More

Social Media

Light
Dark

সুদীপ্ত সূর্য বাভুমা

আজ থেকে পনেরো বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান? ঠিক এমন একটা প্রশ্নের জবাবে একজন ১১ বছরের ক্ষুদে শিক্ষার্থী হয়ত বলবে সে ডাক্তার হবে কিংবা ইঞ্জিনিয়ার অথবা তার একটা বাড়ি হবে এবং অনেক গুলো গাড়ি। ২০০১ সালে এমন এক প্রশ্নের উপর দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনের স্বনামধন্য বিদ্যালয় দক্ষিণ আফ্রিকান কলেজ স্কুল তাদের শিক্ষার্থীদের এমন প্রশ্ন করে বলেছিলেন একখানা রচনা লিখতে।

১১ বছর বয়সী ক্লাস সিক্সে পড়া এক শিক্ষার্থীর লেখা এতটাই মুগ্ধ করেছিলো সকলকে যে তা পরবর্তীতে স্থান পেয়েছিলো স্কুল ম্যাগাজিনে। ‘আমি ১৫ বছর পর নিজেকে দেখি নিজের স্যুটটি পড়ে প্রেসিডেন্ট এমবেকির সাথে করমর্দন করতে। সে আমাকে অভিবাদন জানাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলকে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছি বলে।’ এমনটাই লিখেছিলেন প্রোটিয়াদের বর্তমান সাদা বলের ক্রিকেটের অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা।

ক্ষুদে বাভুমা আরো লিখেছিলেন, ‘যদি আমি তা করতে পারি তবে আমি অবশ্য আমার কোচ ও আমার বাবা-মাকে ধন্যবাদ জানাবো তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্যে। আরো ধন্যবাদ জানাবো আমার দুই আংকেলকে যারা কিনা আমাকে একজন প্রোটিয়া হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।’

ads

এসব কিছু একজন বাচ্চার নেহাৎ স্বপ্নে বিভোর হওয়া দিনের প্রতিফলন হিসেবেই উড়িয়ে দেওয়া যেতো। কিন্তু সেই রচনা লেখার ঠিক ১৫ বছর বাদে বাভুমা প্রথম কৃষাঙ্গ প্রোটিয়া হিসেবে টেস্টে শতক তুলে নেন ২০১৬ সালে আর প্রমাণ করেন তিনি যা লিখেছিলেন তা স্রেফ স্বপ্নের বিলাপ ছিলোনা। যদিও ততদিনে সভাপতি থাম্বা এমবেকির শাসনামলের সমাপ্তি ঘটেছে।

বাভুমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বর্ণবাদের ভয়াল থাবা থেকে সেড়ে ওঠতে শুরু করা দক্ষিণ আফ্রিকায় বাভুমা নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন তো করেছেনই সেই সাথে তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হিসেবে প্রোটিয়া ক্রিকেটকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি হয়ত জেনে অথবা না জেনেই শোষিত এক জনগোষ্ঠীকে নতুন এক দিনের আলো দেখাচ্ছেন।

কারণ বাভুমা কেবল ১৬টি ওয়ানডে ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার মাঝেই বিশাল এক কাণ্ড করে বসেছেন। নিজের শান্ত, দৃঢ় ব্যাটিং এর পাশাপাশি স্বতস্ফূর্ত মাঠজুড়ে বিচরণে ভারতের মতো দলের বিপক্ষে তুলে নিয়েছে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়। যেই দলে কিনা ছিলেন বিরাট কোহলি, লোকেশ রাহুল, জাসপ্রিত বুমরাহদের মতো অভিজ্ঞ বিশ্বক্রিকেট দাপানো খেলোয়াড়েরা। টেম্বা বাভুমার নেতৃত্বেই তো ভারত হয়েছে ওয়াইট ওয়াশ।

শুধু কি ঠিক করে দেওয়া কে কখন কোন কাজটা করবে কিংবা ফিল্ডিং সাজিয়ে দেওয়ার মতো দায়িত্ব পালনেই খালাস বাভুমা? না। অন্তত দলের মিডিয়া ম্যানেজার সিপোকাজি সোকানইলে মতে তো না। তিনি মনে করেন বাভুমা দলের ভেতর একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছেন।

সিপোকাজি আরো বলেন, ‘টেম্বা একজন সত্যিকারের দলনেতা এবং সে যে কাজটা করতে পারবে না সেটা সে আরেকজনকে করতেও বলেন না। সে দলের সাথে সংযুক্ত সকলের জন্যে একটা উঁচু স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দিয়েছেন। আমাদের দলে মধ্যে এখন গ্রহণযোগ্যতা ও দলের একজন হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সুন্দর একটি সংস্কৃতি রয়েছে। এখন একটি ম্যাচ খেলা খেলোয়াড় চার মৌসুম খেলা খেলোয়াড় উভয়ই সমান গুরুত্ব পায়।’

এতে খানিকটা আন্দাজ করে নেওয়া যায় টেম্বা বাভুমা দলনেতা হিসেবে ঠিক কেমন করছেন। তাছাড়া নিজের শেকড়টা ভুলে যাননি বামুভা তা বোঝা যায় ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়ের পর তাঁর দেওয়া বক্তব্য। সেখানে বাভুমা বলেন, ‘একটা দলকে নেতৃত্ব দেওয়া খুব একটা সহজ নয়। আপনাকে অনেক গুলো বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। তবে আমার প্রধান কাজ ছিল দলের প্রত্যেকটি খেলোয়াড়দের মাঝে খেলোয়াড়ী মনোভাবের বিস্তার ঘটানো এবং তা বজায় রাখা।’ একটি সিরিজ জয়ে একেবারে ‘মুই কি হনু রে’ মনোভাব পোষণ করা খেলোয়াড় তো কম দেখেনি বিশ্বক্রিকেট। সেদিক থেকেও মাটির খুব কাছাকাছি থাকতে চান বাভুমা।

তাছাড়া সিপোকাজি আরো বলেন, ‘টেম্বা এবং ডিন দলের মধ্যে নতুন কালচার তৈরি করেছেন। যেখানে সবাই নিজেদের মতামত অনায়াসে প্রকাশ করতে পারে।’

একেবারে নিষ্পেষিত ল্যাঙ্গা নামক জায়গা থেকে উঠে আসা টেম্বা বাভুমার কাছে তো এটাই প্রত্যাশিত। বাভুমা তো আসলে বোঝেন কথা বলতে না পারার কষ্ট, নিজের প্রয়োজনটা চাইতে না পারার বেদনা। কেননা এই ল্যাঙ্গা তো ছিলো বর্ণবাদের সবচেয়ে ভয়াল দিনের সাক্ষী। নিচুস্তরের কৃষাঙ্গ আবাস বলেই তো বিবেচিত হতো ল্যাঙ্গা। অথচ বাংলায় এই শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘সূর্য’।

আর অন্যের মতকে সম্মান দেওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত তো বাভুমা দেখিয়েছিলেন গেলো বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে৷ কুইন্টন ডি কক বিতর্কে বাভুমা সম্মান দেখিয়েছিলেন তাঁকে। ডি ককের বিপক্ষে কথা বলার পরিবর্তে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাকে কুইন্টনের নেওয়া সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতেই হবে। আপনি সেটা পক্ষে হোন কিংবা বিপক্ষে।’

এখানেই বাভুমা নিজের সু-উচ্চ মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন৷

সেই যাই হোক বাভুমার কষ্টের দিন ঘুচেছে। হয়ত আরো নিষ্পেষিত মানুষের কষ্ট ঘুচবে। তাঁর দেখানো পথ দেখে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট দল থেকে শুরু করে সকল খেলায় শোষিত জনগোষ্ঠী প্রতিনিধিত্ব করবে। তবে সে জন্যে একজন খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করে যেতে হবে ব্যাটার টেম্বা বাভুমাকে।

অনেকে হয়ত ৪৮ টেস্টে বাভুমার একটি মাত্র শতক দেখে নাক সিঁটাকাবে। কিন্তু বাভুমার একেকটি ৪০ কিংবা ৫০ রানের মাহাত্ম্য কেউ তলিয়ে দেখবে না। বাঘাবাঘা বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে নিজের দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে বাভুমা ঠিকই ক্রিকেটের ইতিহাসে নিজের ছাপটুকু ফেলে যাচ্ছেন।

আর প্রোটিয়া হয়েও স্পিন বোলিং খেলার তাঁর দক্ষতা সত্যিই অবাক করার মতো। সেক্ষেত্রে তাঁর শৈশব-কৈশরে রাস্তায় ক্রিকেট খেলা কৃতিত্ব পেতে পারে। কেননা এবড়োখেবড়ো রাস্তাকে যে তাঁরা করাচির স্পিনিং ট্র‍্যাক ভেবেই খেলেছেন ক্রিকেট। সুতরাং খেলোয়াড় বাভুমাও যথেষ্ট তরুণদের নতুন দিনের আলোর পথে অগ্রসরে অনুপ্রাণিত করতে।

ল্যাঙ্গা কিংবা সূর্য হয়ে টেম্বা বাভুমা সদা দৃপ্তমান থাকুক দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটে। আর তাঁর বিস্তৃত আলোতে আলোকিত হোক শোষিত প্রতিটি জনপদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link