More

Social Media

Light
Dark

‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ ক্রিকেট অধিনায়কের মন

লর্ডসের ব্যালকনিতে এক ভারতীয় অধিনায়কের বুনো উল্লাস। গায়ের জার্সি খুলে উন্মত্তভাবে হাওয়ায় দুলিয়ে ইংলিশদের দূর্গে সে উল্লাসের দৃশ্য আজও শিহরণ জাগায় অনেক ক্রিকেটপ্রেমীর মনে। দৃশ্যপটটা ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালের, যেখানে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নিয়েছিল ভারত। আর অধিনায়কটা কে, তা বোধহয় এতক্ষণে বুঝে ফেলার কথা। তিনি সৌরভ গাঙ্গুলি।

আইসিসি’র কোনো শিরোপা জয়ের মুহূর্ত নয়। তারপরও সেবার লর্ডসের মাটিতে ভারতীয় ক্রিকেটারদের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের কারণ কি? প্রথমত, ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডকেই হারানোর ঘটনা। দ্বিতীয়ত, ইংল্যান্ডের দেয়া ৩২৫ রানের রানপাহাড় টপকানো। ২০০২ সালের ম্যাচ।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উপমহাদেশের একটি দল সেই পাহাড়সম লক্ষ্যই টপকে যাবে ইংলিশদেরই মাটিতে– এমনটা যে তখন পর্যন্ত ভাবনার বেড়াজালেই বন্দী ছিল। স্বভাববিরূদ্ধ এমন উদযাপনের জন্য তাই বোধহয় আর কোনো ‘কারণ’ খোঁজার কোনো প্রয়োজন নেই।

ads

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, ২০০০ সালের শুরুর দিকটাকে ভারতের ক্রিকেটের এক প্রকার অন্ধকার সময়ই বলা হয়ে থাকে। ফিক্সিংয়ের কালো থাবায় সে সময় বিষিয়ে উঠেছিল ভারতের ক্রিকেট। ফিক্সিংয়ের সাথে নাম জড়িয়ে যায় সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন, অজয় শর্মা, মনোজ প্রভাকর আর অজয় জাদেজার।

আজহারের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার তখনকার অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়ের টেলিফোন কথোপকথনের প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০০ সালে। এরপর আজহার ও অজয় শর্মাকে আজীবন আর প্রভাকর ও জাদেজাকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।

এমতাবস্থায় ভারতীয় ক্রিকেটে একটা ভগ্নদশার সৃষ্টি হয়। শচীন টেন্ডুলকার তখন দলের অধিনায়ক। কিন্তু চলমান সেই নৈরাজ্যময় অধ্যায়ে এ ব্যাটিং কিংবদন্তি আর নিজেকে নিয়ে পেরে উঠছিলেন না। অধিনায়ক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন কিছুদিনের মধ্যেই। শচীনের পর দলের অধিনায়ক করা হয় সৌরভ গাঙ্গুলীকে। আর এরপর থেকেই ভারতের ক্রিকেটে আধার সরিয়ে কিছুটা আলোর রেখা ভেসে ওঠে।

ভারতীয় ক্রিকেটের অধিনায়কদের ইতিহাস বিবেচনা করলে, মহেন্দ্র সিং ধোনিই এগিয়ে থাকবেন। আইসিসি’র সম্ভাব্য সকল শিরোপা তাঁর নেতৃত্বেই জিতেছে ভারত। তাই তাঁকে মোটেই অ-গ্রাহ্য করা যায় না। তবে ভারতের ক্রিকেটকে মধ্যম সারির এক দল থেকে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বটা ছিল সৌরভ গাঙ্গুলীর। তাঁর অধিনায়কত্বেই ২০০০ সালের সে কালো অধ্যায় পেরিয়ে নিয়মিত জিততে শুরু করে ভারত।

সৌরভ অধিনায়ক হবার পরই মূলত বিদেশের মাটিতেও চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে শুরু করে ভারত। ২০০২,২০০৩ এবং ২০০৪ সাল, টানা তিন বছরে যথাক্রমে ইংল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়া, এরপর পাকিস্থানকে তাদেরই ঘরের মাঠে হারিয়ে বিদেশের মাটিতে নিজেদের আধিপত্য দেখায় সৌরভের।

সৌরভের অধিনায়কত্বে ভারতীয় দল আইসিসি’র কোনো শিরোপা জিততে পারেনি। ২০০৩ বিশ্বকাপে খুব কাছে গিয়েও ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে ভারতের শিরোপাস্বপ্ন ভঙ্গ হয়। তবে শিরোপা না জেতা, সৌরভের অধীনেই ভারত নতুন শক্তিতে দুর্দান্ত এক দল হয়ে উঠেছিল।

এমন সাফল্যের পিছনে অবশ্য সৌরভের বেশ কিছু নিজস্ব কৌশলও ছিল। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পরই তিনি দল নির্বাচনে একটা প্রভাব রাখা শুরু করেন। কোনো ক্রিকেটারকে সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর একটা শর্ত ছিল—পর্যাপ্ত সুযোগ না দিয়ে কোনোভাবেই কাউকে দল থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। গাঙ্গুলীর সেই ভাবনায়, ধোনি নিজেও তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে একটা লাইফলাইন পেয়েছিলেন।

ধোনি যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখলেন, সেই শুরুর গল্পটা হতাশারই ছিল। ম্যাচের পর ম্যাচ রান পাচ্ছিলেন না। এমন সময়ে ধোনি দল থেকে বাদ পড়তেই পারতেন। কিন্তু গাঙ্গুলি তাঁকে ব্যাটিং প্রমোশন দিয়ে ফর্মে ফেরার সুযোগ দিয়েছিলেন। আর এভাবেই ধোনি ভারতীয় দলে নিজের জায়গা পোক্ত করেছিলেন।

একই ভাবে, একবার অনীল কুম্বলেকে দল থেকে বাদ দিতে চেয়েছিল সে সময়ের নির্বাচকরা। কিন্তু গাঙ্গুলির অধীনেই দলে রাখা হয়েছিল এ লেগ স্পিনারকে। গাঙ্গুলির সে আস্থার প্রতিদান দিয়ে পরেই সিরিজেই সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করেছিলেন কুম্বলে। ক্রিকেটারদের এভাবে নির্ভার করে রাখার কারণেই সৌরভ গাঙ্গুলির সাফল্যের হার বাড়তে থাকে। আর এভাবেই আমূলে পাল্টে যেতে থাকে ভারতের ক্রিকেট।

ভারতের হয়ে অধিনায়কত্বের সময়টা হয়তো আর দীর্ঘ হতে পারতো প্রিন্স অব ক্যালকাটার জন্য। কিন্তু সে সময়ের ভারতীয় দলের কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে সম্পর্কের বৈরীতায় অধিনায়কত্ব হারাতে হয় তাকে। এর একটা সময় পর জাতীয় দল থেকেও বাদ পড়েন তিনি। ফলত, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেও এর কিছু দিন পর বিদায় জানিয়ে দেন এ ক্রিকেটার।

তবে গ্রেগ চ্যাপেল ঐ সময় সৌরভের সাথে একটা নোংরা খেলাই খেলেছিলেন বটে। ভারত ম্যাচ জিতেছে, গাঙ্গুলিও সেঞ্চুরি পেয়েছেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে পরের টেস্টে বাদ পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনার উদ্ভব হয় গাঙ্গুলীকে দিয়েই। গ্রেগ চ্যাপেলের এমন চক্ষুশূল হওয়ার কারণেই মূলত সৌরভের ক্যারিয়ারে সে সময় খুব বাজে ভাবে প্রভাবিত হয়।

২০০৪ এর পরে নিজেও ফর্মহীনতায় পড়ে দল থেকে বাদ পড়ে যান। তবে একটা সময় পর ফিরেছিলেন, সেঞ্চুরিও করেছিলেন। কিন্তু সৌরভের এমন প্রত্যাবর্তনও গ্রেগ চ্যাপেলকে তাঁর একরোখা সিদ্ধান্তের রদবদল আনতে পারেনি।

গাঙ্গুলিকে নিয়ে গ্রেগ চ্যাপেল কতটা একরোখা ছিলেন তার প্রমাণ মেলে শচীন টেন্ডুলকারের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’তে। তাঁর ভাষ্যমতে, গ্রেগ চ্যাপেল সে সময় দলের মধ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিলেন। গাঙ্গুলির সঙ্গে চ্যাপেল যা করেছিলেন তা মোটেও ঠিক ছিল না।

সৌরভ গাঙ্গলীর অধিনায়কত্বের ক্যারিয়ারটা দীর্ঘায়িত হতেই পারতো। অন্তত সে সময় তাঁর অধীনে ভারত জয়ের ধারাতেই ছিল। কিন্তু হঠাতই এক অজি কোচের আগমনে সব এলোমেলো যায়। গাঙ্গুলী ব্রাত্য হলেন, ভারতীয় ক্রিকেটও তেমন সফলতা পেল না।

ক্রিকেটারদের যতই ছড়ি ঘোরান, সে সময় ভারতের শিরোপার মুকুটে কোনো পালক যোগ করতে পারেননি গ্রেগ চ্যাপেল। বরং ঐ সময়ে এক ভারতীয় ক্রিকেটে একটা কালো দাগই লেপে দিয়েছিলেন তিনি।

স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারি, সেই সাথে ক্রমাগত ব্যর্থতায় হারের চক্রে ধুঁকতে থাকা ভারত যখন ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ে ৮ এ থেকে প্রায় তলানিতে অবস্থান করছে,  তখন দলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। এরপর শুধুই ইতিহাস রচনা করেছেন বাংলার ক্রিকেটের এ যুবরাজ।

তাঁর অধীনেই ৮ থেকে ওয়ানডের র‍্যাঙ্কিংয়ে দুই নম্বরে উঠে আসে ভারত। টেস্ট ক্রিকেটেও পিছিয়ে ছিলেন কোথায়। তাঁর নেতৃত্বে লাল বলের ক্রিকেটে ভারত উঠে এসেছিল তিনে। নিজের অধিনায়কত্বের ক্যারিয়ারে ভারত হয়তো তাঁর অধীনে বড় কোনো শিরোপা জেতেনি। কিন্তু, ভারতের ক্রিকেট খোলনলচে বদলে দেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন এই অধিনায়ক। এক দু:সহ সময় ভারত পাড়ি দিয়েছিল তাঁর অধীনেই!

ক্রিকেটে ভারতের নতুনভাবে উঠে দাঁড়ানোর যাত্রাটা শুরু হয় গাঙ্গুলির নেতৃত্বেই। ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে তাই সেরা অধিনায়কদের কাতারে নিশ্চিতভাবেই থাকবে সৌরভ গাঙ্গুলীর নামটা।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link