More

Social Media

Light
Dark

নিউজিল্যান্ডের সেই বাজে ছেলেটাই আজ ব্রিটিশ গ্রেট

জশ বাটলার যখন স্টাম্পটা ভেঙে লাফিয়ে উঠেছিলেন বিশ্বজয়ের আনন্দে, বেন স্টোকসের কী মনে পড়ছিল সেই মুহূর্তটায়?

মাত্র আগেই বছর তিনেক আগেই সেদিন ছিল এমনি এক শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনাল। হতাশা আর বিষ্ময়ের সংমিশ্রণ মিশ্রিত তাঁর চোখ যেন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থির হয়ে যাচ্ছিল কলকাতার খ্যাতনামা ইডেন গার্ডেন্সের গ্যালালিতে নেমে আসা বলটার দিকে, সমস্ত দুনিয়াটাই যেন আছড়ে পড়লো ওই ছক্কাটার সাথে। সংবিত ফিরল পিঠে অধিনায়কের হাত পড়ায়।

কোনরকমে শরীরটাকে টেনে টেনে চতুর্থ বলটা করলেন, আবারো ছক্কা! আর পারলেন না, বসে পড়লেন মাটির উপর। ইংলিশ সমর্থকদের শত দুয়ো, সতীর্থদের সান্তনা কোনকিছুই যেন স্পর্শ করছে না তাঁকে।

ads

ক’দিন ধরে প্রশংসার মধ্যে থাকা ব্রিটিশ মিডিয়া গভীর ঐ ক্ষততে নুনের ছিটা দিতে ভুলল না। তখনকার উদীয়মান অলরাউন্ডার, দলের অন্যতম সেরা পারফর্মার থেকে পরিণত হলেন ভিলেনে।

বিশ্বকাপ জিতেই হয়তো ব্রিটিশ পত্রিকাগুলোর শিরোনামে আনমনে চোখ বুলিয়েছেন। যে পত্রিকাগুলি সেই ‘ঘুষি কাণ্ড’ – এর পর তাঁকে ব্রিটিশজাতির লজ্জা আখ্যায়িত করছিল, সেই মিডিয়ার স্তুতি – বন্দনা নিশ্চয়ই তাঁর জেদি আগ্রাসী মুখায়বের আড়ালে বিলুপ্তপ্রায় মৃদুহাসিটা ফিরিয়ে এনেছিল।

ব্রিটিশদের ৪৪ বছরের আক্ষেপ যে শেষপর্যন্ত তাঁর হাতেই মিটল। কিন্তু নিজগৃহে সাদর অভ্যর্থনার প্রত্যাশাও তাঁর ছিল না সেদিন। আরো একবার ব্ল্যাকক্যাপদের ফাইনালের হতাশা বাড়িয়ে ইংরেজদের উপহার দিলেন অধরা বিশ্বকাপ, তিনি যে একজন জন্মগত কিউই!

বাবা – মা দুজনেই নিউজিল্যান্ডের মানুষ। বাবা নিউজিল্যান্ডের কট্টর সাপোর্টার, দেশের শ্রেষ্ঠত্বলাভে ছেলের বিজিত গোমড়ামুখ দেখতেও আপত্তি নেই তাঁর, যদিও পিতা-পুত্রে কোন দ্বন্দ নয়, এ নিছকই ক্রিকেটীয় দ্বৈরত্ব, যা দুজনই উপভোগ করেন,  মা নিজের দেশের দিকে হেলে থাকলেও ছেলের দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারেন না। এই কিউই পরিবারটি থেকে উঠে এসেই স্টোকস আজ ইংরেজদের অমরনায়ক হয়ে গেলেন।

বাড়ি ফিরে মেডেল আর বিশ্বকাপের ছবি দিয়েই মা-বাবাকে স্বান্তনা দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্মৃতিতে কালো দাগ পড়ে যাওয়া ছিমছাম শহর ক্রাইস্টচার্চে ১৯৯১ সালে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস। বাবা জেরার্ড স্টোকস ছিলেন পেশাদার রাগবি খেলোয়াড়, যা নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জাতীয় খেলা।

২০০২-০৩ মৌসুমে তিনি যখন ইংল্যান্ডের ওয়ার্কিংটন সিটি রাগবি ক্লাবের হেডকোচের দায়িত্ব পান, এবং স্বপরিবারে ইংল্যান্ডে চলে আসেন, স্টোকসের বয়স তখন ১২ বছর।

বাবা রাগবির অনুরাগী হলেও ছেলে তাঁর ক্রিকেটের মেধার আলো ছড়াতে থাকেন কুকারমাউথ ক্রিকেট ক্লাবে। ২০০৬ সালে যখন তাঁর বাবার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, এবং তিনি আবার নিউজিল্যান্ডে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাঁর ১৫ বছর বয়সী পুত্র ইংলিশ ক্রিকেটে পুরোপুরি মজে গেছেন।

বিভিন্ন রাজ্য-প্রদেশে গিয়ে খেলে আসছেন, ভাল পারফর্মও করছেন, ফলে যত্নও পাচ্ছেন, এবং সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকছে কাউন্টি ক্রিকেট, তাই এই সাফল্যের পালকগুলি ফেলে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে আবারও নতুন করে সব শুরু করতে তিনি নারাজ হলেন।

ফলে তখন থেকেই বেন স্টোকসের একাকী প্রবাসজীবন এবং লড়াই শুরু হয়ে গেল। ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে চাপানো বেন স্টোকস শুরু থেকেই বোঝাচ্ছিলেন, তিনি দলে স্থায়ী হতেই এসেছেন। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং সবদিকেই ছিলেন সরব।

কিন্তু প্রকৃতি যেন কারো সুখ দীর্ঘদিন সহ্য করতে পারেনা। ২০১৪ টি-টেয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলা হলো না ইনজুরির কারণে। তাই ২০১৬ বিশ্বকাপই ছিল ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপ। এবং প্রথম বিশ্বকাপ খেলেই চলে এলেন ফাইনালে, সে ফাইনালে আসার পথে স্টোকস অবদান রেখেছেন বেশকটি ম্যাচে।

ফাইনালে ইংলিশরা টি-টোয়েন্টির মাস্টার ক্যারিবিয়ানদের সাথে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে খেলা নিয়ে এলো ম্যাচের শেষ ওভারে, যেখানে দরকার ছিল ১৯ রান, ম্যাচ হেলেছিল ইংলিশদের দিকেই।

বোলিংপ্রান্তে ছিলেন স্টোকস, উপমহাদেশীয় পরিবেশে পাটা পিচে অমন চাপে পারফেক্ট লাইন – লেন্থই পাচ্ছিলেন না, ভ্যারিয়েশন তো দুরাশা। চরম আক্রমণাত্মক ব্রেথওয়েটকে চারটি বল করে চারটিই খেলেন ছক্কা। ইংলিশরা দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটার এত কাছে এসেও ছুঁতে পারলো না  প্রায় জেতা ম্যাচ হেরে গেল ইংল্যান্ড, অভিবাসী স্টোকস দুয়োধ্বনিতে জার্সির আড়ালে লুকিয়ে থাকতে চাইলেন।

অমন একটি ঘটনার পর অনেকেই হারিয়ে যান, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে দল থেকে ছিটকে পড়েন। স্টোকস হারালেন না, ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেন। কিন্তু, ক্যারিয়ারের শুরু থেকে বদমেজাজের জন্য গা থেকে ব্যাড বয়ের গন্ধ সরাতে তো পারলেন না, উল্টো যেন আরো লেপ্টে বসলো।

পানশালায় গিয়ে মদ্যপ অবস্থায় ভক্তকে ঘুষি মেরে পত্রিকার শিরোনাম হলেন, বোর্ডের রোষানলে পড়েছেন। বাংলাদেশে তামিম ইকবালের সাথে তর্কে জড়িয়ে সমালোচিত হয়েছেন। সর্বোপরি বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়ছিল না।

কিন্তু স্টোকসরা জানেন কিভাবে লাইমলাইটের ভাষা পাল্টে দিতে হয়। ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংলিশরা ফেভারিট হিসেবে শুরু করে ফেভারিটের মতই আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছিল। তবে আলাদা করে নজর কাড়েন বেন স্টোকস। তাঁর চোখেমুখে দেখা যাচ্ছিল সেই পুরোনো জেদ, শরীরী ভাষাই বলে দিচ্ছিল তিনি সেরা হতে এসেছেন। আর এর ধারাবাহীকতা ছিল ফাইনালে, ফাইনালের পরের অ্যাশেজেও।

ফাইনালে পেলেন নিউজিল্যান্ডকে। যে দেশের রক্ত বইছে তাঁর শরীরে। সে আবেগ দেখানোর সুযোগ নেই, আর স্টোকসই সেই অভিজ্ঞতার শিকার হওয়া প্রথম ব্যক্তি নন, খোদ নিউজিল্যান্ডই ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে প্রোটিয়াদের পেরিয়ে, এক প্রোটিয়ারই হাত ধরে, তিনি ছিলেন গ্রান্ট ইলিয়ট।

একের পর এক উইকেট পতনে ইংল্যান্ডের দিকে বাজির দর যখন কমছিল, তখনই স্টোকস , বাটলারকে নিয়ে শুরু করলেন ঘুরে দাঁড়ানো। দুজনেই চোয়ালবদ্ধভাবে খেলে গেছেন, দুর্দান্ত জুটি গড়ে ম্যাচ ইংলিশদের কাছে এনেছেন। তবে স্টোকস নিজের সাথে করা লড়াইটায় জিতে গেছেন। সেবারে শেষপর্যন্ত খেলা টেনে নিয়ে ইংলিশরা ডুবেছিল তাঁর হাতে, আর এবার দলকে শেষপর্যন্ত টেনে নিয়ে সেই তিনিই উপহার দিলেন জয়।

সেদিনের ইয়ান বিশপের মত আবেগের আতিশয্যে কেউ বলে উঠেনি, ‘রিমেম্বার দ্য নেম, কার্লোস ব্র্যাথওয়েট’। হয়তো লর্ডসে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার আর বিশ্বকাপেরটা নিয়ে স্টোকস নিজেই বলে উঠেছিলেন, ‘রিমেম্বার দ্যাট নেম অলসো, বেন স্টোকস।’

স্টোকস সত্যি নিজেকে মনে রাখতে বাধ্য করেছেন এরপরও। হেডিংলি মহাকাব্য রচনা করে ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ স্বপ্ন রচনা করেছেন। মানসিক অবসাদে দূরে গেলেন, কিন্তু থাকতে পারলেন না। ফিরলেন ক্রিকেটে। ইংল্যান্ডকে জেতালেন আরেকটি বিশ্বজয়ের শিরোপা। ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল জয়ের নায়ক তো তিনিই। সত্যিই, নিজের নামটাকে মনে রাখতে বাধ্যই করলেন স্টোকস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link