More

Social Media

Light
Dark

ময়দান-মাদক-মাফিয়া-মোহ

জানুয়ারি, ১৯৯১। মধ্যরাত।

দক্ষিণ ইতালির ন্যাপলসের পানশালায় মদ্যপানে ব্যস্ত স্থানীয় এক ফুটবল ক্লাবের এক বিখ্যাত ফুটবলার। সেখানকার মাফিয়ার সাথে যুক্ত দুই ব্যক্তির কাছে দেহপসারিনী খুঁজছিলেন তিনি।

তাঁকে মিডিয়া হন্য হয়ে খোঁজে। তিনি পালিয়ে যেতে চান। মাফিয়ার রাডারেও তিনি আছেন। এমন ক্লাবের হয়ে খেলছেন যেখানে তিনি খেলতে চাচ্ছেন না। আশা হারিয়ে কোকেনে ডুবে পড়েছেন প্রতিভাবান এ মিডফিল্ডার।

ads

ভোর তিনটা চল্লিশ মিনিটে যখন কোকেনে আসক্ত ফুটবলার সঙ্গীনী খুঁজছেন ,তখন এক নারী হাজির হলেন। সাথে তার সন্তান। ছোট্ট ভক্তের সাথে সে ফুটবলারকে কথা বলতে অনুরোধ জানালেন। ভোর রাতের সে সময়ে ছোট্ট ভক্ত তার সাথে সর্বশেষ ম্যাচ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো!

আর বুঝতে নিশ্চয়ই বাকি নেই কার কথা হচ্ছে। তিনি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। সেক্স, ড্রাগ, অ্যালকোহলের প্রতি যার চরম আসক্তি। ক্লাবটি এসএসসি ন্যাপোলি।

দক্ষিণ ইতালিতে ম্যারাডোনার কাটানো সাত বছর (১৯৮৪ – ১৯৯১) সময়কে সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে ধরেছেন আসিফ কাপাডিয়া। তার ডকুমেন্টারির নাম ‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’। সেখানেই উঠে এসেছে এমন চিত্র।

সে রাতে ফিরে যাওয়া যাক। ম্যারাডোনার অগোচরে তার ফোন কল রেকর্ড করা হয়। যা পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। অভিযোগ করা হয় তিনি কোকেন গ্রহণ ও বিতরণে জড়িত ছিলেন। কারণ একজন দেহপসারিনীকে কোকেন দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তিনি ফোন কলে। সে বছরের এপ্রিলে ম্যারাডোনার রক্তে পাওয়া যায় কোকেনের অস্তিত্ব। পনের মাসের জন্য নিষিদ্ধ হন মধ্যমাঠের ‘লিটল ডায়নামো’। আর্জেন্টিনা উড়ে গেলে সেখানেও শান্তি পাননি তিনি। কোকেন গ্রহণের অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

‘যখন তিনি নেপলসে এসেছিলেন তখন তার চোখ জ্বলজ্বল করছিল। মুখে ছিল প্রাণবন্ত হাসি,’ বলেন আসিফ কাপাডিয়া। ‘কিন্তু যখন তিনি এ শহর ছাড়ছিলেন তখন তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। যার জন্য তিনি নিজেও কম দায়ী নন,’ যোগ করেন ‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’ ডকুমেন্টারির নির্মাতা।

তার প্রজন্মের সবচেয়ে প্রতিভাবান ফুটবলার ছিলেন ম্যারাডোনা। এখন যেমন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কিংবা লিওনেল মেসি। কিন্তু ম্যারাডোনা অন্য ধাতুতে গড়া। মাঠের প্রতিভার বাইরেও ছিল তার বৈচিত্র্যময় জীবন। তিনি ছিলেন রোমান্টিক। দেখেছেন জীবনের উত্থান–পতন। দারিদ্রতার সাথে লড়েছেন, উপভোগ করেছেন খ্যাতি। পেয়েছেন দর্শকের ভালোবাসা, কুড়িয়েছেন নিন্দুকের নিন্দা। তাই তো তিনি ম্যারাডোনা।

বুয়েন্স আয়ার্সের এক বস্তিতে ১৯৬০ সালে ম্যারাডোনার জন্ম। আট ভাই-বোনের সংসারে তিনি পঞ্চম। অল্প বয়সেই ফুটবলের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। ম্যারাডোনার ফুটবল নিয়ে কসরতের খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। একজন চলচ্চিত্রকর্মী তার একটি ভিডিও করেন, যেখানে ম্যারাডোনা জানিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছেন তিনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্থানীয় আর্জেন্টিনা জুনিয়র্স দলে যুক্ত হন তিনি। অল্প সময়েই তার কাঁধে চাপে পরিবারের ভার।

বোকা জুনিয়র্সে চুক্তি করার আগে তরতর করে র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠে আসছিলেন ম্যারাডোনা। ১৯৮১ সালে কাঙ্ক্ষিত বোকা জুনিয়র্সের হয়ে মাঠে নামেন তিনি। পরের বছর ইউরোপে খেলতে আসেন এফসি বার্সেলোনার হয়ে। কিন্তু তার বেসামাল জীবন ও মাঠের মেজাজ বেশিদিন বার্সেলোনায় থাকতে দেয়নি। তিনি বার্সেলোনার হয়ে সর্বশেষ মাঠে নামেন ১৯৮৪ সালের কোপা দেল রের ফাইনালে।

প্রতিপক্ষ ছিল অ্যাটলেটিকো বিলবাও। সে ম্যাচে হাঁটুর আঘাতে প্রতিপক্ষের এক ফুটবলারকে অজ্ঞান করে ফেলেন ম্যারাডোনা। স্পেনের রাজ পরিবার তখন দর্শকের মাঝে উপস্থিত। টেলিভিশনেও প্রচার হচ্ছিল সে ম্যাচ। এসব কান্ডের পর ম্যারাডোনাকে নিতে রাজি হয় একমাত্র ন্যাপোলি।

সে সময়ে নেপোলি ছিল নিচের সারির দল। ম্যারাডোনার জন্যও তা ছিল অবমাননাকর। যদিও ম্যারাডোনাকে দেখার জন্য প্রায় আশি হাজার ভক্ত হাজির হয় সান পাওলো স্টেডিয়ামে। সময়টা ছিল ১৯৮৪ সালের জুলাই মাস।

সে সময় নেপলসকে ইউরোপের একটি দরিদ্র জনপদ হিসেবে জানতো সকলে। সহিংস কান্ডও ঘটত হরহামেশা। তাদের দরকার ছিল একজন নায়ক। ম্যারাডোনা ফর্মে থাকলে তার মতো কেউ খেলতেই পারতো না। খুব দ্রুতই শিরোপার দাবীদার হয়ে উঠলো নিচের সারির ন্যাপোলি। যার নেপথ্যে ছিলেন ম্যারাডোনা। একাই টেনেছেন দলটিকে।

সাধারণ মানের আর্জেন্টিনা ফুটবল দলকে নিয়েও স্বপ্ন দেখালেন তিনি। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যে বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা। তখন তার বয়স মাত্র ২৬ বছর। কোয়ার্টার ফাইনালে ২ – ১ গোলে ইংল্যান্ডকে হারায় আর্জেন্টিনা। যার একটি ছিল বিতর্কিত ‘হ্যান্ড অব গড’ খ্যাত গোল। হেড নয় হাত দিয়েই গোল করেছিলেন ম্যারাডোনা।

দ্বিতীয় গোলটি এসেছিল তার অসামান্য মেধায়। পাঁচজন ইংলিশ ফুটবলারকে কাটিয়ে গোল করেন তিনি। যা হয়ে আছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোল। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারানোতেও রয়েছে তার কৃতিত্ব। আর্জেন্টিনায় জাতীয় বীর বনে যান ম্যারাডোনা। ফকল্যান্ড যুদ্ধে হারের প্রতিশোধ যেন ফুটবলের মাধ্যমে নিলো আর্জেন্টিনা, নির্দিষ্ট করে বললে ম্যারাডোনা।

আন্তর্জাতিক সাফল্যের ধারাবাহিকতার ঢেউ আছড়ে পড়ে ইতালির ক্লাব ফুটবলে। ১৯৮৭ সালে প্রথমবার শিরোপা জয় করে নেপোলি। যে পর্যায়ে আসতে ম্যারাডোনার করা ১০ গোল রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্থানীয়দের কাছে রীতিমত দেবতা হয়ে ওঠেন তিনি।

ম্যারাডোনা লোকজনের নজর এড়িয়ে ঘুরতে পারতেন। এজন্য দ্য ক্যামোররা নামের একজন কুখ্যাত মাফিয়া সদস্য তাকে নিরাপত্তা দেন। এতে করে পার্টি করা, ড্রাগ নেয়া এবং নারী সঙ্গ পাওয়া সহজ হয়ে পড়ে ম্যারাডোনার কাছে। ক্লওদিয়া ভিল্লাফানের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে থাকার পরেও ক্রিস্টিয়ানা সিনাগ্রার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সিনাগ্রা ছিলেন তার বোনের বান্ধবী।

১৯৮৭ সালে সিনাগ্রা দিয়েগো জুনিয়রের জন্ম দেন। টেলিভিশনে শিশুটিকে নিয়ে হাজির হয়ে জানান ম্যারাডোনা তার বাবা। সত্য জানার পরও ম্যারাডোনা পিতৃত্ব স্বীকার করেননি। ক্লাওদিয়ার ঘরে আছে তার দুইজন মেয়ে। ধারণা করা হয় খ্যাতির চূড়ায় ওঠার পর সত্যকে অস্বীকার করে পতনের পথ সুগম করেছিলেন কিংবদন্তি ফুটবলার স্বয়ং। যদিও অনেক বছর পর ২০১৬ সালে সন্তানের স্বীকৃতি দেন ম্যারাডোনা। এ নিয়ে ছয় সন্তানের পিতৃত্ব নিশ্চিত করেন তিনি। যাদের জন্ম ম্যারাডোনার বহুগামিতার ফলে।

ন্যাপোলি ১৯৮৯ সালে উয়েফা কাপ জয় করে। পরের বছর, ১৯৯০ সালে সিরি ‘এ’ শিরোপা ফের জিতে নেয়। কিন্তু ম্যারাডোনা মানসিকভাবে শান্তিতে ছিলেন না। তিনি শান্তভাবে ফুটবল খেলতে চেয়েছিলেন, অন্য কোথাও। পালানোর পথ খুঁজছিলেন। অনেকের মতে নেপোলি ম্যারাডোনাকে আরও আগে ছেড়ে দিলে তার হয়তো এ পরিণতি হত না।

১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হয় ইতালিতে। সেমিফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় ন্যাপলসে। আর্জেন্টিনা পেনাল্টি শুট-আউটে ইতালিকে হারায়। যেখানে ম্যারাডোনাও গোল করেন। নেপলসে একরাতের মধ্যে নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হলেন ম্যারাডোনা। তার বিরুদ্ধে মাদকসহ নানা অভিযোগ আসতে শুরু করে। তার ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞারোধে কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি ন্যাপোলিকে।

১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সে বিশ্বকাপেও খেলেছিলেন ম্যারাডোনা। যদিও মাদক কান্ডে তার বিশ্বকাপে খেলা নিয়ে সংশয় তৈরী হয়। তিনি সব সন্দেহ দূর করে উড়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। উড়োজাহাজে চড়ার আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মোটা হয়ে গেছি, আগের গ্রেট ম্যারাডোনা আর নেই – এসব শুনে শুনে আমি ক্লান্ত। বিশ্বকাপে তারা সত্যিকারের দিয়েগোকে দেখবে।’

গ্রুপ পর্বে গ্রীসের বিরুদ্ধে একটি গোল করেন ম্যারাডোনা। পরের ম্যাচে নাইজেরিয়ার সাথে দুটো গোলে ভূমিকা রাখেন। সে ম্যাচের পরপর করা ড্রাগ টেস্টে দেখা যায় তিনি সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এফিড্রিন নিয়েছেন। যা ছিল নিষিদ্ধ ওষুধ। এর ফলে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায় ম্যারাডোনার। কার্যত সেখানেই শেষ হয়ে যায় তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। মাত্র ১৭৩ মিনিট তিনি মাঠে ছিলেন সে বিশ্বকাপে।

গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বুলগেরিয়ার কাছে হেরে আর্জেন্টিনা প্রমাণ করে ম্যারাডোনার উপস্থিতি তাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে নিজের আত্মজীবনীতে ম্যারাডোনা জানিয়েছিলেন ফিফার সাথে চুক্তি ছিলো স্থূলতা কমানোর জন্য তিনি এ ড্রাগ নিতে পারবেন।

১৯৯৭ সালে চিরদিনের জন্য বুটজোড়া খুলে রাখেন ম্যারাডোনা। এরপর স্থূলতা-জনিত নানা জটিলতা তৈরী হতে থাকে তার শরীরে। ২০০৫ সালে গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারি করতে হয়। এর বছর দুয়েক পর হেপাটাইটিস ও অ্যালকোহলজনিত অসুস্থতা দেখা দেয় তার। যার চিকিৎসা হয় বুয়েন্স আয়ার্সের এক হাসপাতালে।

ডিসচার্জ হবার দুই দিন পর তিনি ফের হাসপাতালে ভর্তি হলে তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তাকে মানসিক ইউনিটেও যেতে হয় অ্যালকোহলজনিত কারণে। হাসপাতাল ছাড়ার সময় ম্যারাডোনা জানান, ‘আমি পান করা ছেড়ে দিয়েছি। গত আড়াই বছর ধরে ড্রাগও নিচ্ছি না।’

ম্যারাডোনার সুযোগ ছিল নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। যদি নিজেকে সামলাতে পারতেন। নব্বই দশক থেকে কোকেন, অ্যাল‌কোহল ও স্থূলতা সমস্যা জড়িয়ে অসময়ে সমাপ্তি ঘটে তার ক্যারিয়ারের। এত প্রতিবন্ধকতার পরও তিনি যা করেছেন তা অনন্য। তিনি আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন। কেঁদেছেন ভক্ত – দর্শকের সামনে। বারবার ফিরে এসেছেন। চেষ্টা করেছেন সর্বোচ্চ। ম্যারাডোনার ভাষ্যে, ‘আমি ম্যারাডোনা। যে গোল করে, ভুলও করে। আমি সব নিতে পারি। সবার সাথে লড়বার জন্য আমার কাঁধ যথেষ্ঠ বড়।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link