More

Social Media

Light
Dark

আমি অনেক-কিছুই-ছাইড়া-আসা-লোক!

আফগানিস্তানের রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক অবস্থা কখনোই সুখকর নয়। এমন অবস্থায় জাতীয় দলের তরুণ ক্রিকেটার নাভিন উল হক এক সাক্ষাৎকারে কণ্ঠে শঙ্কা নিয়েই বলেছিলেন, ক্রিকেটই আমাদের দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোঁটায়। একমাত্র ক্রিকেট দেশের মানুষকে খুশি করতে পারে। আফগানিস্তানের মানুষের কাছে ক্রিকেট শুধুমাত্র একটি খেলা নয়। সেই কারণে ক্রিকেট আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’  

ক্রিকেট বিশ্বে আফগানিস্তান সম্ভাবনাময়ী একটি দল ছিল। সেই সাথে অনেক সম্ভাবনাময়ী ক্রিকেটারের উত্থান এর সুযোগ ছিল। কিন্তু চলমান বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এসেছে আফগানিস্তান ক্রিকেটের দুনিয়ায়ও। আমরা জানি দেশটি থেকে অনেক মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। সব শ্রেণী-পেশার মধ্যে ক্রিকেটাররাও বাদ যাননি এই তালিকা থেকে। সেইরকম একজন ক্রিকেটারের গল্প শুনি চলুন।

জাহিদ জাখাইল ছিলেন একজন আফগান ক্রিকেটার। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, একজন সম্ভাবনাময়ী প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার ছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো জাতীয় দলে অভিষেকের সুযোগটাও জুটে যেত এতোদিনে। কিন্তু সেই ক্রিকেটারই না কেন প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন!

ads

ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি ইংরেজিটা ভালো জানতেন বলে মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন দোভাষী হিসেবে কাজ করতেন জাহিদ জাখাইল। কিন্তু দেশটির রাজনৈতিক হাতবদলের পর তিনি বুঝলেন যে তিনি কট্টরপন্থি দলটির রোষানলে পড়ে গিয়েছেন। দেশে অবস্থান করলে যেকোনো সময়ে মৃত্যুর দুয়ারে পতিত হতে পারেন। বেঁচে থাকার জন্য তাই ক্রিকেটের স্বপ্নটাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়ে দেশত্যাগ করা ছাড়া জাখাইলের কাছে আর কোন উপায় ছিল না।

অথচ দেশটিতে অস্থিরতা শুরু হওয়ার ঠিক আগেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আফগানিস্তানের টেস্ট ম্যাচ সিরিজের জন্য জাতীয় দলের ট্রেনিং ক্যাম্পে তিনি ডাক পেয়েছিলেন। জাখাইলের প্রথম শ্রেনীর ক্যারিয়ারের সূচনালগ্নে তার প্রথম ছয় ম্যাচেই তিনি চারটি হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন।

তাছাড়া কিশোর বয়সে একটি অপরাজিত ডাবল সেঞ্চুরিও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড তাই জাখাইলের প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ শীগ্রই তাঁকে ঘরোয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজ দেশের নীল জার্সিটি গায়ে জড়ানোর সৌভাগ্য হলোনা জাহিদ জাখাইলের।

দেশ দখলের পর পরই জাখাইল বিমানবন্দরে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ নিয়ে দেশ ছাড়ার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছিল। অনেক চেষ্টার পর পূর্ব পরিচিত মার্কিন কমান্ডো, যাদের দোভাষী হিসেবে তিনি আগে কাজ করেছিলেন।

সেই সৈনিকরা তাঁকে চেক পয়েন্ট পার হয়ে বিমান ধরার সুযোগ করে দিয়েছিল। কাবুল বিমানবন্দরের ওপর যখন বিমানটি উড়ে যাচ্ছিল, জাখাইল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে ভিনদেশে অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমানোর অনুভূতিটা কতটা অসহায় হতে পারে তা আপনি আমি হয়ত কল্পনাও করতে পারবো না।

এরপর তিনি হোটেল এবং ভার্জিনিয়ায় সামরিক ঘাঁটির মধ্যে তিনটি মাস কাটিয়েছেন নিদারুণ অনিশ্চয়তায়। তখন জাখাইলের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন বন্ধু ও সহকর্মী আফগান ক্রিকেটার নওয়াজ খান। নওয়াজ তখন তাকে ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে তাঁর ক্রিকেটভাগ্যকে আরেকবার সুযোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

জাহিদ জাখাইল তাই করলেন। জীবনের রিসেট বাটন চেপে নতুন করে আরেকবার ক্রিকেটের স্বপ্ন পূরণে মনোনিবেশ করলেন। কারণ যার জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশেছিল ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা, দিনশেষে তিনি ক্রিকেটের ব্যাটটিকেই পরমযত্নে তুলে নিবেন, তাই বরং স্বাভাবিক।

ধীরে ধীরে ক্যালিফোর্নিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ব্যাট হাতে তাঁর ক্রিকেটের দ্যুতি এবং জাখাইল দ্রুতই মাইনর লিগে তারকাখচিত দল সিলিকন ভ্যালি স্ট্রাইকার্স এ জায়গা করে নিলেন। সিলিকন ভ্যালি স্ট্রাইকার্সরা গত বছর জোটবদ্ধভাবে সিলভারওয়্যার জিতে নিয়েছিল। জাখাইল সেখানে প্রথম কয়েকটি ম্যাচে ভালো খেলেছিলেন। এবং নিজ যোগ্যতায় তিনি টপ অর্ডারে ব্যাটিং এর সুযোগ লুফে নিলেন। গোল্ডেন স্টেট গ্রিজলিসের বিপক্ষে ৪১ বলে অসাধারণ ৭২ রান করা মুহূর্তটিকে নিজের করে নেন তিনি।

জাখাইল  বলেন, ‘এটি আমার জন্য একটি বিশাল ইনিংস ছিল। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার জন্য। এই ধরনের একটি মঞ্চে এই ধরনের মানসম্পন্ন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, আমার জীবনের এই মুহুর্তে এই ইনিংসটি প্রয়োজন ছিল। শুধু একজন ক্রিকেটার হিসেবে নয়, একজন ব্যক্তি হিসেবেও আমার জন্য এই ইনিংসটি দরকার ছিল।’

আত্ম-পুনরাবিষ্কারের যাত্রায় তার গৌরবময় ছয় ছক্কার বলে জাখাইল নিজেও তার প্রাণবন্ত ফর্মে ফিরে আসার কথা স্বীকার করেছেন। পাকিস্তানের সাবেক ফাস্ট বোলার এহসান আদিলকে ম্যাচের প্রথম বলেই বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন তিনি।

জাখাইল আরও বলেন, ‘ক্রিকেটই একমাত্র জিনিস যা আমি জানি। আমি সারাজীবন ক্রিকেটে বেঁচে ছিলাম। আমি কখনই ভাবিনি যে আমি পেশাদার দলে আবার ফিরে আসব। স্ট্রাইকার্সের মতো দলের সাথে সাফল্যের স্বাদ পাওয়া এই অভিজ্ঞতাকে আরও মধুর করে তোলে। আমি ভাগ্যবান। মাইনর লিগ আমার ক্রিকেটীয় স্বপ্নকে পুনরুজ্জীবিত করার পথে তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’

জাখাইলকে জীবনে অনেক কিছু ত্যাগ করে আসতে হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে পালিয়েছিলেন একেবারে এক কাপড়ে ও শূন্য হাতে। কেবল কি মাতৃভূমি! সেই সাথে তিনি মা, বাবা ও সাত ভাইবোনকে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছেন আফগানিস্তানে।

কেবল তাঁর নি:সঙ্গ জীবনের সঙ্গী হলো তাঁর অপূর্ণ ক্রিকেট খেলার স্বপ্নটা। মাঝরাতে হয়তো পরিবারের অভাবটা বেশ অনুভূত হয় তাঁর, কিন্তু ক্রিকেট ব্যাটটাই সম্ভবত নির্বাসিত জীবনে তাঁর একমাত্র সঙ্গী হয়ে পাশে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link