবস্থায় অজি সমর্থকরা যখন কত রান হলে নিরাপদ হয় তাই ভাবছেন এবং নিউজিল্যান্ড সমর্থকরা ভাবছেন ৩৫০র বেশি হলে খুব মুশকিল, সেই সময় মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন ট্রেন্ট বোল্ট ও টিম সাউদি। মাত্র ৩২.২ ওভারে অস্ট্রেলিয়া গুটিয়ে যায় ১৫১ রানে। বোল্ট নেন ৫ উইকেট, সাউদি ২। তবে এর জন্যে আলাদা করে ধন্যবাদ অবশ্য প্রাপ্য অধিনায়ক ম্যাকালামের। প্রধান বোলাররা মার্ খাওয়া সত্ত্বেও, ঘন ঘন পরিবর্তন বা রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্ব করেননি। হলপ করে বলতে পারি, ১৩ ওভারে ৮০ তে ১ অবস্থায় অন্য যেকোনো অধিনায়ক স্লিপ সরিয়ে নিতেন, সেরা বোলারদের স্লগ ওভারের জন্যে বাঁচিয়ে রাখতেন।

তবে ম্যাকালামের কারিকুরি এখানেই শেষ হয় না। স্টার্ক, জনসনদের এমন পেটানো শুরু করেন যে মনে হচ্ছিলো ফ্লাডলাইট গুলো দরকারই হবে না। অস্ট্রেলিয়া কে ম্যাচে ফেরান স্টার্ক ও কামিন্স। কামিন্স তুলে নেন মাকালামকে এবং স্টার্ক প্রায় গোটা মিডিল অর্ডারকে। একসময় তো নিউজিল্যান্ড ১৪৬ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায়। কিন্তু অচঞ্চল, বরফশীতল উইলিয়ামসন কামিন্স কে লং-অফ বাউন্ডারিতে উড়িয়ে নিউজিল্যান্ডকে জেতান। লো স্কোরিং ওয়ানডে ম্যাচ যদি আলাদা করে একটা ক্রিকেটীয় প্রতিষ্ঠান হয়, এই ম্যাচ তবে সেই প্রতিষ্ঠানের অবশ্য-পাঠ্য বিষয় হওয়া উচিত।

  • ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া, ২০১১ বিশ্বকাপ, কোয়ার্টার ফাইনাল, আহমেদাবাদ

বিশ্বকাপের নকআউট ম্যাচ এলেই পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া যেন একটা অন্য দল হয়ে উঠতো। সেই বিশ্বকাপে তারা ততদিনে বেশ চাপেই ছিল, ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর প্রথম পাকিস্তানের কাছে হেরে যাওয়া এবং পন্টিংয়ের অফ-ফর্মে চেনা অস্ট্রেলিয়াকে যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। কিন্তু নকআউটে অস্ট্রেলিয়া মানে তো আর দ্বিপাক্ষিক সিরিজের অস্ট্রেলিয়া নয়।

ভারত, ইংল্যান্ডের সাথে টাই এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হেরে গ্রুপে দ্বিতীয় হয়ে তাদের চিরকালীন বিশ্বকাপ জুজু সেই অজিদের সামনেই পড়লো। টসে জিতে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং নেয়া থেকে শুরু। প্রায় ঘূর্ণি উইকেটে ২৬০ রান, পন্টিংয়ের ফর্মে ফেরা শতরান, এরপর ঘরের মাঠের হিমালয়সম চাপ। চেনা ছকে চিত্রনাট্য চললে ভারতের সেই ম্যাচে ১৮০-১৯০ তে গুটিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু ধোনির ভারত অন্যরকম ভেবেছিলো এবং অস্ট্রেলিয়া দলে একজন ভালো স্পিনার না থাকাটাও ভারতের কাজ খানিক সহজ করে দেয়।

শচীন, গম্ভীর এবং রায়না নিজের নিজের কাজটি করে দিয়ে চলে যান। কিন্তু যিনি না থাকলে এই ম্যাচ জিততো না ভারত তিনি হলেন যুবরাজ সিং। শেষের দিকে প্রায় ঝুরো ঝুরো হয়ে যাওয়া উইকেটে যে ৫০ টি রান সেদিন মেরেছিলেন যুবি, তেমনটা খেলতে আমি ওনাকে খুব বেশি বার দেখিনি। আমার ব্যক্তিগত মতামত, ওই ম্যাচটা জিতেই ভারতের আত্মবিশ্বাস এমনই আকাশ ছুঁয়েছিল, যে পরবর্তী ম্যাচ দুটি বার করতে বিশাল কোনো মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সম্মুখীন হয়নি ভারত।

  • ভারত বনাম শ্রীলঙ্কা, ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনাল, মুম্বাই

ওয়াঙখেড়ের সেই মায়াবী রাত নিয়ে বেশিকিছু বলার মানে হয় না। সকল ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকেরই বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেই ম্যাচ ঘিরে। এই ম্যাচ নিয়ে তাই আলাদা করে কিছু বলবো না। সবার স্মৃতিচারণেই এই ম্যাচের মাহাত্ম্য।

তবে একটা কথা বলবো, গম্ভীরের লড়াকু ৯৭, ধোনির অমর ৯১ এবং জায়ায়ার্ডেনের শৈল্পিক শতরান এই ম্যাচ কে খাঁটি ক্রিকেটীয় বিচারেও গত দশকের অন্যতম সেরা একদিনের আন্তর্জাতিকের তালিকায় আনবে ।

  • দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম নিউজিল্যান্ড, ২০১৫ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, অকল্যান্ড

দুই দলের কাছেই প্রথম বার বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার হাতছানি। পারম্পরিক ‘চোকার্স’ দক্ষিণ আফ্রিকা আবার ঠিক আগের ম্যাচেই বিশ্বকাপে তাদের প্রথম নকআউট জয় পেয়েছে। আর নিউজিল্যান্ড কার্যত ওয়েস্টইন্ডিজ কে উড়িয়ে উঠেছে সেমিফাইনালে। কিন্তু বিধি বাম। এমন মুচমুচে নাটকীয়তায় এবার বাধ সাধলো বৃষ্টি।

৫০ ওভারের ম্যাচ গিয়ে দাঁড়ালো ৪৩ ওভারে। ডুপ্লেসি, ডিভিলিয়ার্স দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর মোটামুটি সুবিধা জনক জায়গায় পৌঁছে দেবার পরে মিলার শুরু করেন তাঁর তারাবাজি। ১৮ বলে ৪৯ রান, তাও বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে। তখন সত্যিই মনে হচ্ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা তাঁদের চোকার্স তকমা এবার ঘুচিয়েই দিলো। কিন্তু ডাকওয়ার্থ-লুইস এবং বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার শোচনীয় পরাজয়ের প্রেম কাহানি তখন মধ্যগগনে।

ম্যাককালাম শুরু করেন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ২৬ বলে ৫৯ দিয়ে। মাঝের ওভারগুলোয় দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে ফিরলেও, তাদের দেশেই জন্মানো ‘বিভীষণ’ গ্রান্ট এলিয়টকে বোধহয় খুব বেশি গুরুত্ব দেননি ডি ভিলিয়ার্সরা। আমার দেখা গত দশকের সেরা ওয়ানডে ইনিংসটি খেলে নিউজিল্যান্ডকে জেতান এলিয়ট। ২ বলে ৫ বাকি এই অবস্থায় ১০০ বারের মধ্যে টেনেটুনে একবার ব্যাটিং দল জেতে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে চাপে চোক করা দক্ষিণ আফ্রিকার চিরকালীন নস্টালজিয়া এবং অভ্যেস। তাই ডেল স্টেইনও সেই সময় হাফভলি দেন। এবং ম্যাচ শেষ হয় এলিয়টের ছক্কা, ক্রন্দনরত ডিভিলিয়ার্স ও মরকেল এবং হতাশায় শুয়ে পড়া ডেল স্টেইনকে এলিয়টের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মতো সব মায়াবী মুহূর্ত দিয়ে।

  • ইংল্যান্ড বনাম নিউজিল্যান্ড, ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল, লর্ডস

গত দশকের সেরা ওয়ানডে ম্যাচ। লর্ডস, বিশ্বকাপ ফাইনাল এবং এক নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাবার আশা-এই ত্রয়ী ম্যাচ শুরু হবার আগেই যেন এই ম্যাচকে অমর বানিয়ে দেয়। গত বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার ঠিক যে হাল নিউজিল্যান্ড করেছিল, এবার ঠিক সেই হাল তাদের হয়। একটা অজেয়, অবিনশ্বর ইনিংস এবং কিছুটা দুর্ভাগ্য নিউজিল্যান্ডকে এখনো বিশ্বকাপ পেতে দেয়নি। ২০১৯ ছিল বেন স্টোকসের বছর।

সেবার তিনি যা ছুঁচ্ছিলেন তাই যেন সোনায় পরিণত হচ্ছিলো। ক্রিস্টোফার নোলানের ছবির মতো, ‘অ্যাম্বিগুয়াস’ সমাপ্তি ঘটে এই ম্যাচের। কিন্তু আমাদের জীবনও তো এম্বিগুয়াস। কেন উইলিয়ামসন, মরগ্যান, স্টোকস, সেই সুন্দর জীবনেরই একেকটা টুকরো। তাই শুধু ক্রিকেটীয় দিক দিয়ে নয় (ক্রিকেটীয় দিক দিয়ে সন্দেহাতীত ভাবে সর্বকালের সেরা ম্যাচ), মানবিক দিক দিয়েও এই ম্যাচের গুরুত্ব অপরিসীম।

এই ম্যাচ আমাদের শিখিয়ে যায়, উইলিয়ামসনরা যেমন ভাবে লড়াই করলেন, তেমন লড়াই করার পরও মাঝে মাঝে আমরা হেরে যাই। আবার একই সাথে শেখায়, ‘হাল ছেড়োনা বন্ধু’ সম বেন স্টোকসের নাছোড় লড়াই জীবনে আমাদের অনেক আশাতীত উপহারও দিতে পারে। এই ম্যাচের নির্জাসটাই জীবন এবং তার মধ্যেকার আশা-নিরাশা, পাওয়া-না পাওয়ার নিরলস, চিরন্তন দড়ি টানাটানি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link