More

Social Media

Light
Dark

আর্জেন্টিনা, তিন তারকা

অবিশ্বাস্য, দুর্দান্ত, অনবদ্য, নান্দনিক, স্নায়ুরূদ্ধ করে দেওয়া মুহূর্ত- আপনি চাইলে আপনার সংগ্রহশালায় থাকা আরো কিছু বিশেষণ যোগ করতেই পারেন। আবার আলবিসেলেস্তাদের সমর্থক হলে মধুর এক অশ্রুতে ডুবও দিতে পারেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে পারেন, ৩৬ বছরের অপেক্ষার প্রহর তাহলে ফুরোলো অবশেষে! 

হ্যাঁ! বিশ্বকাপটা এবার আর্জেন্টিনার। ৩৬ বছর ধরে বিশ্বকাপ স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করা একটা দল অবশেষে বাস্তবে ফিরলো। এক যুগ নয়, দুই যুগ নয়, তিন তিনটা যুগ ধরে বিশ্বকাপ ছোঁয়ার স্বপ্ন তো স্বপ্নালোক কিংবা কল্পলোকে বাস করার মতোই ছিল। 

মারিও কেম্পেস, ডিয়াগো ম্যারাডোনা এরপর লিওনেল মেসি। স্বপ্নযাত্রায় ফ্রন্টম্যান তো এরাই। চাইলে পার্শ্বনায়কও যোগ করা যায়। সেই পার্শ্বনায়কদের তালিকায় মারিও কেম্পেস যেমন পেয়েছিলেন বার্টোনিকে, ম্যারাডোনা পেয়েছিলেন বুরুচাগাকে, আর এবার মেসি পেলেন ডি মারিয়াকে। 

ads

ফাইনাল মানেই ডি মারিয়ার গোল- এ জন্য এক চিরন্তন প্রথা হয়েই দাঁড়িয়েছে। কোপা আমেরিকায় গোল পেয়েছিলেন, সেই ধারাবাহিকতাতে ফিনালিসিমা, আর এবার গোল পেলেন বিশ্বকাপ ফাইনালেও।

মেসি, ম্যাক এলিস্টারদের সাথে দারুণ বোঝাপড়ায় করলেন দারুণ এক গোল। এমন মুহূর্তের মুর্ছনায় ডি মারিয়া নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। কারণ ডি মারিয়ার ঐ গোলটাই যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বজয়ের পথে আরও এগিয়ে দেয়। মেসির পেনাল্টির পর আরাধ্য বিশ্বকাপকে আরও কাছে আনার কাজটা তো করেন ঐ ডি মারিয়াই। 

নায়ক, পার্শ্ব নায়কের খেরোখাতা গেল। আর্জেন্টিনার এ মহাকাব্যের আড়ালের নায়কের তো এবার সম্মুখপানে আসার পালা। ১৯৭৮ বিশ্বকাপের ডাগ আউটে থেকে আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন মেনোত্তি। ৮৬ তে ছিলেন বিলার্দো। তিন যুগ পরে, এবারে সেই ভূমিকায় আবর্তিত হলেন লিওনেল স্কলানি। তৃতীয় আর্জেন্টাইন কোচ হিসেবে সেই সোনালি ট্রফির স্পর্শ পেলেন দ্য মাস্টারমাইন্ড ট্যাকটিশিয়ান। 

ফাইনাল ম্যাচে ২ গোল। ম্যাচ জয়ের নায়কটা তাই মেসিই। তবে মেসি বোধ হয় সেই নায়কের তকমাটা এমিলিয়ানো মার্টিনেজকেই দিতে চাইবেন। ম্যাচে ২ গোলে এগিয়ে হঠাৎই এমবাপ্পে ঝড়ে ঘুরে দাঁড়ায় ফ্রান্স। আর ৯০ মিনিট শেষ হওয়ার পর যোগ করা অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে মেসির গোলে এগিয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা।

কিন্তু, মহাকাব্যিক পথ যাত্রাতেও তো বাঁধা থাকে। রেফারির বিতর্কিত এক সিদ্ধান্তে আবারও পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। মার্টিনেজের দিকে তখন তাকিয়ে পুরো আর্জেন্টাইন সমর্থক গোষ্ঠী। কিন্তু মার্টিনেজ হতাশ করলেন। এমবাপ্পে স্পটকিক থেকে গোল করে আবারও সমতায় ফেরান ফ্রান্সকে। খেলা গড়ায় পেনাল্টিতে। 

ম্যাচে দুই পেনাল্টির একটিও সেভ না করতে পারায় হয়তো মনের মধ্যে একটা বারুদ পুষে রেখেছিলেন মার্টিনেজ। সেই বারুদের বিস্ফোরণ দেখান পেনাল্টি শ্যুট আউটে। মেসি না হয় দলের জয়ের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সোনালি ট্রফির আরাধ্য স্পর্শ পেতে তো মার্টিনেজকেই গোলবারের ঢাল হয়ে দাঁড়াতে হত। 

মার্টিনেজ ঠিক সেটিই করে দেখালেন। ফ্রান্সের নেওয়া দ্বিতীয় আর তৃতীয় পেনাল্টি ঠেকিয়ে ম্যাচের পুরো গতি পথই বদলে দেন তিনি। আর্জেন্টিনা পায় আরাধ্য সেই ট্রফি উন্মোচনের মুহূর্ত।

ম্যাচ শেষে কাঁদলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ ৷ স্বপ্ন এত কাছ থেকে পূরণের নায়ক বনে যাওয়ার মুহূর্তের মঞ্চায়নে কি আর নিজেকে ধরে রাখা যায়! তাই মার্টিনেজও চোখে অশ্রু নিয়ে ভেসে গেলেন। তবে সে অশ্রু বিজয়ের, একটি স্বপ্ন পূরণের। শুধু স্বপ্ন পূরণ নয়, বহুল আকাঙ্খিত সেই সোনালি ট্রফি ছোঁয়ার বাঁধ ভাঙা এক আনন্দের। 

১৯৭৮, ১৯৮৬, অত:পর ২০২২। আর্জেন্টিনার আকাশী সাদা জার্সিতে এবার বসছে তৃতীয় তারকার ফলক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মেসি পেলেন তাঁর সেই আরাধ্য ট্রফি। ম্যারাডোনার পথে এবার হাঁটলেন মেসিও। সন্দেহাতীতভাবে শ্রেষ্ঠত্বের আসনেও চলে গেলেন দ্য এলএমটেন। 

মেসিদের আজ বাঁধভাঙ্গা উল্লাসের দিন। এ উল্লাসের দিনে আজ হারিয়ে যেতে নেই কোনো বাঁধা। তবে মেসিদের সাথে এই প্রাণ উল্লাসে ডুবে যাবে ঐ আকাশী সাদা জার্সিদের বছরের পর বছর সমর্থন জুগিয়ে যাওয়া সমর্থকরাও। মেসি, আর্জেন্টিনা আর পুরো বিশ্ব, সব যেন কাতারের সানন্দ সন্ধ্যায় মিলেমিশে একাকার। 

কাতার বিশ্বকাপ এমনিতেও চলে গেছে ইতিহাসের পাতায়। আরব বিশ্বে প্রথম বারের মত বিশ্বকাপ। তবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের বুকে ধরে লালন করা অনেক খেলোয়াড়েরই ছিল এটি শেষ বিশ্বকাপ।

তাই আসরের ক্রান্তিলগ্নে একটা পূর্ণতা খুব করে দরকার ছিল। অবশেষে সেই পূর্ণতা আসল। কাতার বিশ্বকাপ স্মরণীয় হয়ে থাকল মেসির জন্য। নিজের শেষ বিশ্বকাপে অবশেষে উঁচিয়ে ধরলেন সেই বিশ্বকাপ। এমন মুহূর্তের চিত্রায়ণই তো ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত দৃশ্য। 

প্রতীক্ষিত দৃশ্যের মঞ্চায়ন, হয়তো অনেক আইকনিক মুহূর্তেরও জন্ম হয়ে গেল এই কাতার বিশ্বকাপে। এ বিশ্বকাপ তাই ভোলার নয়, আর্জেন্টাইনদের জন্য তো আরও নয়। দারুণ সব মুহূর্তগুলো ফ্রেমে বেঁধে রাখার উপলক্ষতে তাই তাদের হারিয়ে যেতে নেই কো মানা। উড়ন্ত আলবিসেলেস্তারা তাই উড়তে থাকুক। এখন তো তাদেরই সময়। কারণ তাদের নামের পাশে যে এরই মাঝে বসে গেছে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তকমা।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link