More

Social Media

Light
Dark

রুটির দোকান থেকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে

গল্পটা পর্তুগালের সমুদ্র তীরের শহর এরিসেইরার এক সেমি-প্রফেশনাল দল এরিসেইরেন্সে খেলা তরুণ এক ফুটবলারের। ইউরপের শীর্ষ স্থানীয় লিগে খেলার স্বপ্ন নিয়ে এই তরুণ বেনফিকা, ব্রাগা, লিলে এবং লিস্টার সিটির মত বড় বড় ক্লাবে গিয়ে ট্রায়াল দেন কিন্ত তাকে বারবার ‘না’ শুনে ফিরে আসতে হয়। জীবিকার তাগিদে তাকে স্থানীয় বেকারির দোকানে খাবার পরিবেশনের কাজ নিতে হয়। এসময় তিনি ভাবেন পেশাদার ফুটবল হওয়ার স্বপ্ন বোধহয় আর বাস্তবে রূপ নিবে না। কিন্তু না এত কিছুর পরও তিনি দমে যাননি, স্বপ্নটাকে আকড়ে ধরে ছিলেন আর তাই তো আজ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলে নিজের আজন্ম লালিত স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।

এই ফুটবলার হলেন পর্তুগিজ মিডফিল্ডার মাথিয়াস নুনেস, যাকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব উলভারহ্যাম্পটন এই দলবদলের বাজারে স্পোর্টিং লিসবন থেকে ৩৮ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে নিজেদের দলে ভেড়ায়। এক সময় যাকে সব দলগুলো ‘তোমাকে দিয়ে আমাদের চলবে না’ বলছিল সেই তিনিই এখন ইউরোপের সেরা ক্লাবগুলোর রাডারে। ব্রাজিলে জন্ম নেয়া পর্তুগিজ এই ফুটবলারকে এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা উদীয়মান ফুটবলারদের একজন হিসেবে ধরা হচ্ছে।

স্পোর্টিংয়ে থাকাকালীন সময় দলটির ম্যানেজার রুবেন আমোরিন দলের ট্রেনিং সেশনে তাকে এক অদ্ভুত উপায়ে অনুপ্রাণিত করার চেষ্ঠা করতেন। আমোরিন এই মিডফিল্ডারকে বলতেন যে তার সর্তীথদের চাইতে তাকে বেশি পরিশ্রম করতে হবে কারণ তার খেলা দিয়ে ম্যানেজারকে দলে টানার জন্য স্পোর্টিং যেই অর্থ খরচ করেছে তা পুষিয়ে দিতে হবে। বলা বাহুল্য তিনি মজা করেই এই কথা বলতেন তবে তার একথা বলার পেছনে একটা গল্প আছে।

ads

মাত্র এক মৌসুমেরও কম সময় ব্রাগার দায়িত্ব পালন করা এই পুর্তগিজ ম্যানেজারকে দলে টানতে স্পোর্টিংয়ের ক্লাব প্রেসিডেন্ট ফ্রেদেরিকো ভারান্দাস যখন ১০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেন তখন অনেকরেই চোখ কপালে উঠেছিল। প্রশ্ন উঠেছিল তৃতীয় বিভাগের দল কাসাপিয়ার ম্যানেজার হিসেবেই ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় কাটানো এই ম্যানেজারের শীর্ষ পর্যায়ের লিগে দায়িত্ব পালন করার তেমন অভিজ্ঞতা নেই তবে কেন তার পেছনে এই কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করলো স্পোর্টিং লিসবন?

২০২০ সালের মে মাসে ক্যানাল ১১ কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্লাবটির প্রেসিডেন্ট এর জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি নুনেস একাই আমোরিনের খরচ পুষিয়ে দেবে। আপনি চাইলে আমার কথা লিখে রাখতে পারেন।’ আর এখান থেকেই আমোরিনের রসিকতার উৎপত্তি।

মূল দলে তখনো অভিষেক না হওয়া ১৯ বছরের এক তরুণ ফুটবলার, যার ক্যারিয়ারের পুরোটাই কেটেছে পুর্তগালের নিচু বিভাগের দলে খেলে তার জন্য এ ছিল এক বিশাল দায়িত্ব, তবে ভারান্দাস যে ভুল করেননি কিছুদিন পরেই তার প্রমান পাওয়া গেল। তার বক্তব্যের এক মাস পরেই স্পোর্টিংয়ের মূল দলে অভিষেক হয় নুনেসের এর পর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, উন্নিতর স্মারক স্বরূপ এই গ্রীষ্মকালীন দলবদলের বাজারে তাকে ক্লাবের ট্রান্সফার ফির রেকর্ড ভেঙে দলে ভেড়ায় প্রিমিয়ার লিগের দল উল্ভস।

দুই বছরের ব্যবধানে বদলে গিয়েছে এই ফুটবলারের ভাগ্য। একসময় পেশাদার ফুটবলার হতে পারবেন কিনা সেই চিন্তায় পড়ে যাওয়া ছেলেটারই আজ পুরো ইউরোপ জুড়ে খ্যাতি। ম্যানচেস্টার সিটির কোচ পেপ গার্দিওলা তাকে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নিজের সিল দিয়েছেন এবং কাতার বিশ্বকাপে পুর্তগাল দলে যে তিনি থাকছেন সেই ব্যাপারেও কোন সন্দেহ নেই। তবে মাথিয়াস নুনেসের এতদূর আসতে অনেক কাঠ কয়লা পোড়াতে হয়েছে।

আলেকজান্দ্রে সান্তোস বর্তমানে এঙ্গোলার প্রথম বিভাগের দল পেট্রো দে লুয়ান্ডার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে স্পোর্টিং এবং এস্তোরিলের অনূর্ধ ২৩ দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পুর্তগিজ এই ভদ্রলোক আর এই দুই ক্লাবেই নুনেস আগে খেলেছেন তাই তিনি তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান।

বিবিসি স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সান্তোস বলেন, ‘তাকে দলে ভেড়ানোর পর আমাদের অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছিল, লোকে বলত আমরা কেন এমন এক ছেলের পেছনে সময় নষ্ট করছি যার এর আগে ফুটবলীয় ক্যারিয়ার বলতে কিছুই নেই। তবে সে শুরু থেকেই ভাল খেলতে থাকে, শুধু যে ভাল খেলে তা নয় বরং তরুণ সম্ভবনাময় ফুটবলার ডানিয়েল ব্রাগাঙ্কা এবং ব্রুনো পাজকে পেছনে ফেলে স্পোর্টিং অনূর্ধ্ব ২৩ দলের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে দলে প্রতিষ্ঠিত করে। ক্লাবে আসার পর আমি তাকে বলেছিলাম যে তাকে উন্নতি করতে হলে ধৈর্যশীল হতে হবে জবাবে সে বলেছিল ‘মিসটার আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আমি ধৈর্য ধারন করেই থাকব, এই অবধি আসতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাই হুট করে উপরে ওঠার জন্য আমার কোন তাড়া নেই।’

এই উদীয়মান পর্তুগিজ তারকা ফুটবলার ইতোমধ্যে প্রিমিয়ার লিগে দুই ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। টটেনহামের বিপক্ষে ১-০ তে হার এবং ঘরের মাঠে নিউক্যাসেলের বিপক্ষে ১-১ য়ে উল্ভস ড্র করলেও তিনি তার খেলার জন্য বেশ প্রসংশা কুড়িয়েছেন।

পর্তুগিজ বাবা এবং ব্রাজিলিয়ান মায়ের ঘরে জন্ম নেয়া মাথিয়াস নুনেসের শৈশবটা কেটেছে ব্রাজিলের শহর রিও ডি জেনেরিওতে, তবে এই সময়টা তার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। শহরের বৈরি পরিবেশের কারণে ছোট্ট নুনেসকে নিয়ে সবসময় চিন্তিত ছিলেন তার মা কাতিয়া নুনেস, তার ভয় ছিল ছেলে হয়তো বিপথগামী হতে পারে। এই সম্পর্কে স্পোর্টিং টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে পুর্তগিজ এই ফুটবলার বলেন, ‘চোর বা ড্রাগ ডিলার হওয়ার বদলে আমি কিভাবে ফুটবলার হলাম তা আমারা মা এখন বুঝে উঠতে পারেননি।আসলে সেই সময়ে আমি কিছুটা ভবঘুরে এবং দস্যু প্রকৃতির ছেলে ছিলাম, আমি ১০ বার বাড়ি পাল্টেছিলাম এমনকি একসময় বস্তিতেও থেকেছি। ১৩ বছর বয়সে আমি পুর্তগালে আসি।’

পুর্তগালে এসে সমুদ্রের তীরের শহর এরিসেইরাতে থিতু হয় নুনেসের পরিবার। এখানেই স্থানীয় সেমি প্রফেশনাল দল এরিসেইরেন্সে তার ফুটবল ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু হয়। প্রতিভা থাকার পরও বড় কোন দলের নজরে না পরায় ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় যখন তরুণ ফুটবলাররা দ্রুত ডেভেলপ করে থাকে এই সময়টার পুরোটাই তিনি এই ক্লাবেই কাটিয়ে দেন। তাই যুব ফুটবলার হিসেবে তার কোন ক্যারিয়ার নেই বললেই চলে।

বড় কোন ক্লাবের নজরে না পরলেও নুনেস নিজেই অনেক ক্লাবে ট্রায়াল দেওয়ার জন্য যেতেন। বেনফিকা, ব্রাগা, লিলে এমনকি প্রিমিয়ার লিগের দল লিস্টার সিটিতেও তিনি ট্রায়াল দিয়েছেন তবে তাদের সবাই তাকে ফিরিয়ে দেয়। যেই বছর লিস্টার সিটি প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জেতে সেই ২০১৬ সালে এই মিডফিল্ডার ইংল্যান্ডের এই ক্লাবে ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলেন। এসময় তার স্থানীয় দলের কোচ রুবেন ফ্রাঙ্কো তরুণ এই ফুটবলারের সাথে ছিলেন।

ট্রায়াল সম্পর্কে ফ্রাঙ্কো বলেন ‘সে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে লিস্টারের অনূর্ধ ২৩ দলের সাথে ছিল। সে সময় নুনেসের হাল্কা গড়নের শরীর ছিল আর তারা শারীরিকভাবে শক্তিশালী এবং গতিশীল ফুটবলার চাইছিল তাই তারা তাকে না করে দেয়। তারা বলে যে নুনেসের কথা তারা মাথায় রাখবে কিন্ত এরপর তারা আর কোন যোগাযোগ করেনি। সেই বছরই লিস্টার লিগ শিরোপা জেতে এবং তাদের তারকা খেলোয়াড় এন গোলো কান্তে, জেমি ভার্দি এবং রবার্ট হুথের সাথে সে ছবি তোলার সুযোগ পায়, এই বা কম কি।’

ফ্রাঙ্কো আরো বলেন যে এই সময় আর্থিক সঙ্কটের কারণে স্থানীয় এক বেকারিতে কফি এবং পেস্ট্রি পরিবেশন করার চাকরি নেন এই মিডফিল্ডার। এ সম্পর্কে তিনি বলেন ‘এই সময় সে নিজের উপর কিছুটা আস্থা হারিয়ে ফেলে, সে কি আদৌ প্রফেশনাল ফুটবলার হতে পারবে কিনা এই চিন্তা তাকে ভর করে। এ সময় সে ফুটবল খেলে মাসে প্রায় ১৫০ ইউরোর মত রোজগার করতো কিন্ত পরিবারের খরচ মেটাতে তার আরও অর্থের প্রয়োজন ছিল। একবার সে আমাকে বলেছিল যে তার স্বপ্ন হল শুধু ফুটবল খেলা আর তা করতে পারলেই সে সন্তুষ্ট, সে এখন তা করতে পেরেছে।’

সাধারনত বিশ্বমানের ফুটবলাররা যেই বয়সে নিজেদের প্রতিভার ফুল ফোটান তার চেয়ে বেশি সময় নিলেও মাথিয়াস অবশেষে নিজের প্রতিভাকে সকলের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন। ২০১৮ সালে এরিসেইরেন্সে থেকে এস্তোরিলে এবং এর প্রায় ছয় মাস পরই তিনি স্পোর্টিংয়ে যোগদান করেন আর এভাবেই ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ে ফুটবল খেলার স্বপ্নটাকে তিনি বাস্তবে পরিণত করেন।

২০২০-২১ মৌসুমে লিগ শিরোপাজয়ী স্পোর্টিং দলে ইমপ্যাক্ট সাব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেঞ্চ থেকে নেমে ব্রাগা এবং বেনফিকার বিপক্ষে তিনি গোল করেন যা দলের শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। পরের মৌসুমে জাও মারিও স্পোর্টিং ছেড়ে প্রবল প্রতিপক্ষ বেনফিকায় যোগদান করলে মাথিয়াস নুনেজ মূল একাদশে জায়গা পান। এরপর ভাল পারফর্মেন্সের কারণে একাদশে তার জায়গা পাকা হয়ে যায়।

তিনি এতটাই ভাল খেলেছিলেন যে তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে ব্রাজিল এবং পুর্তগাল দুই দেশই তাকে নিজেদের জাতীয় দলে টানার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়। শেষমেশ বাবার দেশ পুর্তগালের হয়েই খেলার সিধান্ত নেন তিনি।

শৈশব থেকেই জীবনযুদ্ধে লিপ্ত এই ফুটবলার আরও বড় মাপের খেলোয়াড় হবেন এবং জীবনে আরো উন্নতি করবেন এটাই তার সাবেক কোচ সান্তোসের আশা তিনি বলেন ‘তার মত ফুটবলার যার যুব ফুটবলার হিসেবে কোন ক্যারিয়ারই নেই সে এতদূর অবধি আসবে সচারচর তা দেখা যায় না। আর এটাই ফুটবলের সৌন্দর্য্য, আর সে হল এই নান্দনিক খেলাটির যোগ্য প্রতিনিধি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link