More

Social Media

Light
Dark

বিজ্ঞান বলে, সেটার নাম হৃৎপিন্ড

১.

তখন সময়টা ২৫ মার্চ, ২০০৩। নামিবিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটায় ভয়ংকর চোট পেল বছর বাইশের এক দিল্লীবাসী বোলার।গোড়ালিটা পুরো ঘুরে গেছে। সবাই জানে পরের ইংল্যান্ড ম্যাচটায় নিশ্চিতভাবে খেলছেনা সে। কিন্তু সেবার ইংল্যান্ড ম্যাচের ৭২ ঘন্টা আগে থেকে গোড়ালির উপর দিনে ৩০-৪০ বার করে বরফ বোলাতে লাগল সে।

আর খেতে লাগল এক একটা পেইন-কিলার। সাক্ষী স্বয়ং যুবরাজ সিং। ম্যাচের দিন সে যখন বলল সে খেলার জন্য প্রস্তুত, টিম ম্যানেজমেন্ট খুব একটা রাজি হলোনা। যদি আবার চোট পায়। একেই তার বোলিং অ্যাকশন এমনই একপ্রকার যেখানে পুরো ওয়েটটা বডির ওপর নিমেষে পড়ে যায়। অনেক দোনামোনা চলছিল ম্যানেজমেন্টের ভিতর।চিন্তিত যখন অধিনায়ক, সেই দিল্লীবাসী এগিয়ে এল আস্তে আস্তে। তাঁর অধিনায়ককে বলল – ‘Captain, I will Run for You”।

ads

আর তারপর সেই ডারবানের সবুজ উদ্যানে যেটা ঘটেছিল, অতিবড়ো ক্রিকেটপ্রেমীও ভাবতে পারেনি যে এভাবে একজন তরুণ শেষ করে দেবে কলিংউড-নাসের হুসেইন-নাইট সমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইন আপকে। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সেই বিখ্যাত ২৩/৬ এর বোলিং ফিগারটা অনেকেরই জানা। কিন্তু হয়তো অজানা রয়ে গেল রোগা লিকলিকে এক শরীরের অজানা দিকগুলো। সেই ২৩/৬ এর পিছনে ছিল একটা অধিনায়কের বিশ্বাস আর এক দিল্লীবাসীর আশ্বাস। অধিনায়কের নাম সৌরভ গাঙ্গুলি আর বোলারের নাম আশিষ নেহরা।

২.

করাচিতে বসেছে ভারত পাকিস্তানের আসর। ভারতের পাহাড়প্রমাণ ৩৪৯ রানের `ম্যামথ-টোটাল’এর দিকে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে ইনজামাম উল হক নামের এক শান্ত দানব। ইনজি আউট হবার পর, পাক-নৌকা এগোতে থাকে মঈন খানের হাত ধরে। শেষ ওভারে দরকার ছিল ৯ রান।

সৌরভ এগিয়ে দিলেন আশিষ নেহরাকে। ওই ওভারে মাত্র তিনরান দিয়েছিলেন নেহরা, সাথে মঈন খানের উইকেট। অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন ম্যাচটা শারজার ফ্ল্যাশব্যাক হবে। কিন্তু সেদিন সৌরভ গাঙ্গুলির সামনে আদর্শ ডেথ বোলার হয়ে উঠেছিলেন নেহরা।

ডেথ বোলারের সংজ্ঞাটা অনেক কঠিন। এই যেমন ধরুন সাউথ আফ্রিকা। দলে তাজা তাজা বোলার-স্টেইন মরকেল। কিন্তু একজন আদর্শ ডেথ বোলার না থাকায় বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হল। রাবাডা আসার পর অবশ্য তাদের পটচিত্রের পরিবর্তন হয়েছে। তো আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় ভারতের অন্যতম ডেথ বোলার হিসাবে নেহেরার নামটা উচ্চারিত হতে কারোর জিভ বাধা দেবে না।

বিশেষত সেই সময়টায়, যখন পাকিস্তানের ব্যাটসম্যান লিস্টে ইনজি-মালিক-ইউসুফের মতো হেভিওয়েট। তার ওপর করাচির চাপ। ফিরোজ শাহ কোটলায় শেষ ম্যাচ খেলার পর একটি ইন্টারভিউতে তিনি বলেছিলেন, ‘Did whatever can do with my kind of body।’ সত্যি কত কিছুই না হতে পারত।

সুনীল গাভাস্কার অবধি বলেছিলেন, ১২ বার সার্জারিটা না হলে নেহরার নাম নিশ্চিতভাবে ওপরের দিকে থাকত। জাভাগাল শ্রীনাথ বলেছিলেন, ‘দুজন ক্রিকেটারের অবসরে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হয়েছি – শচীন টেন্ডুলকার আর আশিষ নেহেরা।”নিজে মজা করতে ভালোবাসতেন। কিন্তু অতিরিক্ত মজার কিছু বলতেন না।

খুব সাধারণ বিষয়গুলি এমনভাবে স্ট্রেট ফরোয়ার্ড বলতেন, সেটাই যেন মজার হয়ে উঠত। এই ধরুননা,তখন টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর বসলো বাংলাদেশে। স্যোশাল মিডিয়াতে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ মানেই বেশ শোরগোল, বিশেষত এখন। তো প্রেস কনফারেন্সে ধোনি পাঠালেন নেহরাকে। রিপোর্টার প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘What Will say about the battle on social media?’

বেশ গরমাগরম উত্তরের অপেক্ষায় থাকা সাংবাদিকদের নিরাশ করলেন নেহরা, ‘You are asking this to wrong person. I am still using old Nokia phones.’ -অনেকটা সহজ-অনেকটা সরল কিন্তু শুনতে বেশ মজার। শুনলে অবাক হবেন নোকিয়ার পর নেহেরার সরাসরি উন্নতি হয়েছিল আইফোন সেভেনে, কিন্তু সেই ফোনে আজও নেহরা মাত্র তিনটি জিনিস জানেন – হোয়াটসঅ্যাপ, লাল বাটন আর সবুজ বাটন।

আর হোয়াটসঅ্যাপটাও জোর করেই খোলা। চেন্নাইয়ের কোচ থাকাকালীন ফ্লেমিং জোর করে খুলে দিয়েছিলেন।দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কথা বলতেন বলে সৌরভ গাঙ্গুলি নাম দিয়েছিলেন – ‘পপেট’। অথচ কত কিছুই না লুকিয়ে থাকে সেই কথা বলার মধ্যে, দাঁত গুলোর উন্মুক্ত বহিপ্রকাশ ঘটানো হাসিটার মধ্যে। বারো বার অস্ত্রোপচার, মাত্র ২৫ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেট বিদায় জানানো – আরো কতই না কিছু।

২০১১ সেমিফাইনালে আঙুলের চোট পেয়ে ফাইনাল খেলা হয়নি, কিন্তু দলের সাথে মুম্বাই গিয়ে সেবার খেলোয়াড়দের তোয়ালে সরবরাহ থেকে জুস সরবরাহে সবার আগে থাকা নামটি হয়তো – আশিষ নেহরা। তখন ২০০৯ সাল। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি আর কোচ গ্যারি কার্স্টেন নেহরাকে একবার বলেছিলেন টেস্টে আবারো কামব্যাক করার কথা। কিন্তু নেহরা আর এগোতে চাননি।

যদিও সেই সময় রঞ্জিতে প্রায়ই নিয়মিত খেলছেন। পরে অবশ্য আফসোসও করেছেন, ‘I could have worked harder then as I was just 30. If I could do that I would play 30-40 more tests।’ সত্যি ‘৩০ বছর’ এর আগেও যিনি ‘জাস্ট’ বসান, তাঁর কলজেটা মাপতে তো হবেই। এইতো সেবার টুইটারে বেশ শোরগোল – ‘Who is the speediest left arm bowler’ এর প্রশ্নে ডিন জোন্স মজা করে নেহরার নাম বললেন, মজা আরেকধাপ বাড়িয়ে দেন মিশেল জনসন।

অথচ ৩৪ বছরে অবসর নিয়ে জনসন যখন বাড়িতে, তখন কোটলা – মোহালিতে বছর ৩৬ এর নেহরা ১৩৫-এ বল করে চলেছেন। স্কোরবোর্ডের পরিসংখ্যানটাই কি সবকিছু, কলজের পরিসংখ্যানটা নেবেন না? ব্যাট হাতেও একটা স্মৃতি আছে।ভারত তখন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১-৪ এ সিরিজে পিছিয়ে। শেষ ম্যাচে ২০১ রানের টার্গেটে শেবাগের সেঞ্চুরি সত্ত্বেও ভারত অজান্তেই ১৮৩-৩ থেকে ১৯৮-৯।

লেগ বাই-এ রান নিয়ে শ্রীনাথ ব্যাট দিয়েছিলেন নেহরাকে। আর নেহেরা পরের বলেই চার মেরে ম্যাচ জেতালেন। খুব ছোট্ট ঘটনা, কিন্তু কতই না তাৎপর্যপূর্ণ। দিল্লীর ছোট্ট বাড়ি থেকে শেবাগের স্কুটারের পিছনে বসে যে যাত্রাটা শুরু হয়েছিল, সেটার শেষ হয় ফিরোজ শাহ কোটলাতেই। মাঝখানে রয়ে গেছে অসংখ্যবার সার্জারি আর অসংখ্যবার কামব্যাক। অবসরের পর বেশ কয়েকটি ইন্টারভিউ লক্ষ্য করতাম।

ভাইরাল হওয়া দুটি প্লট নিয়ে বেশ কয়েকবারই প্রশ্ন করা হয় তাঁকে। প্রথমটি একটি ফটোগ্রাফ, যেখানে নেহরা হাত মেলাচ্ছেন কিশোর কোহলির সাথে, আর দ্বিতীয়টি ভিডিও ফুটেজ যেখানে নেহেরা ক্যাচ মিস করায় ক্ষুণ্ণ তরুণ নবাগত ধোনির উপর। দুটি প্রশ্ন আলাদা আলাদা জায়গায়, কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই নেহেরার উত্তরটা কমন ছিল – ‘It’s because of only them (Dhoni &Kohli).’ কারণ ওরা দ ‘জন পরে বিখ্যাত না হলে ছবি আর ভিডিও কোনোটাই ভাইরাল হতো না।

উত্তরটা কত সহজ। কত অগভীর। অথচ এটা স্বীকার করতে কত মহানেরই না মুখ আটকেছে। আর একটা কথা বলার ছিল।কলজের পরিসংখ্যানটার ভিতরে নেহেরার একটা চারপ্রকোষ্ঠের মাংসপেশি ছিল। বিজ্ঞান বলে, সেটার নাম নাকি ‘হৃৎপিন্ড’!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link