More

Social Media

Light
Dark

‘আট কোটি টাকার প্রস্তাব পেয়েও আইসিএলে যাইনি’

বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মাশরাফি বিন মুর্তজার অবসর। দেশের সবচেয়ে সফল এই ওয়ানডে অধিনায়ক সম্প্রতি তাঁর অবসর পরিকল্পনা, বিশ্বকাপের সময় লর্ডসে অবসর না নিতে পারা এবং খেলোয়াড়দের আন্দোলনে সশরীরে উপস্থিত না থাকার বিষয়গুলো নিয়ে ক্রিকেটভিত্তিক গণমাধ্যম ক্রিকবাজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই সাক্ষাৎকারের সম্পূর্ণটা এখানে তুলে ধরা হলো।

আপনার অবসর ভাবনা সম্পর্কে বলুন? বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আপনি দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নেই।

আমার মূল পরিকল্পনা হচ্ছে ক্রিকেট খেলা। কারো পরিকল্পনায় কেউ থাকে না৷ আসলে এটা হচ্ছে কে কী পরিকল্পনা করছে তা জানা বা বুঝার বিষয়। অবশ্যই একটা বিষয় আমার পরিষ্কার করা দরকার যে ২০১৯ বিশ্বকাপের আগের তিন সিরিজে আমি সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলাম। যদিও টুর্নামেন্টটি আমার জন্য কল্পনাতীতভাবে খারাপ ছিল। এখন এটা স্বাভাবিক সবাই আমাকে একটা টুর্নামেন্ট দিয়ে বিচার করবে। আমি এতে দ্বিমত পোষণ করব না। তবে আমি নিজেকে কীভাবে দেখছি তা আমার ওপর নির্ভর করে। যেমনটা আগে বলেছি, বিশ্বকাপের আগের তিন সিরিজে আমি সর্বোচ্চ উইকেটধারী ছিলাম।

ads

বোলার হিসেবে দলকে কিছু দেয়ার সামর্থ্য প্রমাণ করতেই কি আপনি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিয়েছেন? এবং আপনি হয়তো বা ‘অটোমেটিক চয়েজ’ নন…

শেষ বলে কিছু নেই। আপনি যদি সুষম প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র তৈরি করতে না পারেন তাহলে আপনি কোন পরিকল্পনাকারীই নন। আমি যদি ভাল করি তবে আমাকে অবশ্যই একটি সুযোগ দেয়া উচিত। যদি তারা সেটা না দেয় তবে তাদের পরিকল্পনাটি সঠিক নয়। আমি জানি না ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ আবারও শুরু হবে কি না (করোনা মহামারীর জন্য)। যদি শুরু হয় তবে প্রিমিয়ার লিগটাই হবে আমার লক্ষ্য। যদি না হয় তবে সামনে যা থাকবে তা-ই হবে আমার লক্ষ্য। আমি জানি না বিসিবির কী ব্যবস্থা আছে এবং সব খেলোয়াড় কোথায় খেলবে। আমার সামনে যে সুযোগই আসুক না কেন, আমি সেটা লুফে নেবার চেষ্টা করব।

হঠাৎ কেন ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করলেন?

পরবর্তী বিশ্বকাপ আসতে এখনও তিন বছরের কিছু বেশি সময় বাকি। তাই বিশ্বকাপের জন্য এখন থেকে যদি একজন উপযুক্ত অধিনায়ককে নিযুক্ত করতে পারে বিসিবি তবে তা বাংলাদেশ দলের জন্যই ভাল হবে। খেলোয়াড়ের দিক দিয়ে বিষয়টি ভিন্ন। ২০১১ বিশ্বকাপের মাত্র দু’মাস আগে ইনজুরির জন্য টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাই আমি। সুতরাং একজন খেলোয়াড়ের খেলার ক্ষেত্রে কোনও নিশ্চয়তা নেই৷ এমনকি অধিনায়কেরও ইনজুরি হতে পারে এবং সেটা আরেকটি ভিন্ন বিষয়। তবে ক্রিকেট বোর্ড সবসময় তাদের সেরা অধিনায়ককে দলের জন্য চেয়েছে। সেক্ষেত্রে এটি একটি ভাল সুযোগ। নতুন অধিনায়কের হাতে প্রচুর সময়  রয়েছে। সাকিবও লাইনে আছে। ইনশাআল্লাহ তামিম অনেক ভাল করবে বলে আমার ধারণা। আমি খুব আশাবাদী। আমি আশা করছি তামিম ভাল করবে। কিন্তু সে যদি তা করতে না পারে তবে বোর্ড হয়তো অন্যান্য বিকল্পের কথা ভাববে। এক্ষেত্রে বোর্ডও পর্যাপ্ত সময় পাবে যেহেতু তিন বছরের মত দীর্ঘ সময় তাদের হাতে আছে। তাই আমার সিদ্ধান্ত ওই জিনিসগুলির ওপর ভিত্তি করে ছিল।

আপনি কি মনে করেন আপনার রাজনৈতিক পরিচয় আপনার খেলোয়াড়ি পরিচয়কে ম্লান করেছে?

প্রত্যেকে নিজের মতো করে ভাবতে পারে। আমি কী করছি তা সম্পর্কে আমার মন খুব পরিষ্কার। দেখুন, রাজনীতিতে যোগদানের পূর্বে যে সিরিজটি আমরা খেলি তাতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করি আমি। একইভাবে রাজনীতিতে যোগ দেবার পরের দুই সিরিজেও আমি সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হই। হঠাৎ করে একটি টুর্নামেন্টে খারাপ করায় কি খারাপ খেলোয়াড় হয়ে গেলাম আমি? আমার জন্য এটা ঠিক আছে যেহেতু অন্যরা কী ভাবছে তা আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না এবং আমি কেবল তা-ই বলতে পারি যা আমি ভাবছি।

বিশ্বকাপের সময় লর্ডসে অবসর নেওয়ার সুযোগ ছিল আপনার…

বিশ্বকাপে আমাদের সর্বশেষ ম্যাচটির পর আমি অবসর নিতে চেয়েছিলাম। তবে তা হয়নি। সেদিন কেন তা পারিনি সে বিষয়ে বিশদ বিবরণে যেতে চাচ্ছি না। তবে ইংল্যান্ডে আমি আমার অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের কাছে ছেড়ে দিয়েছি। আমি যা অনুভব করি তা হলো, আল্লাহ যা কিছু করেন তা সবই কল্যাণের জন্য।

বিসিবি কি ঘরের মাটিতে আপনার জন্য বিদায়ী ম্যাচের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল?

এটাই পয়েন্ট। সত্যি কথা বলতে গেলে আমাকে বিদায় দিতে খুব তাড়াহুড়ো করা হয়েছিল এবং এটা অবশ্যই আমাকে ব্যথিত করেছিল। প্রথমত, আমাকে বিদায় জানাতে তাদের একটি ম্যাচ আয়োজন করার ছিল এবং সেটা কোন সাধারণ ম্যাচ ছিল না। একটি সাধারণ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ তেমন কিছু না। কিন্তু তড়িঘড়ি করে একটি বিশেষ ম্যাচ আয়োজন করাটা অন্য ব্যাপার।

দ্বিতীয়ত, সে ম্যাচের জন্য তারা দুই কোটি টাকা খরচ করতে প্রস্তুত ছিল৷ নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা মোটেও সঠিক ছিল না যেখানে আমাদের প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেটারদের পর্যাপ্ত বেতন জোটে না৷

বিসিবির উদ্দেশ্যগুলি জানানোর জন্য গণমাধ্যমকে বেছে নেওয়াটা কি আপনার জন্য হতাশাজনক ছিল?

না, ঘটানাটা আসলে পুরোপুরি এমন ছিল না। পাপন ভাই (বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান) এ বিষয়ে (অবসর প্রসঙ্গে) আমার সাথে কথা বলেছিলেন। পাপন ভাই আরও বলেছিলেন যে আমি ব্যতীত অন্য কারো সাথে তিনি এ প্রসঙ্গে কথা বলবেন না। আমাকে বারবার ফোন করে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিলেন তিনি। তখন তাকে বলেছিলাম আমি বিপিএল অবধি খেলতে চাই। তারপর তিনি গণমাধ্যমে এ কথা বলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে কথা বলার জন্য সবাইকে রুম ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছেন। সমস্যাটা হলো যারা সেখানে ছিলেন না তারা গুজব ছড়িয়েছেন। আমার এবং পাপন ভাইয়ের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছিল সে সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না।

তারা আমার বেতন নিয়ে কথা বলেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, কেন বোর্ড এমন কাউকে বেতন দিবে যার কাছ থেকে বিনিময়ে কিছু মিলবে না? আমি কি টাকার কথা চিন্তা করে ১৮ বছর ধরে ক্রিকেট খেলেছি? আমি যদি টাকার কথা চিন্তা করি তবে আমার জন্য তখন অনেক সুযোগ ছিল। টাকার জন্য আমি ক্রিকেট খেলিনি। সবচেয়ে খারাপ যেটা ঘটেছিল সেটা হলো, তারা বলেছিলেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল নাকি সাড়ে নয়জন খেলোয়াড় নিয়ে খেলেছিল। আপনি কি মনে করেন আমি এটার প্রাপ্য? হতে পারে তারা (বোর্ড) আমাকে আরও ভালভাবে বিদায় দিতে চেয়েছিলেন। তবে আপনাকে অবশ্যই আমার দিকটি দেখতে হবে। আমার শ্রীলঙ্কা সফরে যাবার বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। আমি যদি চোট না পেতাম তবে দলের সাথে শ্রীলঙ্কায় খেলতে যেতাম।

তারপর হঠাৎ করে আমাকে বিদায় দেওয়ার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি শুধু জানি যে ক্রিকেটের জন্য নিজের জীবনকে সঁপে দিয়েছি। যদিও নানা কষ্টে বারবার আহত হয়েছি এবং আমার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। টাকাই যদি প্রধান লক্ষ্য হতো তবে আমি অনেক কিছুই করতে পারতাম বিশেষ করে যখন বহু ইনজুরিতে আমার ক্যারিয়ারে ব্যাঘাত ঘটেছিল। আমি আট কোটি টাকার প্রস্তাব পেয়েও আইসিএল খেলতে যাইনি। আমি জীবন দিয়ে ক্রিকেট খেলেছি। হয়তো বড় কোন খেলোয়াড় হতে পারিনি কিন্তু ন্যূনতম সম্মান তো আশা করতেই পারি।

 

ওয়ানডে অধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও খেলোয়াড়দের আন্দোলনে অংশ নিতে ডাকা হয়নি আপনাকে। এটা কি রাজনীতিতে ছিলেন বলেই?

এই প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে দিব? যদি রাজনীতিতে যোগ দেবার পর দলের সাথে আমার দূরত্ব সৃষ্টি হয় তবে সেটা এখন আরও বাজে রূপ নেওয়ার কথা যেহেতু আমি দলের বাইরে আছি। কিন্তু সবার সাথে এখনও ভাল যোগাযোগ রয়েছে আমার। রাজনীতিতে আসার পর আমি আমার সতীর্থদের সাথে অনেক ম্যাচ খেলেছি। আমি  খারাপ খেলছিলাম এবং তামিমও ভাল খেলতে পারছিল না (এক পর্যায়ে)। আমরা আমাদের অনুভূতি একে অপরের সাথে ভাগ করে নিয়েছি। যদি দূরত্ব তৈরি হতো তবে আমি এটা করতে পারতাম না।

তামিম বলছিলেন আপনাকে ফোন করা হয়েছিল কিন্তু পৌঁছানো যায়নি…

সকলের জন্য বিষয়টা পরিষ্কার করা যাক। আমার বাবা ঐ সময়টায় অসুস্থ ছিলেন। তার তিনদিন আগে বিচ ক্রিকেট নিয়ে তামিমের সাথে কথা হয় আমার। কিন্তু আন্দোলন সম্পর্কে আমাকে কিছুই বলেনি সে৷ তামিম হচ্ছে এমন একজন যার সাথে ফোনে বহুবার আমার কথা হয়েছে। তাই হয়তো এই কারণেই তামিম আমাকে ফোন করেছিল। আমার বাবা তখন অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে চিকিৎসকরা জানান যে তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে৷ তাই আমার মোবাইল বন্ধ ছিল। প্রথমে আমার বাবাকে ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরের দিন তাকে অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি অন্তর্জালে ছিলাম না। তামিম যখন ফোন করে তখন আমি হাসপাতালে ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম বিচ ক্রিকেটের অর্থের বিষয়ে কথা বলতে আমাকে ফোন করেছিল সে।

ক্রিকেটে আপনার দু’টি বড় সিদ্ধান্ত- টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর গ্রহণ এবং ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো। উভয় সিদ্ধান্তই হঠাৎ করে নেওয়া। কেন?

আমার জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত আমি হঠাৎ করে নিয়েছি। আমি এতে গর্ববোধ করি। এভাবেই সকল সিদ্ধান্তে আমি সফল হয়েছি। আমি কেবল পরিবারকে ও আমার সতীর্থদের জানাই৷ তবে আমার কোচকে কিছু বলি না। আমি মনে করি এটাই যথেষ্ট। আমি যখন কোনকিছু নিয়ে ভাবি তখন কারও কথা শুনি না। আমি মনে করি এখন আমি খেলব। কিন্তু পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি মনে হয় ভাল লাগছে না তবে খেলা ছেড়ে দিব।

একজন অধিনায়কের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজটি কী?

বর্তমানে তামিম অধিনায়ক। তাকে প্রচুর পরিকল্পনা সাজাতে হবে। মুশফিক, সাকিব, রিয়াদ তার অধীনে খেলবে৷ মানে তিনজন (সাবেক) অধিনায়ক। সুতরাং তাদেরকে পরিচালনা করার বিষয়টি রয়েছে৷ তারপর দলে তরুণ খেলোয়াড় আছে। এটা খুব কঠিন কিছু নয় তবে তাদেরকে পরিচালনা করতে হবে। এ বিষয়টি আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। আপনাকে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। আমি যখন ওয়ানডে অধিনায়ক ছিলাম তখন পরামর্শ নিতাম এবং বহুবার আমি তাদের সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করেছি।

কখনও কখনও আপনি চাপে থাকবেন। তখন অনেক কিছুই ঘটতে পারে। অন্যদের বিভিন্ন মতামত থাকতে পারে। অন্যরা যা বলবে তাতে আপনার বিশ্বাস থাকতে হবে। সতীর্থদের প্রতি আপনার সেই বিশ্বাস থাকতেই হবে। এটা হতে পারে কোন তরুণ খেলোয়াড় যে হয়তো নিজের প্রথম ম্যাচ খেলছে৷ সে আপনার পক্ষে কিছু বয়ে আনতে পারে। অধিনায়ক হিসেবে আপনার সেই নমনীয় মানসিকতা থাকতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link