More

Social Media

Light
Dark

অন্ধকার ছাপিয়ে আলোর রোশনাই

দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত এক স্কুলে একবার ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের লিখতে বলা হয়েছিল ১৫ বছর পর তারা নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে চায়। ক্লাসের সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবি লিখলেও ব্যতিক্রম ছিল এগারো বছরের এক বালক। সে লিখেছিল, ‘পনেরো বছর পর আমি নিজেকে স্যুট পরিহিত অবস্থায় প্রেসিডেন্টের সাথে করমর্দনরত অবস্থায় দেখতে চাই এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে গর্বিত করবার জন্য প্রেসিডেন্ট আমাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।’

‘যদি আমি তা করতে পারি তবে আমি আমার কোচ এবং পরিবারকে ধন্যবাদ জানাবো যারা আমাকে প্রতিকূল এই পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করেছেন।’, সে সময়ে অলীক কল্পনা মনে হলেও ছেলেটা কিন্তু তার নিজের স্বপ্নকে সত্যি করেছিল। ঠিক পনের বছর বাদে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করে সে। সেদিনের ছোট্ট বালকটি হলেন টেম্বা বাভুমা, সাদা বলের ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান অধিনায়ক।

শুধু প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান হিসেবে সেঞ্চুরি নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষাঙ্গ অধিনায়কও বাভুমা। ছোটখাটো গড়নের বাভুমার ওয়ানডে ম্যাচের অভিজ্ঞতা মাত্র ১৬ ম্যাচের হলেও ইতোমধ্যেই দৃঢ়তা দেখিয়েছেন এই ব্যাটসম্যান। বিশেষ করে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে ব্যাকফুটে থাকা অবস্থায় ঠান্ডা মাথায় যেভাবে ব্যাট করে জয় এনে দিয়েছেন দলকে, তাতে করে বাভুমাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। ৪৭ টেস্টে মাত্র এক সেঞ্চুরি আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং অর্ডারে বাভুমার অবদানকে পুরোপুরি বোঝাতে পারছে না। তাঁর ত্রিশ কিংবা চল্লিশ রানের ছোট কিন্তু কার্যকরী ইনিংসগুলো বহু ম্যাচে জয় এনে দিয়েছে প্রোটিয়াদের। 

ads

দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের মিডিয়া ম্যানেজার সিপোকাজি সোকানইয়েলে বাভুমাকে একদম শুরু থেকে বেড়ে উঠতে দেখেছেন। কেবল খেলোয়াড় বাভুমা নন, ড্রেসিংরুমে কিংবা মাঠের বাইরের ব্যক্তি বাভুমার পরিবর্তনও এসেছে তাঁর চোখের সামনেই। তাঁর ভাষায়, “টেম্বা দলের জন্য একদম পারফেক্ট নেতা এবং সে জানে তাকে ঠিক কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে দলের লক্ষ্যমাত্রা আরও উঁচুতে নিয়ে গিয়েছে। সে দলের সবার মন্তব্যকে গুরুত্ব দেয় এবং সবার মতামত প্রকাশের মতো স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সে তৈরি করেছে ড্রেসিংরুমে।” 

কেপ টাউনের একটি ছোট শহর ল্যাঙ্গা। কৃষ্ণাঙ্গদের উপর শ্বেতাঙ্গদের শোষণের প্রতীক হিসেবেই যেন টিকে আছে শহরটি। সেই শহরেই সাংবাদিক বাবা এবং ক্রীড়াপ্রেমী মায়ের অনুপ্রেরণাতেই ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠা বাভুমার। তাঁর আগে ল্যাঙ্গা থেকে আরেকজন ক্রিকেটার পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, থামি তোসোকিলে। যদিও প্রোটিয়াদের হয়ে তাঁর ক্যারিয়ারটা দীর্ঘায়িত হয়নি। ক্রিকেটের পাশাপাশি হকিতেও জাতীয় দলে খেলেছিলেন তোসোকিলে। যদিও তাঁর শেষটা সুখকর হয়নি, ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে নিষিদ্ধ হন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।

সুতরাং বলাই যায়, বাভুমার আগমণের পূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকান সমাজে ল্যাঙ্গার ভাবমূর্তি মোটেই ইতিবাচক ছিল না। বাভুমার জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়াটা তাই কেবল তার জন্য নয়, পুরো ল্যাঙ্গার জনগোষ্ঠীর জন্য গর্বের বিষয়। বাভুমা বিষয়টা জানেন, একারণে সবসময় পা মাটিতে রাখেন। বাকিদের মতো উল্লাসে ফেঁটে পড়েন না, উদযাপনের বেলাতেও তিনি পরিমিত, পরিশীলিত। জানেন ল্যাঙ্গার কিশোররা তাকেই আইডল মেনে বড় হচ্ছেন। তারা যেন ভুল কোনো বার্তা না পায়, সেদিকে তার তীক্ষ্ণ মনোযোগ। 

ক্রিকেট কিংবা ক্রিকেটের বাইরে সবদিকেই সমান মনোযোগ তাঁর। বিশেষ করে এবি ডি ভিলিয়ার্স, হাশিম আমলা, জেপি ডুমিনি, ডেল স্টেইনদের মতো কিংবদন্তীদের অবসরের পর অস্থিতিশীল দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রেসিংরুমকে সামলেছেন দক্ষ নাবিকের মতো। পুরো শক্তির ভারতকে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করেছেন ইনজুরি জর্জরিত এক দল নিয়ে।

তাছাড়া গত টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কুইন্টন ডি কক ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে সামিল না হয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসতে না চাইলে পুরো বিশ্বে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। স্পর্শকাতর এই বিষয়টি খুব দক্ষভাবে সামাল দেন বাভুমা। এছাড়া কোচ মার্ক বাউচারের উপর বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ আসলেও সেই ঘটনাটি দক্ষভাবে সামাল দেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। 

সাদা চোখে ব্যাট হাতে বাভুমার উল্লেখযোগ্য ইনিংস না থাকলেও দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং অর্ডারে তার অবদান অনস্বীকার্য। বোলিং নির্ভর পিচে তাঁর ৩০ কিংবা ৪০ রানের ইনিংসগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ম্যাচের ব্যবধান গড়ে দিয়েছে। ভ্যান ডার ডুসেন, মার্করাম, মিলারদের মত মারকুটে ব্যাটার দলে থাকায় বাভুমার ভূমিকাটা একপাশ আগলে রাখার।

ছোটবেলায় ল্যাঙ্গার এবড়োখেবড়ো রাস্তাতে বন্ধুদের সাথে খেলেই বেড়ে উঠেছেন বাভুমা। যেখানে বল অসমান বাউন্স নেয়, সাপের ঘূর্ণির মতো স্পিন করে। ছোটবেলার খেলার এই অভ্যাসের কারণেই কিনা ভারতের বিপক্ষে রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে সামলেছেন হেসেছেন। দারুণ ফুটওয়ার্কের বাভুমাকে বিন্দুমাত্র বেকায়দায় ফেলতে পারেননি ভারতীয় স্পিনাররা। 

দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণকে সর্বশেষ একাত্না করতে পেরেছিলেন ফ্রাঙ্কিস পিয়েনার, যিনি ছিলেন ১৯৯৫ বিশ্বকাপ রাগবিতে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক। স্বয়ং নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণকালে তার জার্সি পরেছিলেন। এখন বাভুমাকে ঘিরে সেই স্বপ্নটা পুনরায় দেখছে দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী। সাদা-কালো নির্বিশেষে সবার চাওয়া চোকার্স অপবাদ ঘুচানোর। আর সেই স্বপ্নের সারথি হিসেবে সবার চাওয়া একজনই, টেম্বা বাভুমা। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link