More

Social Media

Light
Dark

কণ্টকশয্যার জীবন তাঁর

নিউজিল্যান্ডের প্রথম বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্ট জয়ের নায়ক ক্রিস কেয়ার্নস। কেন উইলিয়ামসন, রস টেইলরদের আগমনের অনেক আগেই কিউইদের তিনি এনে দিয়েছিলেন আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা। কিন্তু কেয়ার্নসের ক্রিকেট পরবর্তী জীবন সবাইকে শিক্ষা দেয় মানবজীবন কতটা অনিশ্চিত হতে পারে।

তিনি নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক যিনি এখন স্টারডমের অনেক অনেক বাইরে, স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ উঠে যার জীবনের সম্মান একবার নিলামে ওঠে। সেখানেই শেষ নয়, তিনি নতুন জীবনের সন্ধানে নিজের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, ভাড়া করা একটা বাসায় থাকা শুরু করেন। জীবন তাঁকে আরো বড় পরীক্ষায় ফেলে। বিরাট একটা ধাক্কা আসে। হার্ট অ্যাটাক হয়, লাইফ সাপোর্টে থাকেন কয়েকটা দিন। এখন বিপদ কেটে গেছে, তবে তিনি প্যারালাইজ।

  • আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সেরা সময়

১৯৮৯ থেকে ২০০৬ এই সতের বছর কেয়ার্নস ছিলেন সাফল্যের চূড়ায়। নিউজিল্যান্ড তো বটেই ছিলেন পুরো বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। এই সময়ে কিউইদের হয়ে ৬২ টেস্টের পাশাপাশি খেলেছেন ২১৫টি একদিনের ম্যাচ। এমনকি দলটির অধিনায়কত্বও করেছেন।

ads

স্যার রিচার্ড হ্যাডলি এবং ড্যানিয়েল ভেট্টোরির পর নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের সেরা টেস্ট ক্রিকেটের হিসেবে গণ্য করা হয় তাকে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও কেয়ার্নস ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে তার করা অপরাজিত ১০২ রানের ইনিংস ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ইনিংস।

  • অবসর এবং অধ:পতন

মাঠে দুর্দান্ত ফর্ম থাকলেও ইনজুরির কারণে ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান কেয়ার্নস। তিন দশকে ইনজুরির কারণেই কেবল ৫৫ টেস্ট মিস করেন তিনি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরের বছরই নিষিদ্ধ ক্রিকেট আসর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) নাম লেখান তিনি। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে যতটা সম্মান-শ্রদ্ধা কুড়িয়েছিলেন তিনি, এই টুর্নামেন্টে অংশ নেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাতে যেন তিনি নিজেই কালিমা লেপন করেন।

পুরো ক্রিকেটবিশ্ব হতবাক হয়ে গিয়েছিল তার এই সিদ্ধান্তে। ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে বোমা ফাটানোর মতো অভিযোগ করেন আইপিএলের সাবেক চেয়ারম্যান ললিত মোদি। স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন চন্ডীগড়ে এক ম্যাচে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সাথে জড়িত ছিলেন কেয়ার্নস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে মোদির এই বক্তব্য পুরো ক্রিকেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় নেয়নি।

ফলশ্রুতিতে স্পন্সররা তাঁর সাথে চুক্তি বাতিল করে, ধারাভাষ্যকারের চাকরি চলে যায়। কেয়ার্নসের জীবনে নেমে আসে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ঘোর অমানিশা। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে কেয়ার্নসকে এক পর্যায়ে বাস স্টেশনে ক্লিনারের কাজ নিতে হয় পরিবারের ভরণপোষণের জন্য।

তাঁর স্ত্রী মেলানি ক্রসার বলছিলেন, ‘ও হাতে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিল না। আমাদের নিজেদের বাড়ি ছিল না। বাসা ভাড়াসহ অন্যান্য বিল প্রদান করতে হতো। অনেক পরিশ্রমের পরই কেবল টাকাটা জোগাড় করা সম্ভব হতো।’

  • স্পট ফিক্সিং এবং ক্ষণিকের সুখ

চাকরিবিহীন, সহায়সম্বলহীন, কপর্দকশূন্য কেয়ার্নস একপর্যায়ে ২০১২ সালে ব্রিটিশ কোর্টে মোদির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন এবং মামলাটি তিনি জিতে যান। তার ক্ষতির জন্য ৯০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ পান তিনি। ‘আজকের রায় আমাদের জীবনের কালো মেঘকে সরিয়ে দিয়েছে। অনেক নির্ভার লাগছে, এখন থেকে আমি বিশ্বের যেকোনো স্টেডিয়ামে আবারো মাথা উঁচু করে ঢুকতে পারবো’, রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমে এভাবেই বলছিলেন কেয়ার্নস।

কিন্তু, কেয়ার্নসের স্বল্প সময়ের সুখ বেশিদিন টেকেনি। একবছর পর আইসিসির অ্যান্টি করাপশন এন্ড সিকিউরিটি ইউনিট আকসু তার বিরুদ্ধে স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ আনে। এবারে আরো জোড়ালো প্রমাণ সাথে নিয়ে। সাবেক কিউই ক্রিকেটার লু ভিনসেন্ট স্বয়ং সাক্ষী দেন। তিনি জানান কেয়ার্নসের নির্দেশেই চন্ডীগড় লায়ন্সের সেই ম্যাচে তিনি স্পট ফিক্সিংয়ে অংশ নেন।

ভিনসেন্টের সাবেক স্ত্রীকেও আদালতে আনা হয়, তিনিও কেয়ার্নসের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। তিনি বলেন কেয়ার্নস তাকে এই কাজে সাহস এবং উৎসাহ দেন এই বলে ভারতে স্পট ফিক্সিং হরহামেশাই ঘটে। তবে সবচেয়ে বড় বোমাটা ফাটে এর কয়েকদিন পরে। সাবেক কিউই অধিনায়ক এবং কিংবদন্তী ব্রেন্ডন ম্যাককালাম স্বয়ং জানান ২০০৮ সালে কেয়ার্নস তাকে স্পট ফিক্সিংয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

যদিও কেয়ার্নস এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার ভাষ্যমতে ভিনসেন্ট নিজে দোষী সাব্যস্ত হবার আইসিসির গুডবুকে নাম তোলার জন্য তাকে ফাঁসাচ্ছেন। এবং তার স্ত্রী সেই কথোপকথনের রাতে মাতাল অবস্থায় ছিল। অন্যদিকে ম্যাককালাম যদি ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েই থাকেব তবে আইসিসিকে এতদিন পরে সেটা জানালেনই বা কেন? স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় রায়টিও কেয়ার্নসের পক্ষেই আসে।

কিন্তু, তিনি যে মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন দ্বিতীয় মামলা চলাকালীন সময়ে সেখান থেকে আর কখনো বেরোতে পারেননি। আদালতের বাইরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সম্মানের দিক থেকে আমি পুরোপুরি নি:শেষ হয়ে গিয়েছি।’

  • নতুন শুরুর আশায় মাতৃভূমি ত্যাগ

২০১৮ সালে নতুন করে জীবন সাজানোর আশাত কেয়ার্নস পরিবারের সাথে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় চলে আসেন। সেখানে এসে খেলাধুলা বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর এক স্টার্টাপ শুরু করেন তিনি। কিন্তু আরো একবার ধাক্কা খান তিনি। এবারে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যান তিনি। বেশ কয়েকদিন ছিলেন আইসিইউতে। এক সময় পরিবারের সবার সাথে কথা বলতে পারছিলেন। তবে, শেষ খবর হল তিনি প্যারালাইজড হয়ে গেছেন।

অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক যে ক্যারিয়ার শেষ হবার পর থেকে কেয়ার্নসের সাথে কেবল বাজে ঘটনাই ঘটেছে। তবে আমি কেবল তার সাথে আমার সুখের স্মৃতিগুলোই স্মরণ করি। আমি আশা করি সে আবার সুস্থ হয়ে উঠবে এবং এবারে ভাগ্যকে পাশে পাবে।’

আসলে এই চাওয়াটা কেবল অ্যালান বোর্ডারের নয়, পুরো ক্রিকেটদুনিয়ারই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link