More

Social Media

Light
Dark

লম্বা ক্যারিয়ার নাকি গড়?

আজকাল একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কোনো ক্রিকেটারের নৈপুণ্য বিচার করার ক্ষেত্রে তাঁর সর্বমোট রান, উইকেট ইত্যাদি অপেক্ষা ব্যাটিং বা বোলিং গড়, স্ট্রাইক রেট ইত্যাদিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।

আমি যখন সবে ক্রিকেট বুঝতে শিখেছি, সেই সময়ে যাদের নাম লোকমুখে শুনতাম, তাদের প্রত্যেকেই এমন কিছু রেকর্ডের অধিকারী ছিলেন যেগুলো তাঁদের বিখ্যাত করে তুলেছিল এবং ডন ব্রাডম্যান ছাড়া কারোর ক্ষেত্রেই গড় একমাত্র বা প্রধান বিচার্য বিষয় ছিল না। যেমন সুনীল গাভাস্কার, ক্লাইভ লয়েড, দিলীপ ভেংসরকার, ভিভ রিচার্ডস বা গ্যারি সোবার্স, ডেনিস লিলি, কপিল দেব, রিচার্ড হ্যাডলি, ইমরান খান, ইয়ান বোথাম।

এই প্রবণতা কি তাহলে সময়ের সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান, কেননা বর্তমানে ক্রিকেট খেলা হয় তিনটি ভিন্ন ফরম্যাট এ এবং প্রতিটি ফরম্যাট অন্যগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা।
শুধু মোট রান বা মোট উইকেট কে গুরুত্ব দেওয়া অবশ্যই একটি ভুল আঙ্গিক; কিন্তু শুধু গড় বা স্ট্রাইক রেট এর মতো জিনিসকেই শুধুমাত্র গুরুত্ব দিলে একটি বিশেষ অর্জনকে আংশিক বা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়, সেটি হল দীর্ঘদিন ধরে দেশের হয়ে খেলা এবং দেশকে সার্ভিস দেওয়া।

ads

মনে রাখতে হবে, দেশের হয়ে খেলার জন্যে দীর্ঘদিন নিজের ফর্ম ও ফিটনেস ধরে রেখে উপযুক্ততা বজায় রাখা খুব সহজ কাজ নয়, যা আমরা প্রতিশ্রুতিমান বিনোদ কাম্বলি, ইরফান পাঠান, করুন নায়ার, অজিত আগারকার বা রুদ্রপ্রতাপ সিংহের মধ্যে দেখেছি।

দীর্ঘদিন দেশের হয়ে খেলার জন্য দুর্দান্ত ফিটনেস, অবিশ্বাস্য প্রতিভা, স্টামিনা, ডেডিকেশন এবং স্কিল লাগে। এই ধরণের লম্বা ক্যারিয়ার যাদের, তাদের রিকোগনাইজ করা অবশ্যই জরুরি। রান বা উইকেট বেশি ম্যাচ খেললেই আসে না, প্রত্যেকটা রান খেলে অর্জন করতে হয়।

নইলে দীর্ঘ ব্যাড প্যাচ ব্যাটসম্যান বা বোলারদের ক্ষেত্রে আমরা দেখতাম না; যেমন মহিন্দর অমরনাথের ৬ ইনিংস এ ১ রান বা কপিলের গোটা সিরিজে উইকেট না পাওয়া। হ্যাঁ, কোনো কোনো সময় রান করা সহজ, যেমন ভারতের পিচে ওপেন করা, আবার কখনো সেটা কঠিন, যেমন নিউজিল্যান্ডের গ্রিন টপে ওপেন করা।

বর্তমানে ক্রিকেট ভক্তদের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করছি যে লম্বা ক্যারিয়ার যাদের, মানে ১৫-২০ বছর যারা দেশের হয়ে খেলেছেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রেকর্ড বুকে নাম তুলেছেন, তাদেরকে ব্যক্তিগত রেকর্ডের লক্ষ্যে, সেঞ্চুরির লক্ষ্যে খেলতেন বলে দাগিয়ে দেওয়া! যেন তাদের করা রান বা নেওয়া উইকেট দলের কোনো কাজে আসেনি শুধু তাদেরই রেকর্ড সমৃদ্ধ করা ছাড়া।

যিনি ৫-৭ বছর ফর্মের তুঙ্গে থেকে দেশের হয়ে খেললেন কিন্তু তারপরে হারিয়ে গেলেন, তাঁরা কিন্তু একজন গ্রেট ক্রিকেটারের সার্ভিস পাওয়া থেকে দেশকে বেশ কিছু বছরের জন্য বঞ্চিত করলেন! সব সময় যে তাদের উপযুক্ত রিপ্লেসমেন্ট পাওয়া যায় তাও কিন্তু নয়! ইরফান পাঠানের মতো সুইং বোলিং অলরাউন্ডার আমরা এখনো সেভাবে পাইনি.. শার্দুল ঠাকুর কিছুটা! যুবরাজ সিংহ এর মতো ওয়ান ডে স্পেশালিস্ট আজও দলে কেউ নেই। (যদিও যুবরাজ নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেছিলেন, ক্যান্সার এসে তাঁর কয়েকটা বছর কেড়ে নিয়েছিল, কিন্তু আজও আমরা তাঁর মতো কাউকে মিস করি ভারতীয় দলে।

লম্বা ক্যারিয়ারের থেকে স্বল্প দিনের ক্যারিয়ারে ভালো গড়/স্ট্রাইক রেট দেখলে যে যে জিনিসগুলো হতে পারে।

প্রথমেই ব্যাটিং গড়। সময়ের সাথে সাথে এটি বেড়ে গেছে, বিশেষ করে ওয়ানডে তে তো বটেই, যেহেতু একসময় ৪০ ব্যাটিং অ্যাভারেজ রাখতেন ভিভ, সৌরভ, সচিনের মতো ওয়ান ডে এর সেরা ব্যাটসম্যানরা, আর এখন ৫০ এর উপরে অ্যাভারেজ রাখেন বাবর আজম, কোহলি, ধোনি, এবি ডিভিলিয়ার্স এর মতো ব্যাটসম্যানরা। তাই গড়ের এবসোলিউট ভ্যালু দেখলে মনে হতেই পারে বাবর আজম বা ধোনি ভিভ বা শচীনের থেকে বড় ব্যাটসম্যান!

একসময় সেরা ব্যাটসম্যান দের স্ট্রাইক রেট থাকতো ৮০ এর আশেপাশে, এখন সেটা ১০০ এর কাছে বা অনেক সময় উপরে! এটাও ওয়ান ডে তে ব্যাটসম্যানের মাপকাঠিতে ভুল বার্তা প্রেরণ করতে পারে!

রান কি ওপেন করে করা হয়েছে? ( বিশেষ করে যদি কন্ডিশন টাফ হয়) নাকি ইনিংস শেষ করে ফিনিশার রোলে করা হয়েছে, বাকি ব্যাটসম্যানদের সাপোর্ট কতটা ছিল ইত্যাদি জিনিস ব্যাটিং গড়ে প্রভাব ফেলে। ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট ওপেনিং ব্যাটসম্যানের গড় কম হয়, আবার ওয়ান ডে তে ফিনিশার রোলে যারা খেলেন, অর্থাৎ ৫-৬-৭ নম্বরে নামেন, তাদের পক্ষে অধিকাংশই ইনিংসে নট আউট থেকে গড় বাড়িয়ে নেবার একটা সুযোগ থাকে! যেমন ধোনির ওয়ানডে তে ভারতের জয়ী ম্যাচে গড় ১০০ এর উপরে, যা দারুন কৃতিত্ব হলেও, সঠিক প্রতিফলন নয়!

ডন ব্র্যাডম্যানকে আলোচনার বাইরে রাখছি, কেননা এক্সেপশন কখনো রুল কে ভুল প্রমান করে না! স্যার ডন একজনই হন!
১৯৬০ সালের পর থেকে যদি পরিসংখ্যান দেখি, তাহলে গত ৬০ বছরের প্রেক্ষিতে কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে যাই, গড় কে যদি সামগ্রিক অর্জনের অন্যান্য ফ্যাক্টর থেকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে –

টেস্ট ম্যাচ এ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে সুনীল গাভাস্কার, ভিভ রিচার্ডস, জয়বর্ধনে, রুট, মাইকেল ক্লার্ক সবার থেকে ভালো ব্যাটসম্যান বলে মেনে নিতে হয়! এন্ডি ফ্লাওয়ার কে কোনোভাবে ছোট করছি না, কিন্তু বাকি নামগুলো লক্ষ্য করুন!

কেন উইলিয়ামসন, রাহুল দ্রাবিড়, শচীন, লারা, গাভাস্কার, পন্টিং, রিচার্ডস সবার থেকে বেটার ব্যাটসম্যান!

ওয়ানডে তে ভ্যান ডার ডুসেন, রায়ান টেন দুশখাতে এবং বাবর আজম হলেন সর্বকালের সেরা তিন ব্যাটসম্যান! শচীন ভিভ লারা এবিডি আমলা গাঙ্গুলি হাসি ওসব ভুলে যান! একই ভাবে, শ্রেয়াস আইয়ার হলেন ভিভ শচীন লারা বা গাঙ্গুলির থেকে বেটার ওয়ান ডে ব্যাটসম্যান!

এবারে আপনারাই বলুন, শুধুমাত্র গড় দেখে ব্যাটসম্যান বিচার করা উচিত? গড় অবশ্যই দেখা উচিত, কিন্তু সাথে বাকি অর্জনগুলো ও সমান গুরুত্ব দিলে তবেই একজন ব্যাটসম্যান বা বোলারের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব!

বোলারদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫০ উইকেট যারা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে র‌্যাংকিং করলে বোলিং গড় অনেকটাই সঠিক মূল্যায়ন দেয়; কেননা বোলারদের পক্ষে নট আউট থেকে বা রান আউট করে বোলিং গড় বাড়ানোর কোনো উপায় নেই, আর সময়ের সাথে সাথে বোলারদের কাজ তুলনামূলক কঠিন হয়েছে; সহজ নয়!

আবার অতি আগ্রাসী হতে গিয়েও ব্যাটসম্যানরা উইকেট ছুঁড়ে দেন, তাই সব মিলিয়ে বোলাদের ক্ষেত্রে গড় বা স্ট্রাইক রেট এর পরিসংখ্যান অনেকটাই ব্যালান্সড, ব্যাটসম্যানদের তুলনায়! তবুও, কেলি জেমিসন বা অলি রবিনসন টেস্টে মকগ্রাথ বা মার্শালের থেকে বেটার বোলার, এটা মেনে নিতে আমার অসুবিধে আছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link