More

Social Media

Light
Dark

বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের প্রিন্স

এক অর্থে ক্রিকেটে বাংলাদেশের পথচলা শুরু তাঁর হাত ধরেই। আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বলটা যে তিনি-ই করেছিলেন। দেশের ক্রিকেটের ক্রান্তিকালের সেই সময়টাতে পেস বোলিং ডিপার্টমেন্টকে টেনেছেন একা হাতে। কারও কারও মতে তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা পেসার। দুরন্ত গতির পেসে ব্যাটম্যানদের কাবু করাতেই ছিল তাঁর আনন্দ। তিনি গোলাম নওশের প্রিন্স, নামের মতো ক্যারিয়ারটাও কাটিয়েছেন বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের ‘প্রিন্স’ হয়েই।

আদি নিবাস বরগুনা হলেও ঢাকাতেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা প্রিন্সের। পরিবার থেকে পেয়েছেন ক্রিকেটে আসার উৎসাহ-প্রেরণা। ছোটবেলায় বাবর রোডে অবাঙালি ছেলেদের সাথে সারাদিন মেতে থাকতেন ক্রিকেটের। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে মজে যান ক্রিকেটের প্রেমে। স্কুলের বড় ভাই জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহকে দেখে পেস বোলিং করা শুরু। পরবর্তীতে দুজনে একসাথে খেলেছেন জাতীয় দলে। তবে তাঁর বেড়ে ওঠা বাঁধাগ্রস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের কারণে। কিশোর বয়সের শুরুতেই প্রত্যক্ষ করেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। একাত্তরের সেই নির্মমতায় বাকি বাঙালিদের মত স্বজনহারা হন প্রিন্সও।

স্বাধীনতার পর নতুন করে সবকিছু শুরু করা প্রিন্সের পরিবার নতুন নিবাস গড়ে আজিমপুরে। সেখানকারই তরুণদের ক্লাব ইয়াং পেগাসাস। বলা যায় বাংলাদেশের তৎকালীন সময়ে তরুণদের সূতিকাগার ইয়াং পেগাসাস। শুরুতেই প্রথম বিভাগে খেলার প্রস্তাব থাকলেও নিজেকে বাজিয়ে নিতে ক্যারিয়ার শুরু করেন দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট দিয়ে। ইয়াং পেগাসাসে কোচ হিসেবে পান প্রয়াত জালাল আহমেদ চৌধুরীকে।

ads

তাঁর অধীনেই মূলত কুঁড়ি হতে ফুল হয়ে ফোঁটা গোলাম নওশের প্রিন্সের। নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে আলো ছড়ান আপন মহিমায়। তখনকার পরাশক্তি আবাহনীর বিপক্ষে এক ইনিংসে নেন আট উইকেট। পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন পুরো মৌসুমজুড়ে। ১৯৮৪ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

জাতীয় দলের হয়ে প্রথম সফরেই ৯৯ রানে আউট করেন রঞ্জন মাদুগালেকে। তাঁর পেস আর বাউন্সে কাবু হয়ে হেলমেট নিয়েছিলেন দুলীপ মেন্ডিসকে। বলা চলে সেদিন এক প্রকার বাধ্য করেছিলেন তাঁকে হেলমেট পড়তে। কিন্তু সে সময়ে তাঁর সাথে জুটি বেঁধে বল করার মত পেসার ছিল না বাংলাদেশে। প্রতি ম্যাচেই তাঁর বোলিং পার্টনার পরিবর্তন করা হত। ফলশ্রুতিতে ভাল বল করেও অনেক সময় উইকেট শূন্য থাকতে হয়েছে তাঁকে।

তাছাড়া টানা বল করে যাওয়ার কারণে ইনজুরিতে পড়েছেন ঘনঘন। অনেক সময় দেখা যেত অন্যপ্রান্তে ভরসা করার মত কেউ না থাকায় ব্যথা নিয়েই বল করে গিয়েছেন ওভারের পর ওভার। ১৯৯০ সালে আইসিসি ট্রফিতে সাত ম্যাচে ১৩ উইকেট নিয়ে তিনিই ছিলেন দলের সফলতম বোলার। সেবার সেমিফাইনালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের শুরুতেই তিন উইকেট নিয়ে টপ অর্ডার গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তাঁর পেস-বাউন্সের কোনো জবাব ছিল না সেদিন জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানদের কাছে। কিন্তু বৃষ্টি বাঁধা আর ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় সেবার হেরে যায় বাংলাদেশ। ১৯৯৪ আইসিসি ট্রফিতেও ইনজুরি বাঁধা। টানা ম্যাচ খেলার কারণে আরব আমিরাতের বিপক্ষে অ্যাংকেলের চোটে পড়ে যান। ফলে মিস করেন নেদারল্যান্ডস এবং কেনিয়ার বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ দুই ম্যাচ। বলা যায়, সেই দুই ম্যাচ হেরে যাওয়াতে বাংলাদেশ বিশ্বক্রিকেটে পিছিয়ে গিয়েছিল দশ বছর। কে জানে, হয়তো সেই দুই ম্যাচে তিনি মাঠে নামতে পারলে বদলে যেতে পারতো বাংলাদেশ ক্রিকেটের মানচিত্র। 

হাঁটি হাঁটি করে মাত্র চলতে শুরু করা বাংলাদেশ সে সময় খুব বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেত না। বেশিরভাগ সময়েই বিদেশ সফরে ঘরোয়া দলগুলোর সাথে খেলেই সন্তুষ্ট থাকতে হত। জাতীয় দলের হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, হায়দ্রাবাদ ব্লুজ, ওমর কোরেশি একাদশের বিপক্ষে উইকেট পেয়েছেন নিয়মিতই। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নয় ম্যাচে পেয়েছেন পাঁচ উইকেট। সেই পাঁচ উইকেট পাওয়া ব্যাটসম্যানের নামগুলো পড়লেই বোঝা যায় উইকেটের মাহাত্ন্য। ব্রেন্ডন কুরুপ্পু, রমিজ রাজা, অ্যান্ড্রু জোন্স, ইয়ান হিলি এবং চারিথ সেনা নায়েকে। তবে সে সময়ে বেশিরভাগ দিনই বাংলাদেশ অল্প রানে গুটিয়ে যাওয়ায় প্রতিপক্ষ ব্যাটাররা খেলতেন ধীরগতিতে, ফলে উইকেট পাওয়া ছিল ভীষণ দুষ্কর। 

১৯৯৪ আইসিসি ট্রফির পরই অবসর নেন জাতীয় দল থেকে। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে গিয়েছেন আরও বছর তিনেক। ইয়াং পেগাসাস থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটের যে যাত্রাটা শুরু করেছিলেন রূপালি ব্যাংক, মোহামেডান, বিমান হয়ে আবাহনীতে এসে ইতি টানেন ক্যারিয়ারের। ক্রিকেট ছাড়ার পর জাতীয় দলের নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর আমলেই জাতীয় দলে প্রথমবারের মতো ডাক পান সাকিব, তামিম, মুশফিকরা।

বলা যায়, জাতীয় দলের ভবিষ্যত গড়ে দিয়েছিলেন নির্বাচক হিসেবে। ২০০৭ বিশ্বকাপের পরই সরে দাঁড়ান নির্বাচকের দায়িত্ব থেকে, পাড়ি জমান মার্কিন মূলুকে। সেখানে ব্যবসা করেছেন বহুদিন। কিন্তু ক্রিকেট যার রক্তে, তিনি কি করে দূরে থাকবেন বাইশ গজ ছেড়ে। তিনিও পারেননি, যুক্ত হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট কমিটির সাথে। সূদুর মার্কিন মূলুকে ক্রিকেটের হাতেখড়ি ঘটানোতেই এখনও খুঁজছেন জীবনের প্রশান্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link