More

Social Media

Light
Dark

বাঁধন হারা প্রাণ, অলিম্পিক জয়ের গান

‘ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত আমরা আনিব রাঙা প্রভাত’। না ‘আমরা’ না ঠিক, ‘আমি’। আর সেই আমি-টা হচ্ছেন লিওনেল মেসি। ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র ধ্রুবতারা। হাজার খানেক আলোকবর্ষ শেষেও জ্বলজ্বল করবে যে তারা। এই আলো তো নিভে যাওয়ার নয়। এ আলো নিভিয়ে ফেলাও যায় না। একটু একটু করে ক্রমশ বৃহৎ এক বিস্তৃর্ণ চারণভূমিই যেন লিওনেল মেসি। কি পেয়েছেন তিনি? প্রশ্নটা ঠিক এভাবে না করে বলা যেতে পারে, কি পাননি তিনি?

একজন ফুটবলার হিসেবে সাফল্যের সর্বোচ্চটুকুই তিনি ছুঁয়ে দেখেছেন। এখনও দেখছেন। জাদুকর বললেও ঠিক ভুল বলা হয়। ঐশ্বরিক কোন এক শক্তি তাঁকে বানিয়েছে অনন্য, অতুলনীয়। অধরা এক স্বর্ণালী ট্রফি। সেটার ছোঁয়া এখনও পেলেন না তিনি। তবে অন্য এক স্বর্ণালী আভা ছুঁয়ে গেছে তাঁকে। তবে সে জন্য অবশ্য খানিকটা বাঁধা ডিঙাতে হয়েছিল বিশ্ব ফুটবলের উজ্জ্বলতম তারকাকে।

ads

২০০৮ সাল, ততদিনে নিজের একটা আলাদা জায়গা তৈরি করে ফেলেছিলেন লিওনেল মেসি। স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার অন্যতম আস্থাভাজন খেলোয়াড়দের একজন। তাঁকে আগলে রাখা শুরু করে দিয়েছে ততদিনে ক্লাব কর্তা থেকে শুরু করে ক্লাবের সমর্থকেরাও। তবে ক্লাবের পাশাপাশি দেশের হয়েও কিছু একটা করার বাকি ছিল তরুণ লিওনেল মেসির।

সেবার অলিম্পিকের আসর বসেছিল এশিয়াতে। চীনের রাজধানী বেইজিং ছিল আয়োজক। আর মেসির ছিল প্রবল ইচ্ছে সেই অলিম্পিকে আর্জেন্টিনার প্রতিনিধিত্ব করার। তবে বার্সেলোনার কর্তারা চাইছিলেন না মেসি চলে যাক। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কোয়ালিফাইয়ের ম্যাচগুলোর সাথে অলিম্পিকের ম্যাচে সময়সূচিতে একটা ঝামেলার সৃষ্টি হয় বলেই কাতালান ক্লাবটি চাইছিল না তাঁদের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়কে হাতছাড়া করতে।

এই নিয়ে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন আর বার্সেলোনা ক্লাবের মাঝে স্নায়ুযুদ্ধের শুরু হয়ে যায়। তবে তরুণ মেসির বড্ড ইচ্ছে, সে জাতীয় দলের জার্সিটা গায়ে চড়িয়ে অলিম্পিকের স্বর্ণ জয়ের পোডিয়ামে দাঁড়াবে। আর জাতীয় দলের হয়ে জেতা যে কোন কিছুর মাহাত্ম্যই তো ভিন্ন।

সে আনন্দানুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় বলে মনে হয় না। এই অনুভূতির পুরোটাই জানা ছিল বার্সেলোনার নতুন নিযুক্ত কোচ পেপ গার্দিওলার। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর মেসিকে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করেছিলেন আসলেই মেসি কি চান।

মেসি অকপটে নিজের ইচ্ছের কথা জানান। আর গার্দিওলা তাঁকে সেই সুযোগটা দেন। কেননা গার্দিওলা নিজেও অলিম্পিকের স্বর্ণ জিতেছিলেন স্পেনের হয়ে। প্রাথমিক বাঁধা পেরিয়ে বেইজিংয়ে হাজির সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার। তখন কেবল স্বর্ণ জয়ের স্বপ্নে বিভোর। চোখ দু’টোতে তখন বিস্ময় আর আবেগ ছলছল করছিল নিশ্চয়ই। সে বিস্ময় নিয়েই প্রথম ম্যাচে আইভেরি কোস্টের মুখোমুখি মেসির আর্জেন্টিনা।

হাফটাইমের আগেই হুয়ান রোমান রিকুয়েলমের বাড়ানো থ্রু বল নিয়েই ভোঁদৌড়। আর আইভেরি কোস্টের গোলরক্ষককে বোকা বানাতে খুব বেশি কষ্ট পেতে হয়নি মেসিকে। সেটা তো তাঁর রীতিমত ডান পায়ের খেলা। গোলটা অবশ্য তিনি করেছিলেন বাঁ-পায়েই। তবে সেই লিডটা ধরে রাখতে পারেনি আর্জেন্টিনা। তবে আবারও সেই মেসির জাদু। আবারও তিনি এক ভয়ংকর পাস বাড়ালেন লাউতারো অ্যাকোস্তাকে। ব্যাস, তিন পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়ে আলবেসেলেস্তারা।

দ্বিতীয় ম্যাচেও নিজের প্রভাবটা বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন লিওনেল মেসি। তাঁর অসাধারণ বিচক্ষণতায় অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে পরের পর্ব নিশ্চিত করেছিল আর্জেন্টিনা। তাই তৃতীয় ম্যাচে বিশ্রামেই ছিলেন জাদুকর মেসি। কোয়ার্টার ফাইনালে শক্ত প্রতিপক্ষে নেদারল্যান্ডস। আর কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই সবচেয়ে সুন্দরতম গোলটি করেছিলেন মেসি। ম্যাচের ১৪ মিনিটের মাথায় ডাচদের বেশ কিছু ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে বল জড়িয়েছিলেন জালে।

সে গোলটাই প্রমাণ করেছিল লিওনেল মেসির ফুটবলীয় দক্ষতা। বলের দখল থেকে শুরু করে স্নায়ুচাপ নিজের আয়ত্ত্বে রাখা সেই সাথে প্রতিপক্ষকে বোকা বানানোর কাজ। সব কিছুই করেছিলেন মেসি কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে। তবে ম্যাচটি শেষমেশ গড়িয়েছিল অতিরিক্ত সময়ে।

অতিরিক্ত সময়ের প্রথম অর্ধের একেবারে শেষের দিকে আবারও মেসি ছড়ালেন মুগ্ধতা। অসাধারণ এক পাস বাড়িয়ে দেন উইঙ্গার অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়াকে। আর সেখান থেকে গোল আদায় করার কাজটা সুনিপুণভাবেই করে ফেলেন ডি মারিয়া।

সেমিফাইনালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবার কথা ছিল। কেননা প্রতিপক্ষ ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দী ব্রাজিল। সেই ব্রাজিলই তো বছর খানেক আগে জিতে নিয়েছিল কোপা আমেরিকা। তবে ম্যাচটা কোন এক অজানা কারণে হয়ে যায় একপেশে। সার্জিও অ্যাগুয়েরোর দুই গোল আর রিকুয়েলমের পেনাল্টি গোল। সব মিলিয়ে ফাইনালে লিওনেল মেসি। ফাইনালে অপেক্ষাকৃত সহজ প্রতিপক্ষই পেয়েছিল আর্জেন্টিনা।

মেসির স্বপ্নটা তখন যেন সত্যি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ফাইনালের আগে নিশ্চয়ই ঘুমোতে পারেননি মেসি। উৎকণ্ঠা নিশ্চয়ই ছড়িয়ে গেছে সবগুলো ধমনী। তবে যতটা সহজে ম্যাচ জিতে নেবে আর্জেন্টিনা ততটা সহজে জিততে দেয়নি নাইজেরিয়া। বেইজিংয়ের ঘাম ঝড়ানো গরমটা অসহনীয় হয়ে উঠছিল আলবেসেলেস্তাদের। তবুও হার মেনে নেওয়া তো আর যায় না। স্বপ্নটাকে তো আর এমনি এমনি উবে যেতে দেওয়া যায় না।

মেসিও দিলেন না। ঘড়ির কাটা যখন ঘুরে আবার স্বস্থানে ফেরত এসেছে ঠিক তখন রক্ষণ চেড়া পাসে বল বাড়িয়ে দিলেন ডি মারিয়াকে। ফাঁকায় বল পেয়ে গেলেন মারিয়া। এরপর আসলে আর তেমন কিছুই করার ছিলনা নাইজেরিয়ান গোলরক্ষকের। আর সেই এক গোল ব্যবধানেই জয় পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। আকাশী-নীল জার্সি গায়ে সেটাই ছিল মেসির সম্ভবত সবচেয়ে বড় অর্জন।

 

তবে মেসি ফাইনালে মেসির বাড়ানোর পাসটির জন্যে অন্তত সেদিন একটা পুরষ্কার তাঁর প্রাপ্য ছিল। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে স্বর্ণ পদক গলায় ঝুলিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন তারুণ লিওনেল মেসি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link