More

Social Media

Light
Dark

ব্রাজিল ডাগআউটে এখনই কি বিদেশি কোচ প্রয়োজন?

ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে কোনো অ-ব্রাজিলিয়ান নয়— কোচ নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এটাই যেন অলিখিত নিয়ম লাতিন আমেরিকার ফুটবল ভূ-স্বর্গের দেশটিতে। তবে সময়ের ব্যবধানে এবার সীমান্তের বাইরে চোখ রাখতেই হচ্ছে। টানা দুই দশকের বিশ্বকাপ খরার নিমিত্তে এবার ব্রাজিলের ডাগআউটে ভিনদেশী কোচের দেখা মিলতেই পারে।

অন্তত ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশন (সিবিএফ) সভাপতি এদনালদো রদ্রিগেজের ভাষ্যে সেই প্রথা ভাঙার সুরই প্রকাশ পেয়েছে। বিদেশী কোচদের জন্য এখন আর ব্রাজিলের দুয়ার বন্ধ নেই। আর চলমান বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ব্রাজিলের পারফরম্যান্সও সন্তোষজনক নয়।

কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়ার পর কোচের পদ ছেড়ে দেন তিতে। সিবিএফের সঙ্গে কাতার বিশ্বকাপ পর্যন্তই চুক্তি ছিল তিতের। অবশ্য বিশ্বকাপে তিতের ট্যাক্টিস নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। তাই তাঁর সাথে চুক্তি নবায়ন করার ভাবনার কথা সিবিএফের কাছ থেকে কখনোই শোনা যায়নি। তিতেও তাই সরে দাঁড়িয়েছিলেন ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হারার পরই।

ads

কিন্তু এখনও তিতের শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি সিবিএফ। অবশ্য এ সময়ের মধ্যে সিবিএফের তরফ থেকে বিদেশি কোচ নিয়োগের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখা গিয়েছে। তাদের আগ্রহের তালিকায় ছিলেন, জিনেদিন জিদান, কার্লো আনচেলত্তি, লুই এনরিকে ও হোসে মরিনহো।

জিনেদিন জিদান এই মুহূর্তে কোনো দলের দায়িত্ব নেই। আবার কার্লো আনচেলত্তি আগামী মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ ডাগআউট ছাড়ছেন। কিন্তু বাকি দুজন এনরিকে আর মরিনহো — এখনও ক্লাব ক্যারিয়ারে মনোনিবেশ করতে চান। কাতার বিশ্বকাপে স্পেনের কোচের দায়িত্ব পালন করা এনরিকে তো ইংলিশ ক্লাব চেলসির কোচ হওয়ার ব্যাপারে এখনও রয়েছেন ফেবারিট তালিকায়। আর মরিনহো সামলাচ্ছেন ইতালিয়ান এএস রোমাকে।

সর্বশেষ তথ্য জানাচ্ছে, এই মুহূর্তে কার্লো আনচেলত্তিই সেলেসাওদের কোচ হওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে  এগিয়ে আছেন। তবে কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। তাই গুঞ্জনেই আটকে আছে ব্রাজিলের কোচ হিসেবে আনচেলত্তির যাত্রার সম্ভাব্যতা।

ব্রাজিলিয়ান কোচ লুই ফেলিপে স্কলারির অধীনে সর্বশেষ ২০০২ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিল। স্কলারির পর থেকে তিতে পর্যন্ত মোট ৮ জন ব্রাজিলিয়ান কোচ নিয়োগ দিয়েছে সিবিএফ। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের ক্ষেত্রে এ ৮ ম্যানেজারের ফলই শূন্য। আর এ শূন্যতায় ভাবিয়েছে ব্রাজিলকে। তাই নিজ দেশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ব্রাজিল ফুটবল এবার কোচ নিয়োগের ব্যাপারে নজর দিয়েছে বাইরের বিশ্বে।

অবশ্য তিতে সরে দাঁড়ানোর পর ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবল থেকে জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার মতো বেশ কয়েকজন কোচের নাম উঠে এসেছিল। ফ্লুমিন্সের কোচ ফার্নান্দো দিনিজ দায়িত্ব পেলেও তিনি চূড়ান্ত সমাধান নয়। এছাড়া পালমেইরাসের কোচ আবেল ফেরেইরা, গ্রেমিও-র কোচ রেনাতো গাউচোর নাম আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কাউকেই মনে ধরেনি সিবিএফ-এর।

ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে বিদেশি কোচ যে কখনোই আসেনি, তা নয়। ১৯২৫ সালে সেলেসাওদের দায়িত্ব সামলেছেন উরুগুয়ের র‌্যামন প্লাতেরো। ১৯৪৪ সালে ব্রাজিলের দায়িত্বে ছিলেন পর্তুগালের জোর্জে গোমেজ দা লিমা। এমনকি আর্জেন্টাইন কোচের পাও পড়েছে ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলে। ১৯৬৫ সালে ব্রাজিলের কোচ হিসেবে কাজ করেছিলেন ফিলিপো নুনেজ।

তবে সে-ই ইতিহাসই শেষ। ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাস বলে, ব্রাজিলিয়ান ফুটবল দলের দায়িত্ব সিংহভাহ সময় সামলেছেন ব্রাজিলিয়ানরাই। অবশ্য ব্রাজিলের দেখানো পথেই এখন চলে থাকে বেশির ভাগ ফুটবল দল। বিশ্ব ফুটবলে বড় দল গুলো যে বরাবরই বিদেশি কোচ এড়িয়ে চলেছে। ইংল্যান্ড ছাড়া বিশ্বকাপজয়ী প্রত্যেকটা দলই নিজেদের কোচ দিয়েই কাজ চালিয়েছে। একটা সময় পর সেই ইংল্যান্ডও ইংলিশদের উপরেই আস্থা রেখেছে। গত প্রায় এক দশক ধরে ইংল্যান্ডের ডাগ আউট সামলে যাচ্ছে ইংলিশ কোচরাই।

পেপ গার্দিওলা কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, ম্যানচেস্টার সিটি কোচের দায়িত্ব ছাড়ার পর তিনি কোনো জাতীয় দলের দায়িত্ব নিতে চান। তিতের পরে তাই গার্দিওলাকেই ব্রাজিলের কোচ ভাবা হচ্ছিল। সেই সম্ভাবনা এঁকে ফেলেছিলেন অনেকেই। তবে স্প্যানিশ এ কোচ এখন আপাতত ম্যানসিটিকে নিয়েই থাকতে চান।

বিশ্বকাপের পর সিবিএফের তরফ থেকে জানা গিয়েছিল, ২০২৩-এর মার্চের আগেই ব্রাজিলের কোচের নাম ঘোষণা করা হবে। তবে, দিনিজকে আপাতত দায়িত্ব দিয়ে দায় সেরেছে সিবিএফ।। মূলত বিশ্বমানের কোচ দলে ভেড়াতেই সিবিএফের এই অপেক্ষা। অবশ্য সেই প্রক্রিয়ায় জটিলতাও রয়েছে অনেক।

কারণ ইউরোপের ক্লাবগুলোর চড়া বেতন ছেড়ে ব্রাজিলের খুব কম কোচই ব্রাজিলমুখো হবেন। এ ছাড়া ভাষাগত প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে প্রবলভাবে। একই ভাবে দীর্ঘ সময়ের প্রথা ভেঙ্গে ব্রাজিলের কোচ হিসেবে বিদেশি কেউ এসে মানিয়ে নিতে পারবেন কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। এ ছাড়া ব্রাজিল ফুটবলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কেমন হবে সেই চ্যালেঞ্জও থাকছে।

মূলত ব্রাজিল বরাবরই ভিন্ন এক ফুটবল সংস্কৃতির সাথে অভ্যস্ত। এখন সেই সংস্কৃতিতে বিদেশি কোচ কেমন হবে, তা নিয়ে কিছু শঙ্কা থাকেই। তবে এর বিপরীতেও আছে বিব্রতকর কিছু চিত্র। ফুটবলার তৈরির কারখানা ব্রাজিলকে বলা হলেও, সেই তুলনায় তারা বিশ্বমানের কোচের জন্ম দিতে পারেনি।  এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ১০ কোচের মধ্যে একজন ব্রাজিলিয়ানও নেই। আর সে কারণেই বিদেশি কোচ নিয়োগের ব্যাপারে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন বেশি আগ্রহী।

তবে ব্রাজিলের বেশিরভাগ মানুষ আবার একজন ব্রাজিলিয়ানকেই জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দেখতে চায়। গত ডিসেম্বরে এ নিয়ে চালানো এক জরিপে ৪৮ শতাংশ বিদেশি কোচ নিয়োগের বিপক্ষে ভোট দেন। আর ৪১ শতাংশ এর পক্ষে ভোট দেন। এটিই প্রমাণ করে, ব্রাজিলের মানুষ কতটা ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে নিজেদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন।

তবে ব্রাজিলের যে দুই দশক ধরে বিশ্বকাপ ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। বারবারই ইউরোপের দলগুলোর সামনে খেই হারিয়েছে। আর এ কারণেই ইউরোপিয়ান ফুটবল সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আছে – এমন একজনকেই ব্রাজিল জাতীয় দলের জন্য এই মুহূর্তে প্রয়োজন। তাতে ফুটবলীয় সংস্কৃতির কিছুটা রদবদল হলেও সেই পথেই হাঁটা উচিৎ।

সংস্কৃতি রক্ষার চেয়ে বরং বিশ্বকাপ দিয়ে পুরনো ইতিহাস পাল্টে বিশ্বজয়ের পথে হাঁটাই শ্রেয়। এখন দেখা যাক, সেই শ্রেয়তা অর্জনে ব্রাজিল ফুটবল সামনের সময়গুলোতে ঠিক কোন পথে হাঁটে। এর মধ্যে কার্লো আনচেলত্তি ব্রাজিলের দায়িত্ব পাবেন ২০২৪ সালে – এই গুঞ্জন যেন ক্রমেই প্রবল হচ্ছে। আপাতত না হয়, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link