More

Social Media

Light
Dark

অ্যাডিলেড টেস্ট, ১৯৯৩: স্নায়ুচাপের চূড়ান্ত পরীক্ষা!

১৯৯২-৯৩ সালের ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফির প্রথম টেস্ট শেষ হয় টানটান উত্তেজনায়। ব্রিসবেনে হারতে হারতে কোনমতে ড্র করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মেলবোর্নে পরের টেস্টটা ১৩৯ রানে জিতে নেয় স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। রানে ভরপুর সিডনি টেস্ট হয়েছিল ড্র। ১-০ তে পিছিয়ে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাই সিরিজ জিততে হলে পরের দুটি টেস্টে জিততেই হত।

১৯৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি। অ্যাডিলেডে শুরু হওয়া সিরিজের চতুর্থ টেস্টে অ্যালান বোর্ডারের সাথে টস করতে নামলেন রিচি রিচার্ডসন। টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন রিচি। শুরুটা অবশ্য দারুণ হয়েছিল। ডেসমন্ড হেইন্স আর ফিল সিমন্সের উদ্বোধনী জুটিতে আসে ৮৪ রান। তবে অল্প সময়ের ব্যবধানে দুই ওপেনারই ফিরে যান সাজঘরে। তারপর থেকেই নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে তারা।

২৩ বছরের ‘তরুণ’ ব্রায়ান লারার ৫২ আর উইকেটকিপার জুনিয়র মারের অপরাজিত ৪৯ রানের সৌজন্যে প্রথম ইনিংস শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৫২। ৬৪ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে দিনের সেরা বোলার বিখ্যাত স্লেজিং শিল্পী মার্ভ হিউজ। ‘ওয়াহ’ ভাইয়েরা নেন একটি করে উইকেট। অফ স্পিনার টিম মে’র শিকার ছিল ২ উইকেট।

ads

কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ আর ইয়ান বিশপের মত দীর্ঘদেহী, গতিময় ফাস্ট বোলারের সঙ্গে উদীয়মান কেনি বেঞ্জামিনে গড়া ক্যারিবীয় পেস আক্রমণ ছিল দুর্ধর্ষ। ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতেই তাই উইন্ডিজ সিমারদের আগ্রাসী কিন্তু নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের সামনে খেই হারিয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। মাত্র এক রানেই ফিরে যান ওপেনার মার্ক টেলর। আর ব্যক্তিগত ১৬ রানে ওয়ালশের বাউন্সারে মাথায় আঘাত পেয়ে আহত হন আরেক ওপেনার ডেভিড বুন।

তারপর দলীয় ৪৮ রানের মাথায় ‘অভিষিক্ত’ জাস্টিন ল্যাঙ্গারও (২০) আউট হয়ে গেলে দ্রুত ভেঙে পড়ে স্বাগতিকদের ইনিংস। স্টিভ ওয়াহর ৪২ আর আট নম্বরে নামা মার্ভ হিউজের ৪৩ রানের সৌজন্যে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ২১৩ রান। কার্টলি অ্যামব্রোস একাই নেন ছয় উইকেট।

৩৯ রানে এগিয়ে থেকেও অবশ্য দ্বিতীয় ইনিংসে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি ক্যারিবীয়রা। শুরুটা ভাল হলেও মাত্র ২২ রানে শেষ ৬ উইকেট হারিয়ে ১৪৬ রানেই থেমে যেতে হয় তাদের। সর্বোচ্চ ৭২ রান আসে অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসনের ব্যাট থেকে। তাঁর মূল্যবান উইকেটটি নিয়েছিলেন ব্লন্ড চুলের সুদর্শন, তরুণ লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন।

তবে আসল ধসটা নামিয়েছিলেন অফ স্পিনার টিম মে। ৬.৫ ওভারের প্রলয়ঙ্করী এক স্পেলে মাত্র ৯ রান খরচায় তুলে নেন পাঁচ উইকেট।

চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট দাঁড়ায় ১৮৬। তবে শুরুতেই তাদের সইতে হয় জোড়া আঘাত। কেনি বেঞ্জামিন আর কার্টলি অ্যামব্রোসের তোপে মাত্র ১৬ রান তুলতেই হারায় দুই ওপেনারকে। তবে ‘নাম্বার থ্রি’ জাস্টিন ল্যাঙ্গার আর চারে নামা মার্ক ওয়াহর দৃঢ়তায় প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় তারা।

দলীয় ৫৪ রানের মাথায় মার্ক ওয়াহকে (২৬) আউট করে উইন্ডিজকে ম্যাচে ফেরান কোর্টনি ওয়ালশ। তারপর হঠাৎ করেই যেন ভোজবাজির মত পাল্টে যেতে থাকে স্কোরবোর্ডের চেহারা! দুই প্রান্ত থেকে অ্যামব্রোস-ওয়ালশ জুটির যৌথ আক্রমণের শিকার হয়ে একে একে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান স্টিভ ওয়াহ (৪), অ্যালান বোর্ডার (১), ইয়ান হিলি (০) আর মার্ভ হিউজ (১)। ৫৪/২ থেকে মুহূর্তের ব্যবধানে স্কোর ৭৪/৭!

জয়ের জন্য তখনো প্রয়োজন ১১২ রান। এদিকে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস যেন রীতিমত একটা ধ্বংসস্তূপ! সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে দলকে টেনে তোলার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেন জাস্টিন ল্যাঙ্গার। অষ্টম উইকেট জুটিতে ওয়ার্নকে সাথে নিয়ে যোগ করেন আরও ২৮ রান। বিশপের বলে এলবিডব্লু হয়ে ফিরে যাবার আগে ওয়ার্নের উইলো থেকে আসে নয় রান।

চতুর্থ দিন চা বিরতির খানিক আগে দলীয় ১০২ রানের মাথায় যখন অষ্টম উইকেটের পতন ঘটল, ম্যাচ জিততে তখনও লাগে ৮৪ রান। একমাত্র স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবে টিকে আছেন কেবল ডেব্যুট্যান্ট জাস্টিন ল্যাঙ্গার। দুই ‘টেইলএন্ডার’কে নিয়ে আর কতদূরই বা যেতে পারবেন তিনি!

বল হাতে সফল অফ স্পিনার টিম মে’র ব্যাটিংয়ের হাতটা নেহায়েত মন্দ ছিল না। ১০ নম্বরে নেমে ফার্স্ট ক্লাস সেঞ্চুরিও নাকি আছে তাঁর! নিজের ‘জন্মদিন’ বলেই কিনা সেদিন শুরু থেকেই মে ছিলেন দারুণ আত্মবিশ্বাসী। রানের খাতা খুললেন ইয়ান বিশপকে দর্শনীয় এক কাভার ড্রাইভে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে! সেই আত্মবিশ্বাস থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই কিনা চা বিরতির সময় চা খেতে খেতে সতীর্থ ল্যাঙ্গারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘Yeah, mate, we’re gonna make a good fist of this.’

টিম মেকে সাথে নিয়ে বিকেলের সেশনে লড়াইটা আরও এক দফা জমিয়ে তোলেন ল্যাঙ্গার। দুজনের যুগলবন্দীতে স্কোরবোর্ডে জমা পড়ে মূল্যবান ৪২টি রান। ১৪৬ বলে ৫৪ রানের লড়াকু ইনিংস খেলে ল্যাঙ্গার যখন বিশপের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হন, লক্ষ্য থেকে তখনো তারা ৪২ রান দূরে। নাহ! আর বুঝি শেষ রক্ষা হল না!

ম্যাচটা তখন সম্পূর্ণভাবে হেলে পড়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে। একেবারেই ‘অলৌকিক’ কিছু না ঘটলে জয় তাদের সুনিশ্চিত। কিন্তু প্রতিপক্ষ দলটির নাম যখন অস্ট্রেলিয়া, তখন খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফল নিয়ে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী না করাই ভাল!

যারা ভেবেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে গেছে তাদের সবার চোখ কপালে তুলে দিয়ে ‘শেষ’ দুই ব্যাটসম্যান ক্রিজে কাটিয়ে দিলেন প্রায় দেড় ঘন্টা! তবে সময় কাটানোর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল রান করা। সেটাও আসতে থাকে স্বাভাবিক গতিতেই।

শুরুতে অতি সাবধানী ব্যাটিং করা টিম মে সময়ের সাথে হয়ে উঠতে লাগলেন আরও আত্মবিশ্বাসী। শুধু উইকেটে টিকে থাকার সংগ্রামে নয়; তিনি মনোযোগ দিলেন রান বাড়ানোর দিকেও। ওদিকে আস্থার প্রতিদান দিয়ে চলেছেন ‘নাম্বার ইলেভেন’ ক্রেইগ ম্যাকডারমটও।

‘এটা অস্ট্রেলিয়ার দিন, আমার জন্মদিন। অবশ্যই, আমরাই জিতবো’ –  মনে মনে এটা বলে বারবার নিজেকে অভয় দিচ্ছিলেন মে।

ম্যাকডারমট-মে জুটির দৃঢ়তায় অজি শিবির তখন ‘মিরাকলের’ স্বপ্ন দেখছে। জুটি বড় হতে দেখে রিচি রিচার্ডসনের কপালে চিন্তার ভাঁজটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। এমন জটিল পরিস্থিতিতে কী করবেন কিছুতেই যেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবে কি নিশ্চিত জেতা ম্যাচটা হাতছাড়া হয়ে যাবে?

ইনিংসের ৭৯তম ওভারের খেলা শেষ। টিম মে-ক্রেইগ ম্যাকডারমট জুটি ইতিমধ্যেই তুলে ফেলেছে ৩৯ রান। দলীয় স্কোর ১৮৩/৯। জিততে হলে ৩ আর টাই করতে লাগে ২ রান। কে জিতবে? ওয়েস্ট ইন্ডিজ নাকি অস্ট্রেলিয়া? নাকি আরও একটি ঐতিহাসিক ‘টাই’য়ের মধ্য দিয়ে জয় হবে ক্রিকেটের?

৮০ তম ওভারের খেলা শুরু। বল হাতে প্রস্তুত কোর্টনি ওয়ালশ। স্ট্রাইকে আছেন ৪১ রানে অপরাজিত ‘বার্থডে বয়’ টিম মে। প্রথম দুই বল থেকে কোন রানই আসল না। তৃতীয় বলটা ছিল অফ স্টাম্পের ওপর কিছুটা শর্ট অফ আ গুড লেন্থের। ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে পুশ করেই এক রানের জন্য প্রান্তবদল করলেন দুই ব্যাটসম্যান।

একটি রান বেড়ে স্কোর গিয়ে দাঁড়াল ১৮৪/৯। আর মাত্র ২ রান। ৫৬ বল খেলে ১৮ রানে অপরাজিত ম্যাকডারমট আছেন স্ট্রাইকে; ওয়ালশের আগের ওভারেই যিনি অল্পের জন্য ক্যাচ হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন।

ওভারের চতুর্থ বল। ব্যাটসম্যানের শরীর তাক করে বাউন্সার দিলেন ওয়ালশ। হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা বাউন্সার সামলাতে গিয়ে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন ম্যাকডারমট। পড়িমরি করে পেছন দিকে ঘুরে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। শরীর বাঁচাতে পারলেও নিজের মূল্যবান উইকেটটা বাঁচাতে পারলেন কি? বল তাঁর গ্লাভস ছুঁয়ে সরাসরি চলে গেল উইকেট রক্ষক জুনিওর মারের হাতে!

আসলে বলটা ম্যাকডারমটের গ্লাভসে নাকি হেলমেটে লেগেছিল, টিভিতে রিপ্লে দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না কিছুই। যাই হোক, বলটি ধরার সাথে সাথেই কট বিহাইন্ডের জোরালো আবেদনে সমস্বরে গর্জে উঠলেন ফিল্ডাররা। ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন আম্পায়ার ড্যারিল হেয়ার। ইউ আর আউট!

এই আউটের মধ্য দিয়েই পরিসমাপ্তি ঘটল উত্তেজনায় ঠাসা রোমাঞ্চকর এক থ্রিলারের। ৯৯ বল খেলে ৪২ রানে অপরাজিত ব্যাটসম্যান টিম মে’র চোখেমুখে তখন রাজ্যের হতাশা। নিজের জন্মদিনে দলের জন্য এর চাইতে বেশি আর কি কিইবা করতে পারতেন তিনি?

এদিকে, মাত্র এক রানের অভাবনীয় জয়ে বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে উঠেছে ক্যারিবিয়ান শিবির। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে সবাই। ‘শেষ মুহূর্তের নায়ক’ ওয়ালশকে ঘিরে শুরু হয়েছে বিজয় উৎসব।

১৯৯৩ সালের ২৬ জানুয়ারি, টেস্ট ক্রিকেটের ‘ন্যূনতম’ ব্যবধান এক রানে জিতে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এখনও পর্যন্ত ১ রানে জয় পরাজয় নির্ধারিত হওয়া একমাত্র টেস্ট ম্যাচও এটাই।

ঐতিহাসিক এই জয় থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে পার্থে অনুষ্ঠিত সিরিজের শেষ টেস্টে স্বাগতিকদের ইনিংস ও ২৫ রানে হারিয়ে সিরিজটাও বাগিয়ে নিয়েছিল ক্যারিবীয়রা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link