More

Social Media

Light
Dark

শেষ সম্রাট

২০০১ সালের উইম্বলডন। খবরের কাগজে পড়লাম সাম্প্রাস হেরে গিয়েছে। কার কাছে হেরেছে সেটা জানার বা জানলেও মনে রাখার চেষ্টা করিনি। এরকম অঘটন মাঝে মধ্যে খেলার মাঠে হতেই পারে। তাছাড়া সাম্প্রাসের বয়সও হচ্ছে। হয়ত খেলার ধারও কমেছে। জেতার খিদেও।

তবে ছেলেটা যেই হোক, ওর ওপর বিরক্ত হয়েছিলাম খুব। নিজে তো শেষ অব্দি জিততে পারলি না, শুধু শুধু একটা লেজেন্ডকে আটকে দিলি। শুধু কি লেজেন্ড? চিরশ্রেষ্ঠ টেনিস প্লেয়ারের লিস্টে সবার ওপরে নাম ওঠার অলরেডি প্রবল দাবীদার তখন সাম্প্রাস। মাটি কাঁপানো সার্ভিস আর ওভারহেড স্ম্যাশ, দুর্ধর্ষ ভলি, চোখ জুড়নো রানিং ফোরহ্যান্ড। এবং সবার ওপর ইস্পাত কঠিন মানসিকতা। যত বড় টুর্নামেন্ট, যত শক্ত প্রতিপক্ষ, তত অপ্রতিরোধ্য সাম্প্রাস।

কিন্তু সেই ছেলেটা নিজেকে ভুলতে দিল না। তখন চাকরী করছি, খেলাধুলো আর দেখার বিশেষ সময় নেই। তবু খবেরর কাগজ খুললেই রজার ফেদেরারের নিত্য নতুন কীর্তি চোখে পড়ত। মনে মনে হাসতাম। সাম্প্রাস নেই, আগাসির বয়স হয়েছে, এখন ফাঁকা মাঠে যত পারো গোল দাও।

ads

আর মাঝে মধ্যে টিভিতে হাইলাইটস দেখতাম। প্রথমে ঝুঁটি বেঁধে খেলত ফেদেরার, তারপর কখনও খোলা চুলে, কখনও মাথায় ব্যান্ড বেঁধে। তবে বেশি মনে আছে দুধ সাদা ধপধপে পোশাকে, মাথায় সাদা রঙেরই হেড ব্যান্ড বেঁধে উইম্বলডনে ওর খেলা।

বেশ রোগা পটকা শরীর কিন্তু শটে বেশ জোর থাকত। দুর্দান্ত সার্ভিস আর ভলি। ফোরহ্যান্ডও দেখার মতো। এবং ব্যাকহ্যান্ড সাম্প্রাসের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে। তবে সবচেয়ে যেটা চোখে পড়ত সেটা হচ্ছে খেলার মধ্যে এফোর্টলেস এলিগ্যান্স। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বল বয়, বল গার্লরা তোয়ালে এগিয়ে দিচ্ছে, সে সেটা নিয়ে মাঝে মধ্যে কপাল মুছছে – সে সব ঠিক আছে কিন্তু দেখে মনে হত না খেলার জন্য ওর কপাল থেকে এক বিন্দুও ঘাম ঝড়ছে।

কোর্টের অপর প্রান্তের প্লেয়ার যখন চিৎকার করে, দুই হাতে ফোর হ্যান্ড, ব্যাক হ্যান্ড, কোর্টের এক প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে ছোটাছুটি করে নাজেহাল, তখন ও যেন কব্জির মোচড়ে ইচ্ছেমত বল কখনও কোর্টের এই প্রান্তে, কখনও ওই প্রান্তে প্লেস করছে। পয়েন্ট, সেট বা ম্যাচ জেতার পরও তেমন উচ্ছ্বাস নেই। কখনও মুষ্টিবদ্ধ হাত ঝাঁকানো, কখনও হাত তুলে দর্শকদের অভিনন্দন গ্রহণ করা।

বুঝলাম নতুন সম্রাট উপস্থিত। এবং ক্রমে এও বুঝলাম এরকম টেনিস প্লেয়ার হয়ত ইতিহাসে আর আসে নি। ওর কিছু শটের নাম দিতে পোড় খাওয়া ধারাভাষ্যকাররাও হিমশিম খেয়ে যেত। হয়ত পেছনের কোর্ট থেকে কাঁধের ওপরের বলকে অনেকটা ড্রপ ভলি মারার মতো ঠেলে দিল। বলটা পড়লও ড্রপ ভলির মতোই, কিন্তু নেটের কাছে নয়, অপর প্রান্তের বেসলাইনের ওপর। ওটা কী? চিপ? ড্রপ ভলি? লব? ধারাভাষ্যকার বললেন, ফেদেরার পাঞ্চ। প্রায়ই বেসলাইনের পেছন থেকে র‍্যাকেটের মিনিমাম ব্যাকলিফটের সাহায্যে বলকে হাফভলিতে নিয়ে ইচ্ছেমত কোর্টের বিভিন্ন কোনায় বা লাইনের ওপর প্লেস করত।

‘ম্যাস্টরোওও’ – ধারাভাষ্যকারদের মুখে প্রায়ই শব্দটা শোনা যেত। প্রতিপক্ষের প্রতিক্রিয়াও হত বেশ দেখার মত। তারা তাদের সেরা শট খেলে পয়েন্ট জেতার ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত, তখন দেখা যেত ফেডেরারের ফ্লিক অফ দ্য রিষ্টের কল্যানে বল আবার তাদের কোর্টে। এবং এমন জায়গায় যেখানে পৌঁছানর কোন সম্ভাবনাই নেই তাদের।

তাঁরা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে একবার নিজের প্রতিপক্ষের, একবার দর্শকদের দিকে চেয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকত। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে পরের পয়েন্ট খেলার জন্য তৈরি হত। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ চিৎকার করে বলত – ইট ইজ নট ফেয়ার! ঠিকই। ওদের কপালেই নেটের অপর প্রান্তে ম্যাজিশিয়ান উইথ দ্য র‍্যাকেট দাঁড়িয়ে – বিধাতার অবিচার তো বটেই।

সাধারণত আন্ডারডগরা দর্শকদের কাছ থেকে একটু বাড়তি উৎসাহ পেয়ে থাকেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ রজার ফেদেরার হলে সেটুকুও জুটত না বেচারাদের কপালে। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে, যে কোনও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রজার ফেদেরার সবসময় ক্রাউডের ফেভারিট।

কয়েক বছর পর সম্রাটকে চ্যালেঞ্জ জানানো আরম্ভ হোল। চূড়ান্ত শারীরিক সক্ষমতা, অসাধারণ ধৈর্য এবং পরিশ্রমকে সম্বল করে প্রথমে রাফায়েল নাদাল এবং তারপর নোভাক জকোভিচ স্বর্ণময় টেনিস যুগের সুচনা করলেন। তবে যেখানে ফেদেরার সৃষ্টি এবং শিল্পীর প্রতীক, যিনি পরের পর উইনার মেরে ম্যাচ এবং টুর্নামেন্ট জিততে অভ্যস্ত, ওনার অপর দুই প্রতিপক্ষ শারীরিক এবং মানসিক শক্তির জোরে, জাস্ট ম্যাচে টিকে থেকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিপর্যস্ত করায় বিশ্বাসী।

তাদের খেলা গড়ে উঠেছে সব বল অপর দিকে ফেরত পাঠাবো এবং প্রতিপক্ষের ভুলের জন্য অপেক্ষা করব – এই দর্শনে। ফেদেরারের সঙ্গে নাদাল বা জকোভিচের খেলা দেখলে আমার প্রায়ই মনে পড়ত কাস্পরভের সঙ্গে ডিপ ব্লুর দাবা খেলার কথা। এই খেলার পরিণতি আমরা সবাই জানি কিন্তু মন থেকে মানতে চাই না। আমরা চাই না শিল্প এবং সৃষ্টি টেকনিক এবং পরিশ্রমের কাছে পরাস্ত হোক।

এটাই রজার ফেদেরারের জনপ্রিয়তার রহস্য। বিজয় অমৃতরাজের ভাষায় তিনি আধুনিকে টেনিসে পুরনো দিনের টেনিসের শেষ প্রতিনিধি। তিনি খেলার মাঝখানে বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ শটের সৃষ্টি করেন, তিনি দুই হাতের ব্যাকহ্যান্ডের মোকাবিলা করেন কব্জির ছোট্ট মোচড়ে, প্রতিপক্ষ যখন প্রবল চিৎকারে কোর্টের এই প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটতে থাকে, ফেদেরার অর্কেস্ট্রার মাস্টারের মতো নেটের কাছে দাঁড়িয়ে নিজের যাদু র‍্যাকেট ঘুরিয়ে দর্শকদের সম্মোহিত করেন। তিনি হেরে গিয়ে কাঁদেন, কখনও জেতার পরও কাঁদেন। তার সঙ্গে কেঁদে ওঠে অসংখ্য মানুষের হৃদয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং রবোটিক্সের দুনিয়ায় তিনি টেনিস কোর্টে মানুষের শেষ প্রতিনিধি।

এটা কিছুমাত্র আশ্চর্যের বিষয় নয় যে নাদাল বা জকোভিচের গ্র্যান্ড স্ল্যামের সংখ্যা রজার ফেদেরারের চেয়ে বেশি। আশ্চর্যের বিষয় যে তিনি শিল্প এবং সৌন্দর্য নির্ভর টেনিস খেলেও এতটা সফল। সেরেনা, জকোভিচ বা নাদাল যেখানে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তারা কী অর্জন করেছেন সেই প্রেক্ষিতে, ফেদেরার স্মরণীয় থাকবেন তিনি কীভাবে সেটা অর্জন করেছেন সেই মানদণ্ডে। যারা পিক ফর্মের রজার ফেদেরারের খেলা অনুভব করেছেন, তারা কিছুতেই সেই উচ্চতায় নাদাল বা জকোভিচকে বসাতে পারবেন না যেখানে রজার রয়েছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে সেই মানুষেরা বলবেন, তারা টেনিসের কী বোঝে যারা শুধুমাত্র টেনিস বোঝে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link