More

Social Media

Light
Dark

তারপর সবকিছু ফেলে দূরে সরে গিয়েছি

এরকমই একটা শীত শীত দিন ছিল। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ মাতানো এক তরুণকে পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ দলের টুপি। কে পরিয়েছিল তা অবশ্য খেয়াল নেই, তবে সেই ক্যাপ পরানোর সাথে সাথেই বোনা হয়েছিল এক সহস্র আশা, আকাঙ্খা, প্রত্যাশা কিংবা বলতে পারেন সম্ভাবনার বীজ!

আর হবে নাই বা কেন, অনূর্ধ্ব ১৯ পর্যায়ে তিনি ব্যাট করেছেন ৩৫ এর ওপরে গড় রেখে। স্ট্রাইক রেটটা একটু কম (৮০) হলেও তাঁর ব্যাটিং শৈলীই বলে দিচ্ছিল, নিজের ব্যাটিং নিয়ে আর কিছুটা কাজ করলেই তিনি হবেন লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। এই কথাগুলোকে ঠিক অবশ্য এনামুল নিজেই প্রমাণ করেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে। এমনিতেই উপমহাদেশীয়দের জন্যে বিরুদ্ধ কন্ডিশন, তার ওপর সামলাতে হবে পেস বোলিংয়ের তাণ্ডব। তা যাই হোক না কেন, এই বিশ্বকাপে এই কন্ডিশনেই সবগুলো দলের মধ্যে সবচাইতে বেশি রান করেছিলেন এনামুল হক বিজয়!

বিশ্বকাপ মাতানো এই তরুণকে নিয়ে তাই স্বপ্ন দেখতে দোষ ছিল না কোন। ডাকও পেয়েছিলেন দ্রুতই। ২০১২ এশিয়া কাপে স্কোয়াডে ছিলেন, যদিও ম্যাচ খেলার সুযোগ মেলেনি । তবে আনামুলের ওয়ানডে অভিষেকটা হয় ঐ বছরেরই নভেম্বরে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে।

ads

প্রথম ম্যাচে করেছিলেন ৪১ রান, ৬২ বলে। তবে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন বলা যায়। অভিষেকের দ্বিতীয় ম্যাচেই যে পেয়ে গেছিলেন সেঞ্চুরি। এই সেঞ্চুরিটাই বাংলাদেশকে সে ম্যাচে এনে দিয়েছিল ২৯২ রানের বড় সংগ্রহ। এনামুল এরপরই দলে নিয়মিত হয়ে যান। রান পাচ্ছিলেন মোটামুটি ভালই। অন্তত সে সময়ের বাংলাদেশ দলে এত এত তরুণ পারফর্মার ছিল না। তাই ৫ টা সেঞ্চুরি দ্রুতই পেয়ে যাওয়ায় আনামুলকে বাদ দেওয়ার চিন্তা করেনি কেউ।

বিশেষজ্ঞরাও বলছিলেন, এনামুল হক বিজয় হবেন লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। তবে এরপরও সমস্যা ছিল কিছু। সেই সমস্যাগুলোকে তখন বেশ বড় মনে হচ্ছিল না। কেননা ধারণা করা হচ্ছিল সময়ের সাথে সাথে তরুণ বিজয় সেগুলো নিয়ে কাজ করবেন, নিজের সমস্যা শুধরে যাবেন।

এই সমস্যাগুলোর মধ্যে বড় সমস্যা ছিল দুটো। একটি হল এনামুলের স্ট্রাইক রেট। আধুনিক ক্রিকেটে যেটা হয়, ওপেনাররা চেষ্টা করেন দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দিতে। বলের চাইতে রান বেশি করাই থাকে তাদের লক্ষ্য। আজকাল তো এজন্যে ৩০০ রান স্কোরবোর্ডে জমে যাচ্ছে হরহামেশাই। এনামুলের ধীর গতির খেলা নিয়ে তাই সমালোচনা হচ্ছিল বেশ। অন্তত যারা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে পরবর্তী পর্যায়ে নিতে চান, তারা ঠিক আনামুলের ধীর গতির বড় ইনিংসগুলোতে সন্তুষ্ট হচ্ছিলেন না।

দ্বিতীয় সমস্যাটা হল, তাঁর ফুটওয়ার্ক। এনামুল যখন ব্যাট করতে নামেন, তাঁকে দেখে মনে হত তাঁর পা মাটির সাথে লেপ্টে আছে। এই ফুটওয়ার্কের জন্যেই সিঙ্গেল ডাবল বের করাতে তাকে বেগ পেতে হচ্ছিল, স্পিনে টার্নিং উইকেটে খেলতে সমস্যা হচ্ছিল।

তবে, এনামুল যেহেতু রান পাচ্ছিলেন তাই তাঁকে বাদ দেওয়ার প্রশ্নটা কেউ জোরেশোরে করেনি। তবে বিশ্বকাপের ইনজুরির পর তিনি সত্যি সত্যিই বাদ পড়ে গেলেন।

এখানে, অনেকে মনে করেন যে এই ইনজুরি না হলে এনামুল বহাল তবিয়তে খেলে যেতেন আর আজকের এই দিনে তাকে পড়তে হত না। এই ব্যাপারটি আসলে খুব বেশি সত্যি না। এর কারণ, আনামুল নিজেই ছিলেন তার ব্যাপারে উদাসীন।

প্রথমত, এই এত বছর পরও তিনি নিজের ফুটওয়ার্কের কোনো উন্নতি করেননি। ২০১২ থেকে চলমান সমস্যা ২০২০ এ এসে ঠেকেছে, এনামুলের ফুটওয়ার্ক রয়ে গেছে আগের মতই। হুকটা খেলেন একেবারে ঠিকঠাক, পেস বোলিংয়ে বাউন্স সামলাতে পারেন, তবে সুইং আর স্পিনের টার্ন খেলতে যে ফুটওয়ার্ক লাগে তা এনামুল বেমালুম ভুলেই গেছেন।

আর দ্বিতীয় সমস্যা তাঁর স্ট্রাইক রেট। এনামুল এখন অবশ্য মারতে চান, তবে মারতে গিয়ে তিনি আউটও হয়ে যান। স্ট্রাইক রেট ঠিক রেখে রান করা, এই ব্যাপারগুলো এনামুল ঠিক বাগে আনতে পারেন নি।

এখন তো বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ চলছে। এই টুর্নামেন্টে সবা দেশি ক্রিকেটাররা খেলছেন। এনামুলও খেলছেন জেমকন খুলনার হয়ে। দলের হয়ে প্রথম কয়েকটা ম্যাচে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন, প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি। দল থেকে বাদ পড়েছেন। অনূর্ধ্ব বিশ্বকাপ কাঁপিয়ে আসা কেউ ঘরোয়াতে সুযোগই পাচ্ছেন না, ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না?

আনামুল কি এই ব্যাপারটা ভাবেন? তিনি নানা সময়েই দাবি করেছেন দলে তাকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হয়না । সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ২০১৮ সালের ট্রাই নেশন্স কাপে সুযোগ দেওয়া হল, বিশ্বকাপের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সুযোগ দেওয়া হল (যে সিরিজে ভাল করলে মিলতে পারত বিশ্বকাপের টিকেট), তিনি কি সেই তার সেই কথার যৌক্তিকতা দেখাতে পারলেন?

অনেক দিন পর দলে ফিরেছিলেন, হতেই পারে পারফর্ম্যান্সের গ্রাফ শুরুতে একটু নিচে থাকবে। কিন্তু রানের চাইতে বেশি সমস্যা দেখা যাচ্ছিল তার ফুটওয়ার্কে! সেই ফুটওয়ার্ক যা নিয়ে কাজ করার কথা বলা হচ্ছিল সেই ২০১২ থেকে। আর ২০১৮ তে সুযোগ দিয়ে দেখা গেল, আনামুল আসলে তার ফুটওয়ার্ক নিয়ে কাজই করেননি।

তবে আনামুল কিন্তু ঘরোয়াতে রান পাচ্ছিলেন। ঘরোয়াতে রান পাওয়াতেই তাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্লেনে ওঠানো হয়েছিল। তবে আনামুল বুঝতে ভুল করেছিলেন, ঘরোয়া ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক মোটেই এক নয়। তাই তো, রানের চাইতে তার আউটগুলো ছিল সফরে আরো দৃষ্টিকটু।

সেই সফরে বোঝা যাচ্ছিল, আনামুল স্ট্রাইক রেট বাড়িয়ে খেলতে চাইছেন। তবে তা তো হওয়া উচিত প্লানমাফিক। কিন্তু দেখা গেল, তিনি প্রোপার প্লান ছাড়াই শট খেলতে চাইছেন। তাই কখনও ডাউন দ্যা ট্র্যাকে মারতে গিয়ে আউট হচ্ছেন, কখনও হুক করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিচ্ছেন। সেই হুক, যা ছিল তার শক্ত জায়গা।

এনামুল হক বিজয় আসলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তা টের পাচ্ছেন কিনা জানিনা। কিন্তু আনামুলের সমস্যা দিন দিন বাড়ছেই। ফুট ওয়ার্ক তিনি এখনও ঠিক করেননি। এই সমস্যাতো থাকছেই। কিন্তু আগে তিনি যাই হোক রান পেতেন, ইন্টারন্যাশনাল লেভেলেই পেতেন, সেই দুর্বল ফুটওয়ার্ক নিয়েই পেতেন। আস্তে আস্তে তিনি তাও পাচ্ছেন না। আর এখন তো ঘরোয়া দল থেকেও বাদ পড়তে হচ্ছে।

এই দল থেকে বাদ পড়া তাঁর জন্য অ্যালার্মিং স্টেট। এনামুল এখান থেকে বার্তাটা নিতে পারলে হয়।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link