More

Social Media

Light
Dark

ভারতীয় ক্রিকেট ও নব্বই পরবর্তী অধিনায়ক কেচ্ছা

প্রথমেই বলে রাখি, এই আলোচনার সবটাই আমার নিজস্ব অবজার্ভেশন। আমার সঙ্গে মতের মিল না হলে যুক্তি-প্রতিযুক্তি দিয়ে আলোচনা চলবে। শুধু খেলা পর্যবেক্ষক নয়, মিডিয়ায় আসা ইন্টার্ভিউ, ক্রিকেট সংক্রান্ত বই থেকেও অনেক তথ্য পেয়ে নিজের মতো করে সাজাচ্ছি। প্রথমেই আসি মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের কথায়। ক্যাপ্টেন আজহারকে যখন থেকে দেখছি তখন বয়স খুব কম ১৯৯৮ থেকে।

তার আগে খুব বেশি খেলা বুঝতাম না। তখন ১০ও পেরোইনি। ঢাকাতে একটা ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৩১৪ তাড়া করতে গিয়ে সৌরভ রবিন সিং এর বদান্যতায় ইন্ডিয়া কাপ পায়। সেই উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচটাই ক্রিকেটের প্রতি আমার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। ক্যাপ্টেন কি তখন অল্প অল্প বুঝতে শিখি। আজহারকে ভালো লাগত না। কিন্তু পরে জানলাম ইন্ডিয়া একবার ওয়ানডেতে র‍্যাঙ্কিংয়ে নাম্বার ওয়ান হয়েছিল আজহারের সময়।

নব্বইয়ের দশকে আমরা যারা আজহারের বেটিং সংক্রান্ত খবর জানলাম তারা কখনই আজহারকে পছন্দ করিনি। পরে ওনার খেলার টেলিকাস্ট দেখে, ইন্টার্ভিউ পড়ে ওনার ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞা সম্মন্ধে অবগত হই। আর এখন এ কথা বলতে অসুবিধা নেই আজহার ভারতের সফল ক্যাপ্টেনই ছিলেন। আজহার টেকনিক্যালি ক্যাপ্টেন্সি করতে পারতেন। মাথাটা বেশ ঠাণ্ডা থাকত।

ads

আলাদাই সোয়্যাগ নিয়ে মাঠে নামতেন। পরবর্তী ক্যাপ্টেন শচীন টেন্ডুলকার সেরকম ছিলেন না। সচিন মনে করতেন তিনি যেমন ক্রিকেটের প্রতি প্যাশনেট বাকিরাও তাই। তিনি সেরাটা আশা করতেন প্লেয়ারদের কাছে। কিন্তু একজন অধিনায়ক সেরাটা বের করে আনতে জানে। শচিন সেটা পারেন নি। পারেন নি বলাটা ভুল। সৌরভ গাঙ্গুলিকে ওপেনার বানিয়েছিলেন শচীনই। সৌরভ পরে বলেছিলেন টিম ভালো না হলে ক্যাপ্টেন ভালো হয় না।

শচীনকে যুবা দ্রাবিড় গাঙ্গুলিরা সেটা দিতে পারেননি যেটা ক্যাপ্টেন আশা করতেন। কথাটা আমার মতে সর্বৈব সঠিক নয়। টেকনিক্যাল জ্ঞানও ক্যাপ্টেন্সির বড় পার্ট। কোন প্লেয়ারকে কিভাবে ব্যবহার করব। কীভাবে খেলাব। একটা টেস্টে সচিন শ্রীনাথকে একপ্রান্ত থেকে টানা বল করিয়ে যাচ্ছিলেন। বোলার শেষে হাঁপিয়ে একশা। কোথায় কোন বদলটা ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে শচীন অধিনায়ক না হলে যেটা বুঝতে পারতেন অধিনায়ক হবার চাপ শেটা বুঝতে দিত না। শচীনের ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞাকে তাই ছোট করার জায়গা নেই। পরবর্তী অধিনায়কদের সচিনের ইনপুট ভীষণ কাজে দিয়েছিল। ওনার রেফারেই প্রথমে সৌরভ ও পরে ধোনির মতো অধিনায়ককে ভারত পায়।

ক্রমাগত ম্যাচ হেরে চলায় আর বেটিং পরবর্তী ভারতীয় ক্রিকেটের হাল সামলানোর দায়িত্ব সচিন নিতে চান নি। বেটিং প্রসঙ্গ আসার আগেই সৌরভ ক্যাপ্টেন হন। প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে অধিনায়কত্বের পরে বেটিং প্রসঙ্গ সামনে আসে। তারপরের ইতিহাস সকলের জানা। সৌরভ প্রথম যেটা করলেন তরুণ ক্রিকেটারদের সুযোগ দিলেন। কোনো রিজিওনাল পলিটিক্স এর মধ্যে না গিয়ে সারা ভারত থেকে ট্যালেন্ট তুলে আনলেন। নিজের টিম বানালেন।

তরুণদের জন্য লড়ে গেলেন নির্বাচকদের সঙ্গে। ফলাফল নতুন টিম ইন্ডিয়া। একসূত্রে বাঁধা। যারা বাঘের মতো। হারার আগে হারবে না। সৌরভ খুব ধীরেসুস্থে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতেন। ম্যাচ রিডিং ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তখন অষ্ট্রেলিয়াকে ২০০০ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে হ্যাচকা টানে থামালেন ও ফাইনালে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে। ২০০২ সালেও যুগ্ম বিজয়ী হলেন। ২০০২ এ ন্যাটওয়েস্ট জিতলেন। ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনাল।

এগুলো এমন সময়ে হচ্ছে যখন ভারতীয় ক্রিকেট সম্মন্ধে দর্শকদের আশা তলানিতে। নতুন একটা প্রজন্ম উঠে এলো। যারা আরও একদশক বিশ্বক্রিকেট কাঁপাবেন। এই প্রজন্ম সেই সময়ের নেতা সৌরভকে দেখেনি। তাই তারা বুঝবে না, সৌরভ কি ও কেন। জন রাইট-সৌরভ গাঙ্গুলি জুটি যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে গ্রেগ চ্যাপেল-রাহুল দ্রাবিড় সেই লেগাসি ধরতে পারেন নি।

২০০৭ এ সিনিয়ররা যখন টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে নাম তুলে নিল তখন আনকোরা একটা ছেলে উঠে এলো। ঝাঁকড়াচুলের মহেন্দ্র সিং ধোনি। সেই টিমে কোনো সিনিয়র ছিল না। ছেলেটা ক্যাপ্টেন্সির ধরণ অন্য সবার থেকে আলাদা। সৌরভের জোশ ছিল মহাসামুদ্রিক ঢেউয়ের মতো। এই আনকোরা ছেলে সমুদ্রের গভীরতার প্রশান্তি নিয়ে যেন মাঠে বিরাজমান। তার মুখে ভালো মন্দ জয় পরাজয় কোনো কিছুরই কোনো আবেগের ছাপই ফুটে ওঠে না। তার কোনো রিয়্যাকশন নেই কোথাও।

দর্শকের মতো বিরোধী টিমের প্লেয়াররাও অবাক হয়ত। ধোনি দেখালেন নিজে ভাবব না অপোনেন্টকে ভাবিয়ে ভুল করাবো। আমি কি ভাবছি ধরতেই দেব না। এই স্নায়োবিক শীতলতা ভারতীয় ক্রিকেট আগে দেখেনি। সৌরভ স্টিভের মনোস্তাত্ত্বিক লড়াই আগে উপভোগ করেছি, সেখানে ছিল জোশ। এই ছেলেটার জোশের লেবেল অন্য জায়গায়। হার জিত সবেতেই তিনি নির্বিকার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মতো।

তবে সৌরভ যে জায়গাগুলো ছুঁয়েছিলেন ধোনি সেগুলোয় আনলেন প্রসারতা। সৌরভ আইসিসির ফাইনালে তিনবার তুলেছিলেন, ধোনি জিতলেন তিনটে ট্রফি। সৌরভ ওয়ান্ডেতে বিদেশে জিততে শুরু করেছিলেন, অষ্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিলেন তাদের মাঠে, ধোনি সেখানে সিরিজ জিতলেন। ধোনি হোঁচট খেয়েছেন বিদেশে টেস্ট সিরিজগুলোতে।

সৌরভের অধরাগুলো ধোনি যেখানে জয় করলেন ধোনির অ-প্রাপ্তিগুলোর জায়গা থেকে উঠে এলেন বিরাট। বহুদিন পরে সৌরভের মতো বুক চিতিয়ে বিদেশে খেলার অভ্যাসটা সামনে থেকে করে দেখালেন। সমানে সমানে টক্কর, শুধু দেশের মাটি নয় বিদেশেও জিতব। টেস্ট রেকর্ডের হিসেবে বিরাট পূর্বসূরিদের ছাপিয়ে গেলেও আমার মতে ওয়ানডেতে দ্বিপাক্ষিক ছাড়া নক আউট টুর্নামেন্টে বিরাটের অধিনায়কত্বের সেই ধার দেখা যায় নি। বিরাট বীর, সামনে থেকে লড়তে ভালোবাসেন।

ইমোশনের বহি:প্রকাশ করেন। কিন্তু কোথাও গিয়ে টেকনিক্যালি ভুল। ভুল ডি আর এস নিয়েছেন বারেবারে। কোথায় কখন কাকে খেলাবেন ঠিক করতে পারেননি। সচিনের মতো সেরা দিতেন, সেরাটা সকলের কাছে আশা করতেন কিন্তু নক আউটে সেরাটা বের করে আনতে পারতেন না। বিরাটের ক্রিকেটীয় প্রতিভা নিয়ে কথা হয় না। কিন্তু ক্যাপ্টেন্সির টেকনিকাল ভুল বারবার চোখে পড়ে সে আইপিএল হোক বা ওয়ানডে। সৌরভ বা ধোনির ছোট্ট চাল যেখানে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিত বিরাটের ক্যাপ্টেন্সি সেটা সবসময় করে দেখাতে পারেনি।

বিরাট খাতায় কলমে এগিয়ে সকলের থেকে। কিন্তু সৌরভ ধোনি যেমন জন্মগত নেতা, বিরাটকে আমার কখনও সেরকম মনে হয় নি। বিরাট অনেকটা কর্পোরেট বসের মতো। অনেস্ট। সে আশা করে যে,যেমন সবাইকে তেমন হতে হবে। দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোতে সহজ ক্যালকুলেশন থাকত পাঁচটার মধ্যে তিনটে জিততে হবে। চাপ এখানে কম। কিন্তু যখনই নক আউট পর্যায় তখন বিরাটের ক্যালকুলেশন কাজ করেনি। নক আউট পরিস্থিতিতেও বিরাটের ক্যাপ্টেন্সি পারফরমেন্স খারাপ। ধোনি বারবার নক আঊট পরিস্থিতি থেকে উতরে গিয়ে কাপ জিতে দেখিয়েছে। সে বারবার করেছে। কিন্তু বিরাটের ক্ষেত্রে সেটা কম।

স্বভাবগত দিক থেকেও তিন নেতা ছিলেন তিন রকম। অথচ আশ্চর্য কথা, আজ তিনজনের পারস্পারিক সম্পর্ক নিয়ে বহু কথাও হয়। তিনজনই তাদের সময়ে সেরা আর তিনজনেরই সর্বোচ্চ ওয়ানডে স্কোর ১৮৩। সকল মনোমালিন্য সরিয়ে ভবিষ্যতে তাদের আবার একসাথে দেখার আশা রাখব আমরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link