More

Social Media

Light
Dark

সোসিয়াদাদ-বিলবাও: অন্যরকম দ্বৈরথের গল্প

শতকরা হিসেবে বাস্ক অঞ্চল স্পেন মানচিত্রের মাত্র ১.৪%, মোট জনসংখ্যার ৪.৬% আর স্প্যানিশ লিগের মোট ২০%! কিন্তু আজকের কোপা দেল রে ফাইনালে তারাই ১০০%। আসলে ঠিক আজকের না, গত বছরের। কাগজে কলমে এটা ২০২০ কোপা দেল রে ফাইনাল। কিন্তু মহামারির কারণে দুই দফা পিছিয়ে এই ফাইনাল এসে থেমেছে পরের মৌসুমের শেষ প্রান্তে। মোটামুটি এক প্রকার বাস্ক অঞ্চলের মানুষদের তাড়া খেয়েই। বাস্ক অঞ্চলের মানুষের জন্য এই অপেক্ষা এক-দুই দিনের নয়, বরং তাদের অপেক্ষা লিভারপুলের থেকেও বেশি। এ প্রতীক্ষা শিরোপার নয়, বরং স্পেনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে নিজের আধিপত্য গর্ব ভরে প্রদর্শন করানোর।

শুরুটা বাস্ক অঞ্চলের পরিচিতি দিয়েই করা যাক। স্পেনে মূলত যে দু’টি স্বাধীনতাকামী অঞ্চল আছে। এক কাতালুনিয়া আরেকটি বাস্ক। দুই অঞ্চলই অনেক বছর ধরে নিজেদের স্বাধীনতা দাবি করে আসছে, কিন্তু নিজেদের স্বার্থের কারণে স্পেন কিংবা ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন কেউই সেদিকে নজর দিচ্ছে না। বাস্করা মূলত নিজেরা একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ জাতি, নিজেদের ভাষা, গৌর, ঐতিহ্যের মিশেলে গড়ে ওঠা সম্পূর্ণ আলাদা এক স্বত্বা। বাস্কদের আগমন ধরা হয়ে থাকে প্রাচীন গ্রিস থেকে। কিন্তু ভাসতে ভাসতে তাদের শেষ আশ্রয় হয়েছে এই স্পেন আর ফ্রান্সের মাঝামাঝি জায়গাতে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন স্পেন আর ফ্রান্স নিজেদের সকল কলোনি একে একে ছেড়ে দিচ্ছিল, স্বাধীন করে দিচ্ছিল একেক দেশকে, তখন বাস্করাও সোচ্চার হয়েছিল নিজেদের স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু বেশিরভাগ কলোনিই ছিল তাদের দেশ থেকে বেশ দুড়ে, কিন্তু কাতালুনিয়ার আর বাস্ক একদম তাদের দেশের লাগোয়া হওয়ায় তাদের আর স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া হয়নি। শতবর্ষ পরও তাদের সংগ্রাম অনেকটা বৃথাই। তবুও সংগ্রাম খুঁজে আশা, একটুখানি লড়াই করার শক্তি। আর সেখানেই সামনে এগিয়ে এসেছে ফুটবল।

ads

বাস্কের লড়াই করার শক্তি হয়েছে ফুটবল। কাতালুনিয়ার হয়ে বার্সেলোনা যে প্রতীক হয়ে উঠতে পেরেছে, বাস্কের হয়ে কেউ সেটা হয়ে উঠতে পারেনি। এক ইয়োহান ক্রুইফ এসে বদলে দিয়েছেন বার্সেলোনার ফুটবল। বাস্কের হয়ে কেউ দেবদূত হয়ে আসেনি। তারা বিশ্বস্ত ছিল নিজেদের অটুট অবস্থানে। যেখানে থেকে এখনও লড়াই করে যাচ্ছে অ্যাথলেটিক বিলবাও।

নিজেদের বাস্ক গৌরবের অংশীদার হতে দেয় না কাউকে তারা। ১০০ বছরের উপরে নিজেদের গৌরব টিকিয়ে রেখেছে তারা, শুধুমাত্র বাস্ক অঞ্চলের খেলোয়াড়দের খেলার সুযোগ দিয়ে। অ্যাথলিক বিলবাওয়ে খেলতে চাইলে আপনাকে জন্মসূত্রে বাস্ক হতে হবে। নইলে দু:খিত, আপনি মেসি-রোনালদো হলেও আপনার এই দলে সুযোগ নেই।

রিয়াল সোসিয়াদাদও একসময় এই পথেই ছিল, কিন্তু একসময় ফুটবলের উত্তরণে তাল মেলাতে গিয়ে বুঝতে পারে, এভাবে আর থাকা সম্ভব নয়। তাই নিজেদের পলিসিতে পরিবর্তন এনে বাস্কের বাইরের খেলোয়াড়দেরও সুযোগ দিতে শুরু করে তারা। সে জন্য বাস্কদের কথাও কম শুনতে হয়নি তাদের। নিজেদের ঐতিহ্য অটুট রাখতে সদা তৎপর বাস্কদের দোয়াতেন কী না, এরপর থেকে শিরোপার মুখ দেখা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সোসিয়াদাদের জন্য

শিরোপার মুখ দেখা বন্ধ বলছি এজন্যই, একসময় স্প্যানিশ ফুটবলে দাপট দেখাতো বাস্করাই। রিয়াল মাদ্রিদ ছিল রয়্যাল ক্লাব, সফলতার দিক দিয়েও ছিল নিজেদের রয়্যালিটি। আর এরপরেই ছিল বাস্ক ক্লাবেরা। কাতালান ক্লাবদের দৌরাত্ম্য তখনও স্পেনে শুরু হয়নি। অ্যাথলেটিক বিলবাও আর রিয়াল সোসিয়াদাদ ছিল স্পেনের ফুটবলের অন্যতম বড় দুই স্তম্ভ!

১৯৭৬ সালের ৫ ডিসেম্বর, জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর পতন হয়েছে প্রায় এক বছর হতে চলল। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ কাটিয়ে স্পেন পরেছিল জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর একনায়কতন্ত্রের অধীনে। সেখানে না ছিল বলার ভাষা, না ছিল কিছু লিখবার। বাস্ক আর কাতালুনিয়া শব্দ দু’টো তো মুখে তোলাই ছিল নিষিদ্ধ। সেখানে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে সামলে উঠছে, কিন্তু বাস্ক আর কাতালুনিয়া তখনও নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে চুপ। ফ্র্যাঙ্কোর পতন হয়েছে ঠিকই, তাই বলে এখনও যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক তাও ঠিক নয়। এখনও ফ্র্যাঙ্কোর নিয়মেই চলছে সবকিছু।

এমন সময়ই স্প্যানিশ লিগে মুখোমুখি রিয়াল সোসিয়াদাদ আর অ্যাথলেটিক বিলবাও। দুই অধিনায়ক ইনাক্সিও কোর্তাবারিয়া আর হোসে অ্যাঞ্জেল ইরিবার টানেল দিয়ে মাঠে নামতেই দেখা গেল অদ্ভুত দৃশ্যের। তাদের দুজনের হাতে সম্মিলিত এক পতাকা। লাল জমিনের মাঝে সাদা- সবুজ ক্রস। হাজার হাজার দর্শকের সামনে তুলে ধরলেন নিজেদের মাতৃভূমির পতাকা, নিজেদের স্বত্বার প্রতীক। বাস্ক অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের মনে যে পতাকা, কিন্তু প্রকাশ্যে সকলেই ভীতু। যে পতাকা নিষিদ্ধ ৪০ বছর ধরে।

সেদিনে সেখানে থাকা পুলিশও হতবিহ্বল। হাজার হলেও এই পতাকা তাদের একান্ত নিজস্ব, নিজের মাতৃভূমির। ফ্র্যাঙ্কো নাকি নিজেদের গর্ব, কোনটাকে সুযোগ দিবেন তারা? সেদিন নিজেদের গর্বকেই বড় করে দেখেছিল তারা। ম্যাচ সোসিয়াদাদ শেষ করেছিল ৫-০ গোলে। এর ১০ দিন পর পুরোপুরি পতন ঘটে ফ্র্যাঙ্কোর। তার সকল আদেশ-নির্দেশ-নিয়মাবলি নিষিদ্ধ করে দেয় স্পেনের জনগন, ভোটের মাধ্যমে।

সোসিয়াদাদ-বিলবাও রাইভালরিকে অন্য যেকোনো রাইভালরির মতন এক ছাঁচে ফেললে বড্ড ভুল করবেন। দু’জনের রাইভালরি কোনোভাবেই এক সূত্রে গাঁথা নয়। অন্যান্য সিটি রাইভালরিতে যেমন ম্যাচ শুরুর সপ্তাহখানেক আগে থেকে মুখ দেখাদেখি বন্ধ, নিজের দলকে সেরা বানাতে সদা প্রস্তুত জনতা, এখানে ঘটনাটা ঠিক তার উল্টো।

রাইভালরি যেন অন্য কোনো অল্টারনেট ডাইমেনশনের। এখানে মারামারি নেই, হানাহানি নেই। অ্যানোতা থেকে স্যান মেমেস পর্যন্ত গল্পটা শুধু বন্ধুত্বের। রিয়াল সোসিয়াদাদের ফুটবলিং ডিরেক্টর যেমন বলেছেন, “ফুটবলিং লেভেলে এর মতন গুরুত্বপূর্ণ ডার্বি খুব কমই আছে। বাস্ক ফুটবলের প্রতিনিধিত্ব কারী দুই দলের খেলা। কিন্তু এর ঠিক মূলে রয়েছে নিজেদের পারস্পরিক সম্মান আর ভালোবাসার অম্লমধুর গল্প।”

কথা কিছু ভুল নয়। অ্যানোতা থেকে স্যান মেমেসের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। অথচ কখনোও দেখবেন না দুই দলের সমর্থকদের দ্বন্দ্বে জড়াতে, নিজেদের ফুটবল ক্লাব নিয়ে। বাস্কদের বন্ধুত্ব অটুট করেছে নিজেদের রাইভালরি। এই রাইভালরি শুধু মাঠের ৯০ মিনিটই। ম্যাচ শেষে একে অপরের পরম বন্ধু। ফুটবল তাদের কাছে ভাগ-বাটোয়ারার কোনো বিষয় নয়, বরং ফুটবল তাদের নিজেদের অদ্ভুত এক মিলনমেলা। যে মিলনমেলায় দুই বন্ধুর পরিচয় হয়, ৯০ মিনিট পাশাপাশি দলে দুই রাইভাল খেলা দেখে। এই বাস্ক রাইভালরিই একমাত্র রাইভালরি যেখানে দুইটি আলাদা দলের জন্য আলাদা স্ট্যান্ড করে দেওয়া হয় না। চাইলেই বিলবাও আর সোসিয়াদাদের সমর্থক এক হয়ে পুরো মাঠ লালে-নীলে সজ্জিত করে দিতে পারবে।

শুরুতে বলেছিলাম না, ২০২০ সালের ফাইনাল এক প্রকার তাড়া খেয়েই চলে এসেছে ২০২১ এর শেষে? তাড়ার গল্পটা আরো অদ্ভুত। লক ডাউনে যখন ফুটবল নতুন করে শুরু হলো, তখনই তড়িঘড়ি করে সব ম্যাচ শেষ করার তাড়া সবার মধ্যে। কিন্তু বাস্কের দুই ক্লাব সমর্থকদের সম্মতি নিয়ে ঘটিয়ে ফেলল এক অদ্ভুত কাণ্ড। সরাসরি স্প্যানিশ ফেডারেশনে গিয়ে প্রস্তাব দিয়ে বসলো, এই ফাইনাল আমরা এখন খেলবো না।

লকডাউনে ৩ মাস ফুটবল বন্ধ থাকার পর ফুটবল ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু ফুটবলের প্রাণ ফিরেনি। ফুটবলের প্রাণ এখনও ঘরবন্দি, সোফায় বসে নিজেদের দলকে সমর্থন জানিয়ে চলছে, আর মাঠে চলছে ‘ফিফা ক্রাউড’। এই ‘ফিফা ক্রাউড;-এ খেলতে রাজি নয় দুই দল।

তবে? তারা চায় ফুটবল যবে ফিরবে, নিজের মতন করে নিজের শৌর্য্যে-বীর্য্যে, তবেই খেলা নামবে মাঠে। অন্তত ‘অল বাস্ক’ ফাইনাল। এই ফাইনাল হলে মাঠেই হবে, দর্শকের সামনে পুরো বাস্ককে সামনে রেখে হাতে হাত রেখে বাস্ককে শিরোপা নিয়ে যাবে একদল। অদ্ভুত শোনাচ্ছে, তাই না? নিজেদের মাতৃভূমির জন্য এটুকু করতে রাজি সকলে। স্প্যানিশ ফেডারেশনও শর্ত দিয়েছিল, এজন্য অন্য কোনো ম্যাচের শিডিউল বদলাতে পারবে না তারা। এক বাক্যে মেনে নিয়েছে তারা।

এই রাইভালরির উত্তেজনা অন্য কোনো রাইভালরি থেকে কম না, কিন্তু ফুটবলে খেলার থেকেও আগে আসে সমর্থকেরা। হার-জিত, শিরোপা; সবকিছু তো তাদের জন্যই। আমাদের গর্ব, একসাথে থাকার ঐতিহ্য, সংগ্রাম নিয়ে বড়াই করার পর যদি সেটি নিজেরাই করে না দেখাতে পারি, তবে তার মূল্য কী থাকলো? চাইলেই এক বছর আগে এই ম্যাচ খেলা সম্ভব ছিল, কিন্তু তাতে করে এই গর্বের ভাগীদার সকলে হতে পারত? পারতো না।

– রবার্তো ওলাবে, স্পোর্টিং ডিরেক্টর, রিয়াল সোসিয়াদাদ

বাস্কের ডার্বি বাস্কের মতনই হতে চলেছে। অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের ২৫ জনের ২৫ জনই তো বাস্ক, নতুন করে আর বলবার কী আছে? আর সোসিদাদের ২৮ জনের মধ্যে ১৯জন বাস্ক। সবমিলিয়ে ৫৩ জনের স্কোয়াডে ৪৪ জনই বাস্কের। আর কোচেদের সহ ধরলে ৪১ জন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার শুরু হয়ে অ্যাথলেটিক আর সোসিয়াদাদের হয়ে। লোকাল ডার্বি এর থেকে বেশি লোকাল হওয়া হয়তো সম্ভব না।

৪ মার্চ, ২০২১; এই তারিখটাকে ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭৬ এর মতন করে বাধাই করে রাখবে বাস্কবাসীরা। সেদিন ছিল নতুন স্পেনের সামনে নিজেদের পরিচয় নতুন করে তুলে ধরবার দিন। আর আজ, যে ফুটবল নিয়ে গর্ব তাদের, সেই ফুটবলে সমগ্র স্পেনকে সরিয়ে দিয়ে নিজেদের আধিপত্য দেখানোর দিন। সেভিয়ার মাঠে যখন দুই দল নামবে, তখন বাস্কের ইতিহাস আবারও লেখা হবে, স্বর্ণের অক্ষরে। যে লেখা লিখবার জন্য গত ১১২ বছরের অপেক্ষা তাদের। সেই ইতিহাস লেখা হবে সেভিয়ার প্রান্তরে!

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link