More

Social Media

Light
Dark

উদ্ভট প্রতিভার রঙিন জীবন

উমর আকমলের মত ‘ক্রিকেটার’ বিশ্ব ক্রিকেটেই সম্ভবত আর আসেনি। না, ক্রিকেট মাঠে এমন কোনো রেকর্ড তিনি কোনো কালেই গড়েননি যে, যার জন্য তাকে মনে রাখার দরকার আছে। বরং তিনি যা যা অসম্ভব কীর্তি আর কাণ্ড ঘটিয়েছেন মাঠের বাইরে, সে সবই  তাকে মনে রাখার জন্য যথেষ্ট।

তিনি জুয়ারির কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার খবর একাধিকবার গোপন করেছেন, যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) তাকে তিন বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করেছে। বিরাট অংকের জরিমানাও হয়েছে তাঁর, যেটা একদফা পরিশোধ করার সাধ্য তাঁর নেই বলেও জানিয়েছেন। তারপরও, তাকে ঠিক ‘ব্যাড বয়’-দের কাতারে ফেলা যায় না।

কারণ, ব্যাড বয় হওয়ার জন্যও মস্তিষ্ক কিংবা প্রজ্ঞা থাকা দরকার সেটা আকমলের নেই। আকমল ক্রিকেট মাঠে সর্বকালের সেরা নির্বোধ। ক্রিকেটের বিখ্যাত যত ‘ব্যাড বয়’ আছেন যেমন আজহার উদ্দিন, হার্শেল গিবস, মনোজ প্রভাকর, শেন ওয়ার্ন, সেলিম মালিক, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস কিংবা বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান – এদের সবার থেকেই যোজন যোজন দূরে আছেন তিনি।

ads

ক্যারিয়ারের একদম শুরু থেকেই নানারকম ‘নাটক’-এ ওস্তাদ তিনি। ২০১০ সালের এপ্রিলে দলে জায়গাটাই যখন ঠিক মত পাকা হয়নি তখন তিনি ‍ভুয়া ইনজুরির নাটক করলেন, যাাতে করে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তৃতীয় টেস্ট তাঁকে খেলতে না হয়। পরে জানা গেল আপন ভাই কামরান আকমলকে উইকেটের পেছনে বাজে পারফরম্যান্সের জের ধরে বাদ দেওয়ায় সেটা ছিল তাঁর প্রতিবাদ। বুঝলেন, কি রকম মাথা মোটা হলে এমন চিন্তা কারও মাথায় আসতে পারে!

২০১৪ সালের কথা। বাংলাদেশে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর বসেছে। গোল টেবিলে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন ঢাকার টিম হোটেলে। কি একটা প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘গুগল করলেই বুঝতে পারবেন কেন আমি টপ অর্ডারে খেলি!’

তো এখন ‍গুগল করে তাঁর সর্বশেষ রেকর্ড জানা গেল। ১৬ টি টেস্ট, ১২১ টি ওয়ানডে আর ৮৪ টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। কোনো ফরম্যাটেই গড় ৩০-৩৫’র ওপরে নয়। তবে, পাকিস্তানের কাছে তিনি সময়ের সেরা প্রতিভাদের একজন ছিলেন বরাবরই। তাই তো, অজস্র বার শৃঙ্খলাভঙ্গ করেই তিনি রেহাই পেয়ে গেছেন।

এই ২০২০ সালেই তো ফিটনেস টেস্ট চলাকালে ট্রেইনারের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে অনুশীলন ছেড়ে বেরিয়ে যান। তখনও পিসিবি বড় কোনো সাজা দেয়নি তাকে। যদিও, ঘটনাটা বেশ গুরুতর, তিনি ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির ফিটনেস ট্রেইনারের সাথে দুর্ব্যবহারের একটা পর্যায়ে জামা কাপড় খুলে ফেলে নাকি ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কোথায় চর্বি আছে? পারলে দেখান।’

এর আগে অনেকবারই তিনি এমন ঘটনা ঘটিয়ে অল্পের জন্য ছাড়া পেয়েছেন।

তখন ২০১৫ সাল। পাকিস্তানের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান উমর আকমলের মনটা ভাল ছিল না। মাত্রই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অনুষ্ঠিতব্য টি-টোয়েন্টি সিরিজের দল থেকে বাদ পড়েছেন। মনে বল ফেরাতে তিনি গেলেন এক পার্টিতে। যেন তেন পার্টি নয়, সেটা ছিল এক অবৈধ মুজরা পার্টি। সেখানে নাম না জানা আরও কয়েকজন পাকিস্তানি ক্রিকেটারও ছিল। পাকিস্তানের হায়দ্রারাদের এক বাংলোতে চলছিল পার্টি। আকমলরা মুজরা নাচ দেখছিলেন।

প্রতিবেশিদের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ চলে আসলো। সবাইকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হল থানায়। খবর চাউর হওয়া মাত্র পিসিবিরও টনক নড়ে। যদিও, তখন কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো ছাড়া বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি সংস্থাটি।

২০১৭ সালে তিনি আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ী কোচ মিকি আর্থারের সমালোচনা করেন প্রকাশ্যে। দাবি করেন এই কোচ নাকি তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। আকমল দাবি করেন এই ঘটনা নাকি খোদ প্রধান নির্বাচক ইনজামাম উল হকের সামনেই ঘটে। মিডিয়ার সামনে মানহানিকর মন্তব্যের জন্য এবার উমরের এক লাখ রুপি জরিমানা করা হয়। তিন ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধও হন তিনি, দুই মাসের জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলতেও দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা।

কোচের সাথে এমন সম্পর্ক থাকার পরও উমর আকমল পাকিস্তান দলে ফেরেন। তবে, ফিরেই টিম কারফিউ ভাঙেন। এবার তাঁর ম্যাচ ফি’র ২০ শতাংশ কেটে নেওয়া হয়।

২০১৯ সালে পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) এক প্রচারণামূলক ভিডিওতে বলে বসলেন, ‘আমরা ঘরের সমর্থকদের অপেক্ষায় আছি। মাঠে যত বেশি সমর্থক এসে উৎসাহ যোগাবেন দল আরও ভাল পারফর্ম করতে পারবে। যদি, সমর্থকরা এভাবেই সমর্থন যুগিয়ে যান তাহলে আগামী আইপিএল হবে শুধু পাকিস্তানে! সরি, পিএসএল হবে শুধু পাকিস্তানে।’

সেটা নিয়ে বেশ কিছুদিন গরম হয়ে থাকলো ফেসবুক-টুইটার।

উমর আকমলের জীবনটা এমনই রঙিন, এতটাই উদ্ভট। রমিজ রাজা যতই বলুন না কেন ‘আনুষ্ঠানিক ভাবে নির্বোধের খাতায় নাম লেখালো উমর আকমল’ তাতে তাঁর কিছুই যায় আসে না। নিজের দুনিয়াতে আমোদেই আছেন তিনি। মন একটু খারাপ বলে আবার হয়তো কোনো পার্টি-টার্টি করবেন।

না, প্রতিভা তার সত্যিই ছিল। ২০০৯ সালের নভেম্বরে অভিষেক টেস্টেই ১২৯ ও ৭৫ রানের দু’টি ইনিংস খেলেছিলেন। কেউ বলেছিল ইনজামাম উল হকের উত্তরসূরী চলে এসেছেন, কারও মতে,  তিনি ছিলেন ‘ছোট’ মোহাম্মদ ইউনুস। কিন্তু, পরিশ্রম করতে চাইতেন না একদম। ক্যারিয়ারটা তাঁর সাপ লুডুর মত। এগিয়েছেন, আবার সাপে কাটায় নিচে নেমে গেছেন, আবার এগিয়েছেন। কিন্তু, ভুলগুলো শুধরাতে চাননি কখনোই।

উমর আকমলকে ক্রিকেট কখনো ভুলবে না। কারণ, তাঁর মত চরিত্র ক্রিকেটে কখনো আসেনি, ভবিষ্যতেও আসবে কি না সন্দেহ। তিনি টুইটারে ভুলভাল ইংরেজি লিখবেন, আইপিএলকে পাকিস্তানে নিয়ে যাবেন। তিনি মুজরা পার্টিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়বেন। আবার তিনি জুয়াড়ির খবর গোপন করে তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ হবেন। একই অঙ্গে এত রূপ সচরাচর দেখা যায় না। আমরা ভাগ্যবান যে, একের ভেতর এত রূপ দেখার সৌভাগ্য (নাকি দুর্ভাগ্য) আমাদের হচ্ছে।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link