More

Social Media

Light
Dark

বাইশ গজে বাবার মুখ…

তারা তিনজন কেউ কাউকে চিনতেন না।

১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের ভারত-জিম্বাবুয়ে ম্যাচের তারিখ ছিল ১৯ মে। সেদিন মুম্বাইয়ে পরলোকগমন করেছিলেন মহারাষ্ট্রের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক রমেশ টেন্ডুলকার, ৬৫ বছর বয়সে।

২০০৬ সালে ফিরোজ শাহ কোটলার দিল্লী-কর্ণাটক রঞ্জি ট্রফি ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের তারিখ ছিল ১৮ ডিসেম্বর। সেদিন গভীর রাতে দিল্লীতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছিলেন দিল্লির ৫৪ বছরের অ্যাডভোকেট প্রেম কোহলি।

ads

২০২০ সালের ২০ নভেম্বর হায়দ্রাবাদে হার্টের অসুখে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন হায়দ্রাবাদের ৫৩ বছরের অটোরিকশা চালক মোহাম্মদ গাউস।

কিন্তু আজ তারা একত্রিত হলেন এক অজানা জায়গায়। তাঁদের মিলিয়ে দিল ক্রিকেট। ঠিক করে বললে তাদের তিনজনের ছেলে তাঁদের মিলিয়ে দিলেন একসঙ্গে।

১৯ মে ১৯৯৯। রমেশ টেন্ডুলকারের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বিশ্বকাপের ভারত-জিম্বাবুয়ে ম্যাচ ছেড়ে লিস্টারশায়ার থেকে মুম্বাই উড়ে এসেছিলেন তাঁর বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার ছেলে, তার অন্তিম সংস্কারে অংশ নিতে। প্রথম দুটি ম্যাচে হেরে যাওয়া ভারত খুব খারাপ জায়গায় দাঁড়িয়ে, এই অবস্থায় তাঁর মায়ের কথায়, তার পরেই আবার ফিরে গিয়েছিলেন ব্রিস্টলে, পরের ম্যাচেই কেনিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে খেলার জন্য।

আর সেই ম্যাচে করেছিলেন এক অবিস্মরণীয় অপরাজিত ১৪০, যা ছিল তার বাবার জন্য উৎসর্গীকৃত। শেষ অবধি সুপার সিক্সে উঠে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছিল ভারত সেবার। এই ফল যেটা জানায় না, তা হল ঐ ছেলেটির টিমের প্রতি কমিটমেন্ট। কেনিয়ার বিরুদ্ধে অপরাজিত ১৪০ রান করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবাকেই হয়ত খুঁজেছিলেন তিনি সেদিন।

১৮ ডিসেম্বর ২০০৬ তারিখে প্রেম কোহলির ছেলে দিল্লীর হয়ে প্রথম রঞ্জি ট্রফি খেলার সময় তার বাবা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মারা যান। অসুস্থ বাবা বাড়িতে, একথা মনে পড়তে পড়তেই বিপক্ষ বোলারদের বলগুলি ছুটে আসছিল তার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে সেদিন সে লড়ে গিয়েছিল তার ব্যাটটাকে সম্বল করে।

কর্নাটকের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে ৪০ রান করে অপরাজিত ছিলেন ছেলেটি, সঙ্গে অপরাজিত উইকেটরক্ষক পি. বিস্ট। প্রথম ইনিংসে কর্ণাটকের ৪৪৬ রানের জবাবে দিল্লী তখন ধুঁকছিল (১০৩/৫)। সেই দিন খেলা শেষে বাড়িতে ফেরার পর সারারাত একটুও না ঘুমিয়ে তাকে বাবার শয্যার পাশে থাকতে হয় মা আর বোনের সঙ্গে।

তাদের আপ্রাণ চেষ্টাকে হারিয়ে দিয়ে ভোর রাতে মারা যান তার বাবা। বাবাকে হারানোর পর সেই বুকফাটা শোকের মধ্যেই পরের দিন সকালে ফের ব্যাট করতে গিয়েছিলেন ছেলেটি এবং চাপে থাকা তার দলকে ৯০ রানের ইনিংস খেলে উদ্ধারও করেন বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি থেকে। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গতে পি. বিস্ট করেন ১৫৬। দিল্লী প্রথম ইনিংসে তোলে ৩০৮।

স্কোরবোর্ড শুধু এটুকুই জানায় আমাদের। স্কোরবোর্ড যেটা জানায় না তা হল ওই ছেলেটির দলের প্রতি কমিটমেন্ট। এক সময়ে ৫৯/৫ হয়ে যাওয়া দিল্লীকে টেনে তুলতে সাহায্য করেছিল পি. বিস্টের সঙ্গে করা তার ১৫২ রানের জুটি। সেদিন লাঞ্চের ২০মিনিট আগে নতুন বল নিয়ে ছেলেটিকে আঊট করে দেন বি. অখিল।

কট বিহাইন্ড সিদ্ধান্তটি অবশ্য ছিল বিতর্কিত। প্যাভিলিয়নে ফেরার পরে বিশেষ অনুমতি নিয়ে বাড়ি ফিরে বাবার শেষকৃত্য করেছিল ছেলেটি। কর্ণাটকের বিরুদ্ধে ৯০ রান করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবাকেই হয়ত খুঁজেছিলেন তিনি সেদিন।

২০২০ সালের ২০ নভেম্বর হায়দ্রাবাদে মহম্মদ গাউসের মৃত্যুর দিন তার ছেলে ছিলেন সিডনিতে, কোয়ারান্টাইনে। কয়েকদিন আগেই তিনি পৌঁছেন সিডনিতে। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন ভারতীয় টেস্ট স্কোয়াডে, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০২০-২১ সিরিজে খেলার জন্য। অত:পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বাবার শেষকৃত্যে না আসার জন্য। থেকে যান অস্ট্রেলিয়ায়, যেহেতু তার বাবা চাইতেন যে তিনি খেলে দেশের মুখ একদিন উজ্জ্বল করবেন।

অ্যাডিলেডে প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৬ রানে উড়ে যাওয়া ভারত ৮ উইকেটে ম্যাচ হারানোর সঙ্গে হারায় হাত ভেঙে যাওয়া মোহাম্মদ শামিকেও। ফলে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্টে অভিষেক হয় মোহাম্মদ গাউসের ছেলের, এমনিতে যার এটা হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না।

প্রথম ইনিংসে ৪০ রানে দুই উইকেট আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৭ রানে তিন উইকেট, মোট ৭৭ রানে ৫ উইকেট নেন তিনি অভিষেক টেস্টে, আট উইকেটে ম্যাচ জেতে ভারত। ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে ঐতিহাসিক ব্যাটিং প্রতিরোধে পরের টেস্ট ড্র হয় সিডনিতে, এই ম্যাচে ১৫৭ রানে দুই উইকেট (৬৭ রানে এক উইকেট আর ৯০ রানে এক উইকেট) পান তিনি।

আর ব্রিসবেনে চতুর্থ টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৭৭ রানে ১ উইকেট আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৩ রানে পাঁচ উইকেট নিলেন তিনি। সিরিজে তিন টেস্টে ৩৮৪ রান দিয়ে ১৩ উইকেট নিয়ে বাবার ইচ্ছে অনেকটাই পূরণ করেছেন ছেলে, এই সিরিজে।এই পরিসংখ্যান যেটা জানায় না, তা হল ঐ ছেলেটির টিমের প্রতি কমিটমেন্ট। তাই ব্রিসবেনে দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৩ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবাকেই হয়ত খুঁজেছিলেন তিনি।

তাই আজ ব্রিস্টল, দিল্লী আর ব্রিসবেন যেন একাকার হয়ে মিলে গেল এক গন্তব্যে, যার নাম শ্রদ্ধা। আর মোহাম্মদ সিরাজ নিশ্চিতভাবেই শচীন টেন্ডুলকার আর বিরাট কোহলির সঙ্গে মিলে গেলেন এক বিন্দুতে এবং তার পাশাপাশি হয়ত অনন্ত অসীমে মিলিয়ে দিলেন রমেশ টেন্ডুলকর, প্রেম কোহলি আর মোহম্মদ গাউসকে।

ক্রিকেট তো আসলে শুধু একটি খেলা না, ক্রিকেট অশেষ জীবনও। ক্রিকেট তো আসলে শুধু কাড়েই না, মিলিয়েও দেয় অনেক কিছু অযাচিতভাবেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link