More

Social Media

Light
Dark

বাবার ছেলে বাবার মতো নয়!

একই পরিবারের বাবা আর ছেলে একইসাথে ক্রিকেট মাঠ মাতিয়েছেন- এমন নজির ক্রিকেটে আছে অনেক। ক্রিস ব্রড ও স্টুয়ার্ট ব্রড, ল্যান্স কেয়ার্ন্স ও ক্রিস কেয়ার্ন্স, হানিফ মোহাম্মদ ও শোয়েব মোহাম্মদ, চাইলে এমন উদাহরণ দেওয়া যাবে।

বাবা আর ছেলের ক্রিকেট মাঠের গল্পটাই আজকে বলবো, তবে একটু ভিন্ন কায়দায়। ক্রিকেটের এই স্টারকিডরা বাবার হাত ধরে ক্রিকেটে এসেছেন বটে, তবে ঠিক বাবার পথে হাঁটেননি।

  • কেভিন, স্যাম, টম করান

টম কারান আর স্যাম কারান খেলেন ইংল্যান্ডের হয়ে। তবে তাঁদের বাবা কেভিন কারেন কিন্তু ছিলেন জিম্বাবুয়ের খেলোয়াড় । ১৯৮৭ বিশ্বকাপে তিনি যখন ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডেটা খেলতে নামছেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৯। জিম্বাবুয়ে তখনও টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি। সেসময় জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে উপার্জন স্বল্পতা থাকায় তিনি কাউন্টি ক্রিকেট আর সাউথ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটের দলগুলোতে খেলাতে মনোযোগ দেন। এমন সময় জন্ম হয় টম কারেনের।

ads
কেভিন কারান (সর্ববামে)

খেলোয়াড় হিসেবে জিম্বাবুয়ে ছাড়লেও ২০০০ এর আশেপাশে জিম্বাবুয়ের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন কেভিন কারান। তা কেভিন কারান জিম্বাবুয়েতে ফিরে এলেও নিজের পরিবারকে তিনি রেখে আসেন ডারবানেই। ঠিক সেসময় সারের নজরে পড়ে যান টম কারেন। টম কারেনের জন্যে সারের ক্রিকেট ক্লাবটি ওয়েলিংটন কলেজে স্কলারশিপেরও ব্যাবস্থা করে। এমন সময়ে জিম্বাবুয়েতে এক দুর্ঘটনাতে মারা যান কেভিন করান। তবে তাতে টম কারেনের ক্রিকেট থেমে যায়নি, বরঙ ছোটভাই স্যাম কারানও হেঁটেছে টম কারানের পথেই। বাবার অর্জনকে ছাড়িয়ে গেছেন তাঁরা।

  • জাহাঙ্গীর খান ও মাজিদ খান
জাহাঙ্গীর খান (ডানে)

জাহাঙ্গীর খান আর মাজিদ খান অবশ্য শুধু ‘পিতাপুত্রের ক্রিকেট খেলা’তেই অনন্য হয়ে থাকেননি, এই দুইজনের গল্পটা অন্য মাত্রা পেয়েছে অন্য জায়গাতে। আপনি শুনে চমকে উঠতে পারেন, এই দুজন খেলে খেলেছেন আলাদা দুটি দলের হয়ে, সেই দুটো দলের নাম হল ভারত আর পাকিস্তান!

কিভাবে? ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হবার আগে ১৫ বছর টেস্ট ক্রিকেট খেলার সুযোগ পায়। সেই ইতিহাসের প্রথম টেস্ট অনুষ্ঠিত হয় লর্ডসে, যেখানে ভারতবর্ষের অধিনায়ক হয়ে টস করতে নামেন জাহাঙ্গীর খান।  দলটার নাম অবশ্য ছিল ‘ব্রিটিশ রাজ’।

মাজিদ খান

পরে অবশ্য দেশভাগের পর ছেলে মাজিদ খানকেও ক্রিকেটার বানিয়েছেন জাহাঙ্গীর। তবে মাজিদ খান খেলেছেন পাকিস্তান দলের হয়ে। বাবার মত তাঁর নেতৃত্বগুণও ছিল প্রখর, দিয়েছেন পাকিস্তান টেস্ট দলের নেতৃত্বও। তবে শুধুই নেতৃত্বই নয়, তিনি ছিলেন পাকিস্তান দলের সে সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানও।

  • ডন ও ডেরেক প্রিঙ্গল

ডন প্রিঙ্গল জন্ম নিয়েছিলেন প্রেস্টউইচে। তবে সেখান থেকে ১৯৫০ সালে তিনি পাড়ি জমান কেনিয়াতে। পাকাপাকিভাবে সেখানেই বাস করতে শুরু করেন। ডন প্রিঙ্গলের গল্প এটুকু হলে হয়তো আজকে তাকে নিয়ে লিখতামই না। তবে ডন প্রিঙ্গলের পরিচয়টা আসলে অন্য জায়গাতে। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপে পূর্ব আফ্রিকা বলে একটা দল অংশ নেয়। মূলত কেনিয়া, উগান্ডা আর তানজানিয়া মিলে দলটা গড়ে ফেলে। সেই দলের একজন সদস্য ছিলেন ডন প্রিঙ্গেল। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ৪৩ বছর।

ডেরেক প্রিঙ্গল ১৯৯২ বিশ্বকাপ খেলেন

নাইরোবিতে জন্ম নেয় ডন প্রিঙ্গলের ছেলে ডেরেক প্রিঙ্গল। তবে ডেরেক ঠিক বাবার মত কেনিয়াতেই থিতু হতে চাননি। তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। বাবা ছিলেন ক্রিকেটের ভক্ত, সেই গুণ সঞ্চারিত হয়েছিল ডেরেকের মধ্যেও। ইংল্যান্ডে গিয়ে তাই এসেক্স ক্রিকেটের নজরে পড়ে যান তিনি। বাকি গল্পটা তখন ডেরেকের জন্যে অনুমেয়ই বলা যায়। ক্রমে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন তিনি, এক সময় ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট অভিষেকও হয়ে যায় ডেরেকের। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালও খেলে ফেলেন তিনি ইংল্যান্ডের হয়েই।

  • ইফতিখান আলী খান ও মনসুর আলী খান পতৌদি

মনসুর আলী খান পতৌদির গল্প তো আমরা সবাই জানি। ক্রিকেট, বলিউড মিলিয়ে নবাব পরিবারটির গল্প শাখা প্রশাখা মেলেছে নানা দিকে। তবে মনসুর আলী খান পতৌদির বাবা ইফতিখার আলী খানও ছিলেন ক্রিকেটার। শুধু ক্রিকেটার বললে মনে হয় ভুল হবে, রীতিমত সেসময় টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন ইফতিখার।

ইফতিখার আলী খান পতৌদি

তবে ইফতিখার টেস্ট খেলেছেন ইংল্যান্ড দলের হয়ে। মজার ব্যাপার হল, ১৯৮২ তে এসসিজিতে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেকের পর ইফতিখারকে দল থেকে বাদ দেয় ইংল্যান্ড। এর কারণ ছিল, ইফতিখার ইংল্যান্ড দলের ট্যাকটিক্সের সমালোচনা করেছেন, এক ম্যাচ খেলেই। বোঝাই যাচ্ছে, নবাবী হালচাল আসলে বাদ দিতে পারেননি ইফতিখার।
এরপর ইফতিখার আর মাত্র একটি টেস্ট খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে, ১৯৩৪ অ্যাশেজে। বিখ্যাত সেই বডিলাইন সিরিজে। এরপরই থেমে যায় ইফতিখারের ইংলিশ ক্রিকেট ক্যারিয়ার।

তা ইংলিশ ক্রিকেট ক্যারিয়ার থামলে কি হবে, স্বাধীনতার পর ভারতের ইংল্যান্ড সফরের নেতৃত্বে ইফতিখার আবার ক্রিকেট মাঠে নামেন। তিন টেস্টে মাত্র ৫৫ রান করায় অবশ্য ভারতের হয়েও আর ডাক পাননি তিনি। বয়সটাও আর ডাক পাওয়ার মত ছিল না।

বাবা ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষিক্ত হয়েছিলেন, ছেলে মনসুর আলী খান ওরফে টাইগার পতৌদি অভিষিক্ত হন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ভারতীয় দলের হয়ে ডাক পান তিনি। পরে তিনি ভারতীয় দলের নেতৃত্বও পান। মনসুর আলী খানের দাপট ক্রিকেটে টিকে থাকে এরপর বহুদিন। ক্রিকেট ছাড়ার পরও তিনি আইসিসির ক্রিকেট ম্যাগাজিনের সম্পাদক হয়েছেন, ম্যাচ রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন বিসিসিআইয়ের নির্বাচকও।

টাইগার পতৌদি

মনসুর আলী খান পতৌদিকে ভারতীয় ক্রিকেট মনে রেখেছে এখনও। তাঁকে মনে রাখতে পারে বলিউডও। তিনি হলেন স্বনামধন্য অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের স্বামী। তার ছেলে মেয়ে হলেন সাইফ আলী খান ও সোহা আলী খান। নাতনি সারা আলী খানও পর্দাও চলে এসেছেন।

‘পরম্পরা’ বলে একটা ব্যাপার আছে। ক্রিকেটেও এই পরম্পরার অনুসরণ আরো চলতে থাকবে এটা তো বলাই যায়। তাহলে এই গল্পগুলোর জুটি হয়তো সামনে আরো বাড়বে।

  • রন ও ডিন হেডলি

এই পরিবারের তিন প্রজন্ম থেকেই ক্রিকেটার এসেছে। শুরু হয় কিংবদন্তি জর্জ হেডলির হাত ধরে। তিনি ক্যারিবিয়নিদের সর্বজয়ী দলের সদস্য ছিলেন। পরিচিত ছিলেন ‘দ্য ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’ নামে। সেই তুলনায় ছেলে রোনাল্ড হেডলি অবশ্য তেমন কিছও করতে পারেননি।

উস্টারশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলেছেন ১৭ বছর। এরই মধ্যে লরেস্ট রো’র ঘাসের অ্যালার্জি জনিত বিচিত্র অসুস্থতার সুবাদে ১৯৭৩ সালের ইংল্যান্ড সফরে তাঁর ডাক পড়ে। রোনাল্ডের বয়স তখন ৩৪। চার ইনিংসে ৬২ করেই শেষ হয় তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার।

সেই তুলনায় রোনাল্ডের ছেলে ডিন মানে জর্জের নাতি আরেকটু বেশি পথ হেঁটেছেন আন্তর্জাতিক ময়দানে। ডিন মাত্র ১৭ বছর বয়সে লর্ডসে বাবার সাথে মাঠে নেমেছিলেন ন্যাশনাল ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে। আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় এর দশ বছর বাদে। না, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে নয়।

ডিন ও রন হেডলি

ডিন মাঠে নামেন ইংল্যান্ডের হয়ে, সেটাও আবার অ্যাশেজে। ওল্ড ট্রাফোর্ডে অভিষেকেই পান আট উইকেট। সেই গ্রীস্মেই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যান। জ্যামাইকা, মানে নিজের পূর্বপুরুষের দেশের মাঠ সাবাইনা পার্ক স্টেডিয়ামে নামেন। জর্জ হেডলি স্ট্যান্ড এন্ড থেকে বোলিং শুরু করার মঞ্চটা প্রস্তুতই ছিল।

ভূবন কাঁপানো এক দৃশ্য দেখার অপেক্ষা করছিল ক্রিকেট বিশ্ব।

কিন্তু, ইংল্যান্ড প্রথমে ব্যাট করতে নামার ১০.১ ওভার বাদেই ম্যাচ পণ্ড হয়। কারণ ছিল বাজে আউটফিল্ড ও অনপযুক্ত মাঠ। ডিন এই জীবনে আর দ্বিতীয় সুযোগ পাননি। তাঁর ১৫ টেস্ট ও ১৩ ওয়ানডের ক্যারিয়ার শেষ হয় ১৯৯৯ সালে।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link