More

Social Media

Light
Dark

ঈশ্বর দেখতে কেমন

নব্বইয়ে আমার বয়স নয়।

বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বড় ভাইদের মধ্যে উত্তেজনা। কলহ। বিবাদ। দেয়ালে দেয়ালে ‘ইতালি’ ‘আর্জেন্টিনা’ লেখা। পেঁয়াজপট্টিতে পাড়ার রোজকার ফুটবল। যে যে-দলই সাপোর্ট করুক, খেলতে নামলে সবাই ম্যারাডোনা হতে চায়!

কে এই ম্যারাডোনা?

ads

তো তখন তো আর এই ইউটিউব নাই। ম্যারাডোনার ছবি পোস্টারে, পত্রিকার বাজে নিউজপ্রিন্টে, ভিউকার্ডে। এসব দেখে চক্ষু ভরে না। যে খেলোয়াড়কে নিয়ে কেউ ভালোবাসায় কেউ ঈর্ষায় এত যে কলহপ্রবণতা তাকে চিনিই না আমি ঠিক।

আমি তাই বড়দের কথা হা হয়ে শুনি!

যা শুনি তা অবশ্য রূপকথার মতো লাগে। যেন এক ডালিম কুমার… মাঠের মধ্যে নাকি একা, এক টানে, বাতাসে নিজেকে এবং বলকে কাটিয়ে, ডানে-বায়ে রাখা রাক্ষস-খোক্ষসদের স্রেফ উড়িয়ে, ছুটে যাচ্ছে গোলপোস্টের দিকে… একা এবং অদ্বিতীয়।

হয় নাকি এমন?

ফুটবল তো খেলিই আমি। দেখিও। পাড়ার মাঠে, বড় মাঠে, কলেজ মাঠে… এমন হয় না। টিভিতেও তো দেখলাম। ওই তো বল নিয়ে দশ খেলোয়াড়ের নাচানাচি… ম্যারাডোনা তাহলে এমন কী করে?

বড়রা ধমকায়।

একা দল জেতায় ম্যারাডোনা। ফাইনালে তোলে দেশকে। বিশ্বকাপটায় ধরে চুমু দেয়। কি ফরোয়ার্ড কি ডিফেন্স কি রেফারি সবার সামনে গ্রিবা উঁচু করে বুকটা চেতিয়ে নাকি দাঁড়িয়ে থাকে… মাথা নোয়াবার নয়!

আমাদের বাড়ি ভরা ফুটবল দর্শক।

মানে যারা বোঝে তারা তো আছেই, যারা আমার মতো অবুঝ, তারাও।

আম্মা আর্জেন্টিনা, আব্বা ব্রাজিল -অন্তরে তার পেলে।

বড় ভাই ইতালি, সেজ ভাই জার্মানি।

মেজ ভাই সোভিয়েত থেকে চিঠিতে খেলার উত্তাপ ছড়াচ্ছেন। তার বাজিতে উরুগুয়ে।

আমি কী হবো?

আমি এ দল ও দল করি। বুঝে উঠতে পারি না।

তো পাড়ার টুর্নামেন্ট শেষ হতে না হতেই বিশ্বকাপটা শুরু হলো। যথারীতি আর্জেন্টিনার ম্যাচও চলে আসল। আমার মনে আছে সেদিন ভীষণ ভিড়। আমি টিভিতে প্রথম ম্যারাডোনাকে দেখলাম। আহামরি তো কিছু না, তায় আবার বেঁটে! হেড হয় তাঁকে দিয়ে?

খেলায় দেখলাম বিস্তর ছোটাছোটি আছি। রাগ আছে। আফসোস আছে। ক্যামেরার অহেতু তাকে ধরে থাকা আছে। ক্লোজে আছে তাকে ছেঁকে রাখা। পায়ের মাংসপেশীর ওপর স্পাইক বুটের কঠোর আঘাত আছে। তবু কাঠবেড়ালির মতো তার একটানা ছুটে চলা আছে।

তা দেখলাম তাকে। গোলও দিলো নাকি মনে নেই। প্রথম দেখায় ওইটুকুই। ভালো খেলে, তাই বলে এত বাবা?

এরই মধ্যে কে জানি বলল, হাত দিয়ে গোল দিয়ে কাপ নিছিল!

মানে ভণ্ডবাবা!

ম্যারাডোনা নিয়ে মিশ্রতা নিয়েই চলছিল। প্রতি ম্যাচে তাকে যেভাবে গার্ড দিয়ে রাখা হয়, তাকে মারা হয়, ক্যামেরায় বেশি ধরা হয়, তার পায়ে বল গেলেই দর্শক যেমন চিৎকার দিয়ে ওঠে সে সব একটু বাড়াবাড়ি লাগে।

এরই মাঝে কোন এক ম্যাচে রেফারির সাথে ম্যারাডোনার বুক চেতানো বন্যতা। রেফারির লাল কার্ড। ম্যারাডোনা কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ছে। মাঠ থেকে যেন ফুটবল চলে যাচ্ছে এমন বিস্ময় নিয়ে সতীর্থরা তাকিয়ে আছে। গ্যালারিতে পিনপতন নিরবতা।

আমার বাড়ির উরুগুয়ে, ইতালি, জার্মান সবাই বিমূঢ় তাকিয়ে আছে। তারাও দেখছে ফুটবল ম্যাচ থেকে ফুটবল চলে যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে…

আব্বাকে দেখলাম চট করে চোখ মুছে নিলেন। আর আমি বুঝলাম ঈশ্বর দেখতে কেমন। বুঝলাম ঈশ্বর কাঁদলে কাঁদতে হয় সবাইকেই।

ম্যারাডোনাকে সেই থেকে ফুটবল বলে জানি, বা ফুটবলকে ম্যারাডোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link