More

Social Media

Light
Dark

আগ্রাসন/নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন

তখনও এই লকডাউন ইত্যাদির চব্ব আসেনি, ইডেনে আইপিএলের একটা ম্যাচ দেখতে গেছিলাম বাবার সঙ্গে। চেন্নাইয়ের সঙ্গে লড়াই করেও শেষমেশ হার মেনেছিল দীনেশ কার্তিকের কলকাতা নাইট রাইডার্স। যথারীতি চোখের সামনে প্রিয় দলের হার দেখে খারাপ লাগছিল, বেরিয়ে কিছুটা দূরে চা খাচ্ছিলাম বাপ-ব্যাটায়।

কথায় কথায় বলেছিলাম, ‘গম্ভীরের সময় যে আগ্রাসন ছিল কেকেআরের। এখন সে সবই উধাও, ১১ জনের দল তবু শুধুই রাসেল আর রাসেল।’ চায়ে সুড়ুৎ করে চুমুক দিয়ে বাবা বলেছিল, ‘আগ্রাসন নয়, নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন। অধিনায়ক যে কেউ হতে পারে, তবে নেতা হতে গেলে বড্ড নিয়ন্ত্রিত হতে হয়। আমাদের বিরাট এখনও এটা রপ্ত করতে পারেনি, মিলিয়ে নিস যত ভালই দল হোক, আমরা মোক্ষম সময়ে খেই হারাবো, ট্রফি পাব না।’

বাবার কথার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হইনি সেদিন। ভেবেছিলাম, ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংও যথেষ্ট ক্ষুরধার, আমরাই বিশ্বকাপ জিতব। ২০১৯ সালের ৯ জুলাই সেই স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে, সেমিফাইনালে কিউই পরাক্রমে ধূলিস্যাৎ হয়েছে ভারত। টানা দু’বছরের অপেক্ষার পরে গতকাল ফের সেই নিউজিল্যান্ডের সামনেই মুখ থুবড়ে পড়েছে বিরাট-বাহিনী। এবার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে। এভাবে বড় মঞ্চে এতগুলো হারের পর প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, উঠছেও।

ads

আর এই সময়েই বাবার কথাগুলো কানে বাজছে, ‘আগ্রাসন নয়, নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন’। শুধু গৌতম গম্ভীর নন, একে একে মনে পড়ছে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের একের পর এক বিখ্যাত জয়ের কথা। ২০০১ সালের বিখ্যাত ইডেন-গার্ডেন্স টেস্ট দিয়েই শুরু করা যাক। ফলো-অন হজম করেও ১৭১ রানে প্রবল প্রতিপক্ষ অজিদের হারিয়েছিল ভারত। মহাকাব্যিক ২৮১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন লক্ষ্মণ, ১৮০ রান এসেছিল দ্রাবিড়ের ব্যাট থেকেও।

সরাসরি সেই ম্যাচ দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তবে টিভি-ইউটিউবে যতটুকু দেখেছি তাতে এখবারও ওই দু’জনকে চার-ছয় মেরে বোলারের দিকে কটমট করে তাকাতে দেখিনি। অজি স্লেজিংয়ের প্রত্যুত্তরে চোখা চোখা শব্দও ব্যবহার করেননি কেউ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দু’জনে ব্যাট করেছেন, ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি-ওয়ার্নকে সামলে সেবার দ্বিতীয় ইনিংসে ছ’শোর ওপর রান করেছিল ভারত। পরে একটি ইন্টারভিউতে লক্ষ্মণ বলেছিলেন, ওইদিন নাকি ধুমজ্বর নিয়ে ব্যাট করেছিলেন দ্রাবিড়৷

কাট টু ২০০৯। নেপিয়ারে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নেমে ফের ফলো-অন হজম করেছে ভারত৷ সেসময় ভারতীয় ব্যাটিং লাইন-আপ তারকাখচিত হলেও, সবাই ধরেই নিয়েছিলেন ম্যাচ হারবে ভারত। আর সেই ধারণাকেই ভুল প্রমাণ করেছিলেন গৌতম গম্ভীর৷ প্রথমে দ্রাবিড়, মাঝে শচীন ও পরে লক্ষণের সঙ্গে জুটি বেঁধে ধীরে ধীরে ম্যাচ ছিনিয়ে এনেছিলেন কিউইদের গ্রাস থেকে৷

৪৩৭টি বল খেলে মাত্র ১৩৭ রান করেছিলেন তিনি। মাঠে বহুবার বিতর্কে জড়ালেও সেদিন গম্ভীরের যেন সম্পূর্ণ অন্য এক রূপ দেখেছিল গোটাবিশ্ব। টানা ছয় সেশন ধরে ব্যাট করেছিলেন তিনি৷ ওভারের মাঝে খুব একটা কথা বলছিলেন না। ক্রিস হ্যামিল্টন, ড্যানিয়েল ভেত্তরির প্রত্যেকটা বল খেলছিলেন সযত্নে। শেষদিকে কিউই বোলিং আক্রমণকে রীতিমতো তিতিবিরক্ত করে ছেড়েছিলেন দিল্লির তরুণ।

একই কথা খাটে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ, হালের অস্ট্রেলিয়া সিরিজের সিডনি টেস্টের ক্ষেত্রেও। প্রতিটি ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের ব্যাট-বল ঝলসে উঠেছে, আগ্রাসন ফুটে বেরিয়েছে বাউন্ডারি, উইকেট হয়ে। কাউকে খেলার চেয়ে বেশি প্রতিপক্ষকে বিরক্ত করায় মন দিতে দেখা যায়নি। এতকিছু সত্ত্বেও বিরাটের গর্জনে গলা মিলিয়েছিল সকলে।

সবাই বলেছিল, ‘বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান বলে কথা, মাঠে ও লাফাবে না তো কে লাফাবে? এই আগ্রাসন ওকেই মানায়। ও এভাবেই সফল।’ আচ্ছা ঠিক কতটা সফল? ব্যাটসম্যান কোহলিকে নিয়ে কোনও কথা হবে না, বাইশ গজে বোলারদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মাখনের ওপর ছুরির মতো। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে? বেশ ক’টা দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতেছেন, আর? ক্যাবিনেটে আর কোনও ট্রফি রয়েছে কি?

এটা শুনে অনেকেই হয়ত মাথা নেড়ে বলতে পারেন, ‘ট্রফিই সব নয়, এসব প্রশ্ন অমূলক।’ আচ্ছা বেশ, তাহলে সবাই মেনে নিতে বাধ্য, চতুর্থ ইনিংসে কিউইদের মাত্র ১৩৯ রানের টার্গেট দিয়ে প্রথমেই ‘চা বিরতির আগে ওদের দুটো উইকেট ফেলে দেব। খেলা জমবে’ বলে হম্বিতম্বি করে শেষমেশ আট উইকেটে ম্যাচ হারাটা কৃতিত্বের। রোদ ঝলমলে দিনের শুরুতে তিন উইকেট খুইয়েও চালিয়ে খেলতে গিয়ে ১৭০ রানে বাণ্ডিল হওয়াই যোদ্ধাসুলভ আভিজাত্য। প্রতি আক্রমণ করতে চেয়েও পন্থকে রাহানের আগে না পাঠানো দূরদর্শিতা।

একসময় নিজের খেলায় মন দিতে অধিনায়কত্ব ছেড়েছিলেন শচীন। তাতে তাঁর খ্যাতিতে বিন্দুমাত্র কালি লাগেনি। ‘আর হচ্ছে না’ দেখে টেস্ট থেকে অবসর নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন কুল। এমনকী, ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জেতার পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে গো-হারান হেরে কপিল দেবও অধিনায়কত্ব খুইয়েছিলেন। সেই সিরিজে নিজে ভাল বোলিং করলেও গাভাসকরের হাতে তুলে দিতে হয়েছিল অধিনায়কের টুপি, ব্লেজার। অধিনায়ক হিসেবে কোহলির অবদান নিশ্চয়ই উপরিউক্তদের চেয়ে বেশি নয়।

২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে শুরু করে গতকালের এই হারের পর এটা স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, তিনি অসামান্য এক যোদ্ধা হতে পারেন, তবে সেনাপতি নন। নেতা হতে গেলে যে বুদ্ধিমত্তা, স্থৈর্য এবং নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন লাগে, তা নেই তাঁর মধ্যে। সাফল্যের আলো জ্বালতে যে স্নিগ্ধ শিখা প্রয়োজন, তা তিনি নন। তিনি খানিক দাবানলের মতো, দলের সৈনিক হিসেবে তাঁর সেই ধ্বংসাত্মক আগুন বিপক্ষকে ছারখার করতে ব্যবহার করুক ভারত৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link