More

Social Media

Light
Dark

জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, ফুটবলের সুপারম্যান

সুইডেনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর মালমোর অভিবাসী অধ্যুষিত রোজেনগার্ড শহরতলীতে তখন শুধুই মদ আর জুয়ার আসর। আর সেই বিপথগামী শহরেই আশির দশকে বেড়ে ওঠা জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের। বসনিয়ান বাবা আর ক্রোয়েশিয়ান মায়ের ঘরে জন্ম নেওয়া ইব্রার জন্য জীবনের শুরুর গল্পটা মোটেই সুখকর কিছু ছিল না।

মাত্র দুই বছর বয়সেই বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের সাক্ষী হতে হয় ইব্রাহিমোভিচকে। ইব্রার কঠিন শৈশবের শুরু সেখান থেকেই। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের খারাপ প্রভাব পড়ে ইব্রার মাঝেও। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিতেই রুক্ষ, খিটখিটে আর মেজাজি চরিত্রের স্বভাব ভর করে ইব্রাহিমোভিচের উপর। রোজেনগার্ডের বিপথগামী, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মদের নেশা হয়ে ওঠে তাঁর জীবন।

তবে সেখান থেকে ইব্রার জীবনে মুক্তির পথ খুঁজে দেয় ফুটবল। রোজেনগার্ডে প্রতিদিন ফুটবল খেলতে শুরু করেন ইব্রাহিমোভিচ। রোজেনগার্ডে পাড়ায় পাড়ায় খেলে বেড়াতেন। দুর্দান্ত স্কিল প্রদর্শনীতে এলাকার মধ্যমণিও হয়ে উঠলেন খুব তাড়াতাড়িই। অবশ্য ফুটবলটা ইব্রার রন্ধ্রে ছিল সেই শৈশবকাল থেকেই।

ads

একবার তাঁর পাড়ার দল এফবিকে বলকান ৫-০ তে পিছিয়ে আছে। সে সময়ের ১০ বছর বয়সী ইব্রা সেই ম্যাচের প্রথমার্ধে সুযোগই পেলেন না। কিন্তু দলের দুরবস্থায় দ্বিতীয়ার্ধে ঠিকই নামলেন। এর পর যা করলেন সেটাই একটা ইতিহাস।

হয়তো সেখান থেকেই সুইডিশ ফুটবলের এক নক্ষত্রের আগমন ঘড়ে। পরের অর্ধে একাই ৮ গোল করলেন ইব্রাহিমোভিচ। তাঁর দল জিতলো ৮-৫ গোলে। আর এই ম্যাচের পরই ইব্রাকে নিয়ে মালমোতে রীতিমত শোরগোল পড়ে যায়। কিন্তু জনপ্রিয়তায় তো আর পেট চলে না।

ইব্রার বয়স যখন ১৫, তখন ফুটবল খেলার পাশাপাশি মালমো ডকে কাজ শুরু করলেন তিনি। একটা সময় পরে ফুটবলটাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোচের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত ফুটবলটা আর ছাড়তে পারেননি ইব্রা। ১৭ বছর বয়সে যোগ দিলেন নিজের শহরের সবচেয়ে বড় ক্লাব মালমোতে।

কিন্তু সুসময়ের রেশ না ফুরোতেই নিজের রুক্ষ মেজাজের মাশুল দিতে হলো সেখানে। মালমোর এক ফুটবলারকে মাথায় ঢুস মেরে আঘাত করেছিলেন ইব্রা। আর এতেই ক্লাব ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে মিলেছিল বহিস্কারাদেশ। যদিও তার এক বছর বাদেই ১৯৯৯ সালে ঐ দলের হয়েই পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় ইব্রার।

দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল দিয়ে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করলেও পরের মৌসুমেই ইব্রা মালমোকে তুলে নিয়ে আসেন সুইডেনের প্রথম বিভাগে। ব্যাস। সেখান থেকেই ইব্রাহিমোভিচের ভাগ্যের বাঁক বদল ঘটে যায়। পরের বছরে সে সময়ে সুইডেনের রেকর্ড ট্রান্সফারে রেকর্ডে তিনি পাড়ি জমান ডাচ ক্লাব আয়াক্সে।

আয়াক্সে যোগ দেওয়ার পর সাফল্যও ধরা দিতে থাকে বিদ্যুৎ গতিতে। ডাচ এ ক্লাবের হয়ে দুইবার লিগ জেতেন ইব্রা। আর ততদিনে ইউরোপের ফুটবলে সুইডেশ এ ফুটবলার হটকেক হয়ে উঠেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালে ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসে যোগ দেন ইব্রা।

এরপর ইতালির সাথেই ইব্রার ফুটবল যাত্রা জড়িয়ে যায় ৫ বছরের জন্য। ২০০৬ পর্যন্ত খেলেছিলেন জুভেন্টাসের হয়ে। আর পরের ৩ বছরের জন্য আরেক ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানের শিবিরে ত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন ইব্রাহিমোভিচ।

ইন্টার মিলানের হয়ে সফল অধ্যায় শেষে ইব্রা পাড়ি জমিয়েছিলেন স্পেনে। স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সার হয়ে দুই মৌসুম খেলে আবারো এক মৌসুমের জন্য ইতালিতে ফিরে আসেন ইব্রা। তবে এবার জুভেন্টাস কিংবা ইন্টার নয়, ২০১০-১১ মৌসুমে বার্সেলোনা থেকে ধারে এসে এসি মিলানের হয়ে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। যদিও সেই মৌসুম পরেই ফ্রেঞ্চ ক্লাব পিএসজির হয়ে নাম লেখান তিনি।

আর এই ক্লাবের হয়েই ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ১১৩ টি গোল করেন ইব্রাহোমোভিচ। ইব্রার পদচারণায় মুখরিত হয়েছিল ইংলিশ মাটিও। পিএসজির হয়ে সফল ৪ মৌসুম কাটিয়ে তিনি খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। যদি রেড ডেভিলদের হয়ে খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি তিনি।

তাই দুই মৌসুম পরেই ইব্রাকে খুঁজতে হয় পরের ঠিকানা। এবারের ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্রের লা গ্যালাক্সি। সেখানে নিজের প্রতাপটা দেখালেন ভাল ভাবেই। ৫৬ ম্যাচে করলেন ৫২ গোল। তবে ইব্রার তৃষ্ণাটা ঠিক সেখানে মিটে না। আবারো ফিরলেন ইউরোপের ফুটবল দুনিয়ায়।

এবার তাঁকে আপন করে নিল পুরনো ক্লাব এসি মিলান। আর সেই এসি মিলানের হয়ে ইব্রার বর্ণাঢ্যময় ফুটবল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটল। একই সাথে এই ইব্রার ছোঁয়াতেই বহু দিনের লিগ শিরোপা খরা কাটে এসি মিলানের।

১৯৯৯ সালে সুইডিশ ক্লাব মালমো এফসি দিয়ে শুরু। এরপর নেদারল্যান্ডস, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে শেষ পর্যন্ত ইব্রা তাঁর ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানলেন এসি মিলানে। বিদায়টা যখন বললেন, তখন তাঁর নামের পাশে ৯৮৮ ম্যাচ, ৫৭৩ গোল আর  ৩২ টা শিরোপা।

বয়সটা যখন চল্লিশ পেরিয়েছে, তখন ইব্রা ইউরোপের মাটিতে নিজের জানান দিয়েছেন। তবে ক্যারিয়ার জুড়ে ইব্রার পিছনে বিতর্কও কম ধাওয়া করেনি। তবে তাতে ইব্রার বরাবরই ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। অবশ্য ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ইব্রাকে নিয়ে একটি বিতর্ক বেশ আলোচিত।

আয়াক্সে থাকাকালীন নিজের দলের খেলোয়াড় রাফায়েল ভন ডার ভার্টের সাথে বাগ বিতণ্ডার জেরে তাঁর পা ভেঙ্গে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন ইব্রা। এর কিছুদিন পরে নেদারল্যান্ড এবং সুইডেন একটি ম্যাচে মুখোমুখি হলে ইব্রার ভয়ানক ট্যাকলে ইনজুরড হয়ে মাঠ ছাড়েন ভন ডার ভার্ট।

পরবর্তীতে এই ডাচ ফুটবলার এও দাবি করেছিলেন যে, ইব্রা এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করেছিলেন। যদিও নিজের আত্মজীবনীতে ইব্রাহিমোভিচ সেই ঘটনাকে অনিচ্ছাকৃতই বলেছিলেন।

ফুটবল ক্যারিয়ারে একবার মারামারিতেও জড়িয়েছেন ইব্রাহিমোভিচ। এসি মিলানে থাকাকালীন তাঁর দলের সতীর্থ আমেরিকান ফুটবলার অগুচি অনিউর সাথে একবার হাতাহাতিতে জড়িয়েছিলেন। আর সেই মারামারিতে ইব্রার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল।

সুইডেনের ইতিহাস আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ইব্রার। তবে এই রেকর্ডের আড়ালে একটি বিব্রতকর পরিসংখ্যানও আছে তাঁর নামের পাশে। বিশ্বকাপের মঞ্চে কখনোই গোল করতে পারেননি এই সুইডিশ ফুটবলার।

যাপিত জীবনে জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ বরাবরই আত্মকেন্দ্রিক। নিজেকে ভালোবাসেন। নিজেকে সবার উঁচুতে ভাবতে পছন্দ করেন। এ জন্যই অবসর ভেঙে সুইডেনে ফেরার পর ইব্রা বলেছিলেন, ‘দ্য রিটার্ন অব দ্য গড।’ ১০ বছরে ৫টি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে ৯ বার লিগ জিতেছেন। যেখানেই পা মাড়িয়েছেন, সেখানেই পেয়েছেন সাফল্যের ছোঁয়া। আবার বিতর্ককেও মায়ায় জড়িয়েছেন সন্তোর্পণে।

নিজেকে বরাবরই ‘সুপারম্যান’ বলে দাবি করে এসেছেন ইব্রা। বিদায় বেলায় এসি মিলানের গ্যালারি থেকেও ভেসে উঠলো সেই একই প্ল্যাকার্ড, ‘সুপারম্যান’। রুক্ষ, কাঠিন্যে ভরা ইব্রার চেহারাটাও তাতে ছলছল করে উঠলো।

আবেগ ধরে রাখতে না পেরে দুই হাত দিয়ে হৃদয়ের আকৃতিতে ইব্রাও দর্শকদের প্রতি জানালেন কৃতজ্ঞতা। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সমাপ্তিটা বোধহয় এমনই হওয়া উচিৎ। যেখানে, ইব্রার মতো কাঠিন্যে ভরা মানুষটাকেও এক মুহূর্তের জন্য কোমলতা জাপটে ধরেছিল। সুইডিশ ফুটবল তো বটেই, ফুটবল বিশ্বেই ইব্রা তাই অনন্য এক চরিত্র। যে অনন্যতায় তিনি কিংবদন্তি,  তিনিই সুপারম্যান!

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link