১৯৮৩ সালের ২৫ জুন। লর্ডসের মায়াবী দুপুর। তৃতীয় বিশ্বকাপের সোনালী স্মারকটি পরপর তৃতীয় বার নিজেদের করায়ত্ত করার প্রচেষ্টায় তখনকার ক্রিকেটের রাজ্যপাট নিজেদের আয়ত্তে রাখা একজন পরাক্রমী রাজা স্যার ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি স্বপ্নসঞ্চারী, তখনকার দিনে প্রায় পরাভূত ভারতবর্ষ যাদের অতীত ইতিহাসই নয়, সাম্প্রতিক অতীতও কোনো আশার প্রদীপ জ্বালাতে পারছিল না।
আগের দুটি বিশ্বকাপে কেবলমাত্র একটি জয়, আবার ওই বিশ্বকাপের প্রায় আগে আগেই অধিনায়ক বদল, সব মিলিয়ে আশার কিরণ তেমন কিছুই ছিল না। ‘কিন্তু এই বিশ্বকাপ যে ভারতীয় ক্রিকেটকে নতুন রূপরেখা দেওয়ার বিশ্বকাপ’ – এই ব্রতে ব্রতী যোদ্ধাদের অসাধারণ লড়াইয়ে ২৫শে জুনের লর্ডসের বাইশগজে সবাই।
না, সোনালী স্মারকের লড়াইয়ের শুরুটা রূপকথার মতো হয়নি। প্রথম ইনিংসের পর স্কোরবোর্ডে ১৮৩ রান তুলেও বিপক্ষ দলের অসাধারণ ব্যাটসম্যানদের কথা জেনেও লড়াকু অধিনায়কের লড়াইয়ের ভাগীদার হয়ে এগারো জনের সেই লড়াই সেদিনের পর থেকে আজও ভারতীয় ক্রিকেটের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
যাই হোক সেদিনের সেই ‘সোনালী স্মারক’ জয়ের নায়ক ছিল সবাই কিন্তু মধ্যমনি ছিলেন একজনই। তিনি আর কেউ নন, ২৪ বছর বয়সী এক দামাল, অকুতোভয় ‘হরিয়ানার হ্যারিকেন’ তথা কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ।
তখন ভারতীয় ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন তখন ভারতীয় ক্রিকেটে বোলিংয়ে কেবল স্পিন বোলিংয়ের রাজত্ব। তখনকার সময়ে কাজ চালানোর মতো পেস বোলারদের (বেশিরভাগ সময় দলের প্রধান ব্যাটসম্যানরাই) কাজ বলের পালিশ তুলে ফেলে স্পিনারদের কাজ সহজ করে দেওয়া। বহুদিন ধরে এটাই ভারতীয় ক্রিকেটের নীতি ছিল যার বক্ষমূলে প্রথম আঘাত হেনেছিলেন কপিল দেব। নিজের অভিষেক টেস্টেই পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের বাধ্য করেন হেলমেট মাথায় তুলতে।
এমন দৃশ্য ভারতীয় সমর্থকদের চমকিত করেছিল প্রবলভাবে। একজন তরুণ ‘লম্বা ও ছন্দময়’ রান-আপের সাথে বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের নিজের গতি ও স্যুইংয়ে নাস্তানাবুদ ও ব্যতিব্যাস্ত করে তুলছে এমন দৃশ্য কল্পনাতীত ছিল। আর এই দৃশ্যই তখনকার ও পরবর্তী সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটে বিবর্তন এনেছিল যার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ব্যাটিংকে হয়তো তেমন গুরুত্ব দিতেন না। তবে নিজেই ধীরে ধীরে নিজের ব্যাটিংয়ের গুরুত্ব বুঝেছিলেন। ১৯৮৩ এর বিশ্বকাপেই জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে সেই মহাকাব্যিক ইনিংসটি হয়তো যেকোনো বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা তথা ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবে স্থান পাবে।
সেই সময়ের বিশ্ববিখ্যাত অলরাউন্ডার তথা ইমরান খান, রিচার্ড হ্যাডলি ও ইয়ান বোথামের সমগোত্রীয় হয়ে ওঠা কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ কাজ ছিল না, কিন্তু সেই দূরহ কাজকেই সহজ করে দেখিয়েছেন বারবার। আর অধিনায়ক হিসেবে যেভাবে ভারতীয় ক্রিকেটের রূপরেখা পাল্টে দিয়েছেন এর জন্য ভারতীয় ক্রিকেট সারাজীবন তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
২০০২ সালে উইজডেন থেকে যখন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বিগত শতাব্দীর সেরা ভারতীয় ক্রিকেটার নির্বাচন করার তখন কাজটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না। যুগে যুগে ভারতে তারকা ক্রিকেটার কম আসেনি। এমন সব তারকা তথা সুনীল গাভাস্কার, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, অনিল কুম্বলে, বিষান সিং বেদি, বিজয় হাজারে, শচীন টেন্ডুলকারদের পিছনে ফেলে সেরা হয়েছিলেন সেই হরিয়ানার হ্যারিকেনই আর এতেই অনুমান করা যায় ভারতীয় ক্রিকেটে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব কতখানি।