More

Social Media

Light
Dark

সুরের আকাশে তুমি যে গো সুখতারা

কোন বাদ্যযন্ত্রে হাত পাকানো ঠিক কতটা কঠিন? ছোট থেকে শেখা ‘একদিনে কিছু হয় না, সবটাই পরিশ্রমের খেলা’, সে পরিশ্রমে কোন ত্রুটি না রেখেও যখন সেতারের প্রথম আলাপটা উঠে আসে হাতের তানে, মনে হয় সবই হল, কিন্তু আরেকটা রবিশঙ্কর হল না! তখনই শুনতে হয়, শিল্পী তৈরি হয় না, জন্মায়!

রবিশঙ্করের জন্মের বহুবছর পর ২০০৬ এর নাগপুরের কঠিন পিচেও উল্টোদিকের অধিনায়ক হয়তো মনে মনে এটাই আওড়েছেন, যখন এক বাঁ-হাতি ওপেনার জীবনের প্রথম লড়াইতেই অসাধারণ ভঙ্গিতে ব্যাট নামক সেতারটি বাজিয়ে শতরানের মার্গ ছুঁয়েছিলেন!

‘ওহ জিসাস!’

ads

যীশুর জন্মদিনেই যাঁর জন্ম। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যীশুর জন্মের ১৯৮৪ বছর পর! অতীব সুন্দর গড়ন, চলনে বলনে ইংরেজ আভিজাত্য স্পষ্ট। এ হেন কিশোর ছেলেবেলায় ব্যাট নয়, হাতে তুলেছিলেন ক্ল্যারিওনেট! স্কুলে পড়াকালীনই। অসম্ভব সুন্দর বাজাতেন, এবং বছরখানেকের মধ্যেই স্কুলের অন্যতম সেরা ক্ল্যারিওনেট বাদক হিসেবে পরিচিতি পান।

কিন্তু ভাগ্যদেবতা যে অন্য ললাটলিপি লিখে রেখেছেন! তাই স্কুলের ক্রিকেট দলে একবার একজনের অনুপস্থিতিতে নামিয়ে দেওয়া হল বাইশ গজে – লাল ডিউস দেখে পালানো ত দূরের কথা, কিশোরশিল্পী লম্বা বাদ্যযন্ত্রটির ছাপ ফেললেন ২২ গজেও!

একটা সময় আসে, যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলতে হয় ‘you have to take a call’। প্যাশন এবং প্রফেশন, দুটোর প্রতি একই সময় সুবিচার করা সম্ভব নয়, সুতরাং কোথাও গিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হয়। সামনে দুটো রাস্তা ছিল, সঙ্গীতজ্ঞ অথবা ক্রিকেটজ্ঞ। তিনি দ্বিতীয়টাই বেছে নিলেন।

এবং তারপরেই এসেক্সের হয়ে যখন ম্যাচ বাঁচানো ৯৭ খেললেন, লোকে বুঝল এ সিদ্ধান্তটা খুব একটা খারাপ নেয়নি!

টেস্ট ক্রিকেটকে বলা হয় রাগসঙ্গীতের দরবার! বলা হয় যতই একদিবসীয় বা ধুমধাড়াক্কা খেলায় নামডাক হোক, যেখানে সঙ্গীত তৈরী হয় সে জায়গায় এসে খেলে দেখাও ত বাপু! যেকোন শিল্পীর কাছে সেটা সম্মানের এবং একইসাথে চ্যালেঞ্জের। ‘এ এই লেভেলেও পারে’ – কথাটা শোনার জন্য বহু শিল্পী দিনরাত ঘাম ঝরায়, পরিশ্রমের অন্ত রাখে না। এ এক জাতের শিল্পী।

আরেক জাতের শিল্পীরা নিজেদের সেরাটা দেওয়ার জন্য ওই আসরটাকেই বেছে নেয়, মাঠে নেমে বল বাই বল অপেক্ষা করে একঘন্টা পর এমন একটা হাফবলি চোখধাঁধানো ড্রাইভে কভার আর মিডঅফের মাঝ দিয়ে সবুজ মাঠটাকে দু’ফালা করে পার করাবে, যা দেখে গোটা অডিটোরিয়ামের দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাতে বাধ্য হবে, মনে মনে সেলাম ঠুকবে। বাকিদের সাথে তারা নিজেদের এইভাবেই পার্থক্যটা গড়ে ফেলবে অজান্তেই।

এই দ্বিতীয় জাতের শিল্পীদের মধ্যে পড়েন ইংরেজ ক্রিকেট সভ্যতার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান অ্যালিস্টেয়ার কুক!
২০০৬ এ ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট সিরিজেই যার প্রবহমান ধারার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেছিল। প্রথম টেস্টেই নাগপুরে প্রথম ইনিংসে ৬০ এ পর দ্বিতীয় ইনিংসে অসাধারণ ১০৪।

ইরফান পাঠান তখন শেষ মূহূর্তে বলের গতিপথ পরিবর্তনে রীতিমতো ওস্তাদ হয়ে উঠেছেন। আগের সিরিজেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসামান্য হ্যাটট্রিক করে এসেছেন। এ হেন ইরফানকে কভারে একটা অসাধারণ ড্রাইভ করেন কুক – সেই শুরু! জাত শিল্পীর এটাই নিদর্শন, তার শুরুর মাধ্যমেই। সে ঠিকই বোঝে কোথায় শিল্প প্রদর্শন করলে মানুষ শুনবে, দেখবে, বুঝবে, বিশ্লেষণ করবে। অ্যালিস্টার কুক অবশ্যই তার ব্যতিক্রম নন একেবারেই।

সেই শুরু। একবার মেজাজ পেয়ে গেলে সেতারের ঝঙ্কারে যেমন মুখরিত হতে থাকে গোটা প্রেক্ষাগৃহ, তেমনই এই ব্যাট হাতে বাঁহাতি তাঁর মূর্ছনার প্রদর্শন জারি রাখলেন আগামী সিরিজগুলোতেও। যেমন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১০৫ রানের শৈল্পিক ইনিংসটি খেললেন ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে।

তারপর ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে পরের পর সেঞ্চুরি। আপামর ক্রিকেটভক্তকে শৈল্পিক জাদুতে মুগ্ধ করতে বাইশ গজে আগমন ঘটেছে এক রাঁধুনির, ক্রমান্বয়ে পরিবেশন করছেন একের পর এক সুস্বাদু সব ইনিংস, মনে ছবি আঁকা সব ইনিংস – এ সারসত্যের মালুম ততদিনে পেয়ে গেছেন বিশ্বের তাবড় ক্রিকেটার থেকে ক্রিকেটভক্তগণ! অ্যালিস্টেয়ার কুক নিয়ে কথা হচ্ছে আর অ্যাশেজ সিরিজের কথা হবে তা কি করে হয় বৎস!

ঠিক তাই। ২০০৬-০৭। ট্রেসকথিক হঠাৎ বলে বসলেন চোটের কারণে খেলবেন না। তার আগে ২০০৫ এর অ্যাশেজে ইংরেজ সভ্যতার দুর্গ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে নিজেদের দেশেই, ৫-০ এর দগদগে ঘা’টা এখনো ঠিক করে শুকোয়নি, তন্মধ্যে দলের সেরা ওপেনার জানালেন তিনি নেই! কপালে চিন্তার ভাঁজের মধ্যেই দলে অন্তর্ভুক্তি কুকের। তিনি আবার এই ভাঁজটাকেই আরো লম্বা করে দিলেন, প্রথম দুটো টেস্টেই ব্যর্থ হয়ে। একটা ৪৩ ছাড়া বলার মতো কিছুই নেই। হতোদ্যম ইংরেজ অধিনায়ক ফ্লিনটফ তৃতীয় টেস্টেও কুককে রাখলেন। ফল?

ইংল্যান্ড টেস্টটা হারে। অস্ট্রেলিয়া ৩-০ তে সিরিজে এগোয়। কিন্তু, ১১৬ রানের ইনিংসে ম্যাকগ্রা-ওয়ার্ন-লির অহঙ্কারে আঘাত করে কুক বুঝিয়েছিলেন, হেরেও না হারার মানসিকতা একা ব্যাগি গ্রিনদের কপিরাইট নয়! এরপরের ২০১০ এর অ্যাশেজে ত অন্য কুক! ব্রিসবেনে জীবনের প্রথম ডবল্ হান্ড্রেড, সঙ্গে আরো দুটো আকর্ষণীয় শতরান!

মেলবোর্নের ২৪৪টাই বা ভুলি কি করে! তুলি দিয়ে আঁকা ছবিও যে বিপক্ষকে পারলে ছারখার করে দিতে পারে, তিনি ত এ উজ্জ্বলতার সাক্ষর প্রদান করে গেছেন! তবে সবচেয়ে সেরা বোধহয় ২০১২ তে কলকাতায় যেটা খেলেছিলেন! ওহ! ক্ল্যাসিক্যাল ১৯০! আমার স্যার শেখাতেন, ‘বাবা জীবনে সব কিছুতে বেসিকটা ক্লিয়ার রাখিস’- এ কথাটা ইডেনে বসে থাকা আমিটাকে আরেকবার মনে করিয়েছিলেন কুক। যাকে ততদিনে ক্রিকেটবিশ্ব নির্দ্বিধায় ‘স্যার’ উপাধি দিয়ে দিয়েছে।

ভারত বিশ্বকাপ জেতার পরেই টেমস নদীর তীরে পাড়ি জমায় মহানন্দে। আর ফিরে আসে মুখ কালো করে, ৪-০ এ হেরে! এর পেছনে যে লোকটির নাম গোটা গ্রেট ব্রিটেন জুড়ে খেলে বেড়ায়, তার নাম অ্যালিস্টার কুক!! কি না করেছেন ঐ সিরিজে!! সবচেয়ে আলোচিত হয় এজবাস্টনে ২৯৪ রানের সেই অমরগাঁথাটি!

শ্রীশান্থ সমানে পায়ের গোড়ায় বল ফেলছেন আর ক্রমাগত ঐশ্বরিক টাইমিংএ কখনো ফ্লিকে স্কোয়্যার লেগে, কখনো কভারে, কখনো ব্যাট ঘুরিয় ফাইন লেগে। যেন বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে সমানে, আর কানে চলছে ঈশ্বরকন্ঠের জগজিৎ! আহা, কি সিনেম্যাটিক!

এই ইনিংসসম ক্রীমটাই ত মনের মণিকোঠায় লাগিয়ে রাতে গায়ে চাদরটা টেনে নিই, পরম প্রশান্তিতে ঘুম নেমে আসে। জীবনের সেরা জলছবি এঁকেছিলেন এই বার্মিংহামের মাঠেই, এক একটা ড্রাইভ মারছেন কোন শিশুকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াবার মতন, আর দূর থেকে কেউ হারমোনিয়ামটা কোলে টেনে ধরছেন, ‘ম্যায় নাশে মে হু!’

সত্যি, কুক যেন আমাদের রঙিন ক্রিকেটীয় ছোটবেলার বসন্তের স্নিগ্ধতা। যার রুপ রস গন্ধ স্পর্শে মিলিয়ে যাওয়া যায়, হারিয়ে যাওয়া যায় নির্ভয়ে। ডেভিড গাওয়ারকে আমরা ত দেখিনি, ওনার ব্যাখ্যা বাবা-কাকাদের সম্পত্তি। তবে ষাটের দশকে জন্মানো কিশোররা যেমন আজও গর্ব করেন ‘আমাদের একটা সুনীল ছিল’, আমরাও তেমনি গর্বে বুক ফুলিয়ে বলি – ‘আমরা কুককে খেলতে দেখেছি।

অলটাইম গ্রেট ইংরেজ একাদশে যার স্থান বাঁধা আছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই! অথচ এই ইংরেজ ব্যাটসম্যান কখনো বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাননি। ৯২ টা একদিবসীয় ক্রিকেটে পাঁচটা শতরান, ১৯ টা অর্ধশতরান। এটা তো পরিসংখ্যানের হিসেব। কিন্তু ইনিংসের বিচার? ভারতের বিরুদ্ধে যে শতরানটি করেছিলেন সাউদাম্পটনের রোজ বোল স্টেডিয়ামে? বিচার হয় না এতে। এত কিছুর পরেও শেষ কথা বলবে স্কোরবোর্ড।

সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের একটি সিনেমার ডায়লগ মনে পড়ছে, ‘আজ থেকে হাজার বছর পরে রিকি পন্টিংয়ের নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে, সৌরভ থাকবে ফুটনোটে।’ ঠিক তেমনই লেখা থাকবে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ব্যাট কখনো বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি, এমনকি নিজের দেশকে টেস্টে অধিনায়কত্ব দিয়েও পারেননি!

কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট যদি সিলেবাসে ঢুকে পড়ে, অ্যালিস্টেয়ার কুককে এড়িয়ে যাবে এমন সাধ্য আছে কি কারোর?? খুব কম ব্যাটসম্যান আছেন, যাদের প্রথম ও শেষ – দুটি টেস্টেই শতরান রয়েছে। আমার এই মুহূর্তে গ্রেগ চ্যাপেলের কথা মনে পড়ছে শুধু। কিন্তু এই শিল্পীও যে সেই তালিকায় ঢুকে পড়েছেন স্বমহিমায়। যে ঝঙ্কারের সুর বয়ে গেছে নাগপুর থেকে কেনসিংটন ওভালে, গত বারো বছর ধরে, আর তেমনি আশ্চর্যের, দুবারই প্রতিপক্ষের নাম ভারত!! সৌরভ নয়, সাঙ্গাকারা নয়, লারা নয় এমনকি স্বদেশীয় অ্যান্ড্রু স্ট্রা্উসও নয়, এই রাঁধুনিকে দেখেই প্রথম স্টান্স ধরা নকল করা শুরু!

সেই সুরেলা ঝঙ্কারের স্রোতে ভেসে নির্মলতার আনন্দগান গেয়ে যান কুক। যার শুরুর আলাপে মুগ্ধতার স্কোয়্যার কাট আছে, মাঝের মধ্য লয়ের নির্মল স্ট্রেটড্রাইভ রয়েছে, শেষের তারানায় অভূতপূর্ব কভার ড্রাইভ রয়েছে। ছোটবেলার ক্ল্যারিওনেট আর বড়বেলার ব্যাট যেন তাঁর কাছে সমার্থক।

বল যেন তাঁর কাছে আসত এক নিষ্পাপ শিশুর মত, যাকে ব্যাট দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, আর সে আনন্দে কখনো কভারে, কখনো লং অনে, কখনো পয়েন্টে বা কখনো ডিপ স্কোয়্যার লেগে পৌঁছে যেত – এত স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান গাওয়ারের পর যদি কেউ হয়ে থাকেন, তিনি অ্যালিস্টার কুক – আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৯টা সেঞ্চুরি দিয়ে যাকে মাপা যায় না।

তেমনই রেকর্ড দিয়েও তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা নেহাতই বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। টেস্ট ক্রিকেটে একটা সময় মনে করা হচ্ছিল তিনি ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকারের সমস্ত রানের রেকর্ড ভেঙে দেবেন। কিন্তু তিনি যে ভাঙাগড়ার খেলায় মজতে ঐ ঘাস চাঁছা জায়গায় পা রাখেননিম, তিনি তো এসেছেন সালভাদোর দালি কিম্বা ভিনসেন্ট ভ্যান গখের ছবিকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে উজ্জীবিত করতে, ক্রিকেটীয় রেকর্ড দিয়ে কি আর শিল্পীর বিশেষত্ব প্রমাণ হয়, বলুন?

১৪৭ রানের বিদায়গাথার আগমনী গান যখন বেজেছে গোটা ওভাল জুড়ে, তখনই কুক সেই সভ্যতার জয়গান গেয়ে গেলেন বাইশ গজে। গভীর প্রশান্তির ছাপ রেখে গেলেন ব্যাট তোলার আগে, প্যাভিলিয়নে যখন ফিরছেন, সারা মাঠ উঠে দাঁড়িয়ে করতালিতে স্বাগত জানাচ্ছেন শিল্পীকে, আর স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে একটাই কথা – থ্যাঙ্ক ইউ শেফ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link