More

Social Media

Light
Dark

দু:সাহসী পরিণতিবোধ

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী ওয়ানডে ম্যাচে ভারত যখন ৩৮ রানে তিন উইকেট হারিয়ে আরেকটি পরাজয়ের অপেক্ষা করছিল, বাইশ গজের একপ্রান্তে তখন দাঁড়িয়েছিলেন ঋষাভ পান্ত। ঋষাভ মানে তো কাউন্টার অ্যাটাক, দু:সাহস, রোমাঞ্চ, শটস আর এরপর হুট করে আউট হয়ে যাওয়া। এমন পরিস্থিতি থেকে লম্বা সময় ব্যাট করে ম্যাচ জেতাবেন এমন ভরসা কি আর পান্তের উপর করা যায়?

অভিষেকের পর থেকে ঋষাভ পান্তের খেলা দেখে থাকা ক্রিকেট ভক্তরা অন্তত পুরোপুরি ভরসা করতে পারেনি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়েই নতুন রূপ ধারণ করেছেন ভারতের উইকেট রক্ষক। নিজের স্বভাববিরূদ্ধ ধৈর্যশীল ব্যাটিং করেছেন, শুরুটা একেবারে দেখেশুনে। এরপরই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন, থামিয়ে দিয়েছেন টপলিদের উল্লাস।

প্রথমে সূর্যকুমার যাদবকে নিয়ে প্রাথমিক বিপদ সামলে নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রাইসিস ম্যান যাদবের বিদায়ের পরে একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল সফরকারীদের পরাজয়। সেই নিরাশার মাঝেই আশার ফুল হয়ে ফুটে পান্ত-পান্ডিয়া জুটি। হার্দিক পান্ডিয়ার সঙ্গে ১৩৩ রানের জুটি গড়ে ভারতকে পুনরায় ম্যাচে ফেরান ঋষাভ পান্ত। তবে ৫৫ বলে ৭১ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে পান্ডিয়া বিদায় নিলে আবারো শঙ্কা জেগে উঠে।

ads

কিন্তু ঋষাভ পান্তের এসব থোড়াই কেয়ার – পান্ডিয়ার আউটের পর আরো বিধ্বংসী হয়ে উঠেন তিনি। শেষপর্যন্ত রবীন্দ্র জাদেজাকে নিয়ে ৫৬ রানের অপরাজিত জুটি গড়ে দলকে সিরিজ জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন এই বামহাতি ব্যাটসম্যান। আর এই ৫৬ রানের মধ্যে মাত্র সাত রান এসেছে জাদেজার ব্যাট থেকে; বোঝাই যায় ইনিংসের শেষদিকে কতটা রুদ্ররূপ ধারণ করেছিলেন পান্ত। আর ডেভিড উইলির এক ওভারে টানা পাঁচ চারে নিজের ইনিংসকে পূর্ণতা দেন তিনি। 

১১৩ বলে ১২৫ রানের স্মরণীয় ইনিংস খেলা ঋষাভ পান্তকে প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতেও ভুল হয়নি। ম্যাচ সেরার পুরষ্কার তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন অফিশিয়ালরা। তাঁর ব্যাটে রান তো অতীতে অনেকবারই এসেছে কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচজয়ী এই ইনিংসে দেখা গিয়েছে ব্যতিক্রমী কিছু।

এর আগে কখনো ঋষাভ পান্তের মাঝে এতটা নিয়ন্ত্রণ, নিঁখুত শট সিলেকশন দেখা যায়নি। তার চেয়ে বড় কথা, পান্তের ম্যাচ পরিস্থিতি বুঝতে পারা, এবং এরই সাথে যে পরিণতিবোধ ফুটে উঠেছে তাঁর মাঝে, তাতে হাসি চওড়া হতেই পারে ভারতীয় ক্রিকেটের নীতিনির্ধারকদের। 

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শুরুটা অবশ্য এতটা ভাল হয়নি পান্তের। ঋদ্ধিমান সাহাকে টেস্টে রিপ্লেস করাটা ভালভাবে নিতে পারেনি অনেক ঋদ্ধি ভক্তই। ঋষাভের ব্যাটিংটা আশাব্যাঞ্জক হলেও উইকেটের পিছনে ছিল নড়বড়ে। বারবার প্রশ্ন উঠেছে দলে জায়গা নিয়ে৷

ভারত ক্রিকেট ইতিহাসের কিংবদন্তি মহেন্দ্র সিং ধোনি’র উত্তরসূরী হিসেবে আগমন, তাই প্রত্যাশার চাপ ছিল আকাশচুম্বী। অবশ্য শুরু থেকেই ম্যানেজমেন্টের হাতটা কাঁধের উপর পেয়েছিলেন পান্ত। আর তাই এখন ধীরে ধীরে ফিরিয়ে দিচ্ছেন আস্থার প্রতিদান। তিন ফরম্যাটেই এখন প্রায় ভারতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান।

তারপরও কথা উঠে ঋষাভ পান্তের টেকনিক নিয়ে। অনেকেই মনে করে পান্ত আসলে ব্যাটিং টা জানে না। টেকনিকে ভুল, ফুটওয়ার্কে সমস্যা। কিন্তু পান্ত কি আসলেই টেকনিক জানেন না? তার ব্যাটিংয়ে ভাল ভাবে তাকালেই বোঝা যায় পান্তের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা তার দুর্দান্ত ব্যাট স্যুইং।

হ্যান্ড-আই কো অর্ডিনেশন আর চমৎকার রিফ্লেক্সের সাহায্যে দারুণ সব শট খেলতে জানেন তিনি। তাছাড়া বলের লাইন বোঝার ঈর্ষণীয় ক্ষমতা আছে তাঁর। অনুমানে শুধু বলকে মারতে যান না তিনি, বরং বোলারের হাত থেকে বল ডেলিভারি হওয়ার পরেই বলের লাইন বুঝে যান তিনি। আর সেই হিসেবেই নির্বাচন করেন নিজের শট।  

সব মিলিয়ে পান্ত টেকনিক্যালি ততটাও খারাপ নয়, অবশ্য খারাপ হলেও কি। দলের বিপর্যয়ে কাউন্টার এটাক করে রান তোলার সাহস কয়জন টেকনিক্যাল সলিড ব্যাটসম্যানেরই বা আছে। এক হাতে মেরেই বলকে লং অন দিয়ে বাউন্ডারি ছাড়া করার আত্মবিশ্বাসও অনেকের নেই। ফ্লুক,হুক কিংবা কাট; প্রতিবার ব্যাট হাতে নামেন পান্ত আর এসব হয়ে উঠে নৈমিত্তিক শট! 

তারপরও কোনদিন হয়তো ব্যাটে বলে হয় না। পারেননা রানের ফোয়ারা সৃষ্টি করতে। আর তাই শুনতে হয় সমালোচনা; শুনতে হয় বিদ্রুপ! এমনকি দলে পান্তের জায়গা নিয়েও প্রশ্ন তোলে অনেকে।  

এত এত সমালোচনা, প্রত্যাশা কিংবা ক্রিকেট ব্যাকরনের নিয়মকানুন কোনটিই হয়তো মাথায় থাকে না ঋষাভের। বাইশ গজে শুধুই নিজের মত চিত্র এঁকে যান। টেস্ট ক্রিকেটের পরিসংখ্যানে তিনি এখনই অনেক ক্ষেত্রে মহেন্দ্র সিং ধোনির চেয়ে এগিয়ে।

সে তুলনায় ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে কিছুটা রং হারিয়েছিলেন পান্ত। কিন্তু আজকের ইনিংসটি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারকে নবরূপ দিবে, পুনরায় এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিবে। 

ভারতীয় উপমহাদেশের এক ছেলে ব্রিটিশ মুল্লুকে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের স্তব্ধ করে দিয়েছে, এমন দৃশ্য অনেক দিন মনে রাখবে দর্শকরা। মনে রাখতে বাধ্য হবে। এতদিনে একটা কথা নিশ্চয়ই পরিষ্কার, রিষাভ পান্ত ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। তার মাঝে আছে কিংবদন্তি হয়ে ওঠার সামর্থ্য। 

সেই সামর্থ্যের প্রতিফলন এখন পর্যন্ত ভালোভাবেই দেখিয়েছেন তিনি। এর ধারাবাহিকতা আগামীতে ধরে রাখতে পারলে পৃথিবী শুনবে পান্তের গর্জন, শুনবে নতুন অ্যাডাম গিলক্রিস্টের বার্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link