More

Social Media

Light
Dark

ছন্নছাড়া এক সাজানো বাগান

স্বাভাবিক দৈহিক উচ্চতা কিংবা আদর্শ উচ্চতার চেয়েও অনেক বেশি উচ্চতার হওয়াকে অস্বাভাবিক উচ্চতার বলা হয়। ‘বাস্কেটবল’ খেলাটা নাকি লম্বা মানুষের জন্যই। কথাটা আংশিক নয় – পুরোপুরি সত্যি। পেশাদার বাস্কেটবল খেলোয়াড়েরা সবাই বেশ লম্বা। অস্বাভাবিক লম্বা হবার সবচেয়ে বড় ফায়দা সম্ভবত এটাই; একটু চেষ্টা করলেই বাস্কেটবল খেলোয়াড় হওয়া যায়। এদিক থেকে ভিন্ন ছিলেন অস্বাভাবিক উচ্চতার এক ক্রিকেটার – যিনি বাস্কেটবল ছেড়ে ছুটে আসেন ক্রিকেট মাঠে।

৭ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতা – তিনি চাইলেই বাস্কেটবলে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন। একপ্রকার জোর করে পেশাদার বাস্কেটবলার হিসেবে খেলতে নিয়েও যাওয়া হয়েছিল। তবে তার স্বপ্নটা ছিল ক্রিকেটার হওয়া। যে গ্রামে তিনি ছিলেন – সেখান থেকে ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়াটাও ছিল বেশ কঠিন ব্যাপার।

তাও আবার সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে পারবেন কি-না সেটিও অনিশ্চিত। বাস্কেটবল মাঠে একের পর এক বল ঝুড়িতে ফেলে পয়েন্ট আদায় করছেন। তবে, মনটা পড়ে আছে ক্রিকেট মাঠে। কোনদিকে যাবেন? নিশ্চিত সাজানো ক্যারিয়ার, নাকি অনিশ্চয়তায় ঘেরা এক স্বপ্নের পানে?

ads

মনে মনে হয়ত পণ করে ফেলেছিলেন। সেটি রক্ষার্থে নিশ্চিত ক্যারিয়ার পেছনে ফেলে পালিয়ে এলেন ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়তে।

কাঁধ অবধি লম্বা চুল আর সাত ফুটের বেশি উচ্চতা। ১৪০+ কি.মি/ঘন্টায় অনবরত বল করে চলেছেন। ইয়র্কার, বাউন্সার সব কিছুই অনায়াসে করছেন। অস্বাভাবিক উচ্চতার কারণে তো অনেক ক্ষেত্রে তিনি না চাইতেও বল অতিরিক্ত বাউন্স হয়ে ব্যাটারের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। বিধ্বংসী বাউন্সে ব্যাটারকে নাস্তানাবুদ করছেন হেসে খেলেই – এমন দৃশ্য দেখাতেই কি-না বাস্কেটবল ছেড়ে ছুটে এসেছেন ২২ গজে?

সাল ২০১৮। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) এক অনন্য রেকর্ড। চার-ছক্কার ফুলঝুরি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৪ ওভারে ৩ মেইডেন সহ মাত্র ১ রানে ২ উইকেট! পাড়ার ক্রিকেটে এমনটা ঘটলেও অনেকেই হকচকিয়ে উঠতেন।

সেখানে ফ্র‍্যাঞ্চাইজি এক টুর্নামেন্ট, তাও আবার টি-টোয়েন্টির বিধ্বংসী তারকদের সামনে এমন স্পেল যেন অবিশ্বাস্য আর অতিমানবীয় কিছু। ২৪ বলের ২৩ ডট! মাত্র ১ রান সঙ্গে ক্রিস গেইল ও এভিন লুইসের উইকেট শিকার করে টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড গড়েন সাত ফুটের সেই মানব।

নিজের সামর্থ্যের সেরাটা তিনি প্রমাণ করেছিলেন ব্রিজটাউনে ক্যারিবীয়দের ডেরায়। বাস্কেটবল হাতে তিনি পয়েন্টস কুঁড়াতে ঝুড়ি অবধি ছুঁতে পেরেছিলেন। কিন্তু ক্রিকেট বল হাতে নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেছেন অনন্য এক রেকর্ডে।

মোহাম্মদ ইরফান – পাকিস্তান তথা বিশ্ব ক্রিকেটেই বেশ পরিচিত এক নাম। বাঁ-হাতি এই পেসার ছোট্ট এক গ্রাম থেকে উঠে এসে পাকিস্তানের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ডটা নিজের নামে করেন ২০১৮ সালের সিপিএলে। প্রথম দেখায় দূর থেকে আপনি ভাবতে পারেন কোনো এক খাম্বা হেঁটে যাচ্ছে – খোদ ইরফানের কোচই প্রথম দেখায় দূর থেকে এমনটা ভেবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান।

গাগু মান্ডি – পাকিস্তানের লাহোর প্রদেশের ছোট্ট এক গ্রাম। সেখানেই বেড়ে ওঠা মোহাম্মদ ইরফানের। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ‘ফৌজি’ হিসেবে যোগ দিবে। তবে, ইরফান চেয়েছিলেন ক্রিকেটার হতে। কিন্তু উচ্চতার কারণে একপ্রকার জোর করেই তাঁকে ফৌজিতে নেওয়া হল বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে।

বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে তিনি না চাইতেও যেন সফল ছিলেন! দাঁড়িয়ে থেকে বল জালে ফেলাটা তার জন্য ছিল সবচেয়ে সহজ কাজ। কিন্তু সেখানে মন টিকলো না। সুযোগ পেয়েই পালিয়ে এলেন! পরিবারকে জানালেন ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়তে চান।

বাড়ির কাছে গাগু মান্ডি ক্রিকেট ক্লাব। রোজ সময় পেলেই সেখানে ছুটে যেতেন ক্রিকেট খেলতে। স্কুল আর বাড়ি এই দুইয়ের মাঝে ইরফানের জীবনে ছিল স্রেফ ক্রিকেট। পাশাপাশি নিজের খরচ যোগাতে ইরফান তখন এক পাইপ ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন; মাত্র ২০০ রুপিতে পাইপ বানানোর কাজ করতেন এই পেসার। কাজ শেষে ফিরে যেতেন মাঠে। ইরফানের উচ্চতা, পেস, বাউন্স সবকিছুই নজর কাড়ছিল গ্রামের অনেকের। ইরফানের প্রতিভার কথা কানে গেল সাবেক পাকিস্তানি তারকা আকিব জাভেদের।

ইরফানকে লাহোর ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিতে ডাকা হল। যদি নিজের প্রতিভা দেখাতে পারেন তাহলে থাকবেন, নয়তো গাগু মান্ডির বাস ধরতে হবে – এমনটাই জানানো হল। সপ্তাহ খানেকের মাঝেই ১৩৫ কি.মি/ঘন্টায় বল করতে লাগলেন ইরফান।

প্রাথমিক পরীক্ষায় টিকে গেলেন। বিভিন্ন দলের বিপক্ষে খেললেন, পাঁচ উইকেটও নিলেন। উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে স্বাভাবিক বলগুলোও ব্যাটারদের জন্য ছিল বাউন্সার। উচ্চতার কারণেই গোটা টিমের মাঝে সবার নজর কাড়তে সহজ ছিল ইরফানের জন্য।

২০০৯ সালে খান রিসার্চ অ্যাকাডেমির হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। সেখানে ১০ ম্যাচে ৪৩ উইকেট নিয়ে নজর কাড়েন এই বাঁ-হাতি পেসার। ক্লাব ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে ডাক পেলেন পাকিস্তান ‘এ’ দলে। সেখান থেকে দ্রুতই পা ফেলেন জাতীয় দলের সবুজ গালিচায়।

২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক। প্রথম দুই ম্যাচেই উইকেটশূন্য! অভিষেকটা ছিল অনেকটা দু:স্বপ্নের মত। বাদও পড়লেন ওই সিরিজেই। ২ বছর তিনি দলের বাইরে। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে ঠিক দ্যুতি ছড়িয়ে বছর দুয়ের মাঝে আবার ফিরলেন জাতীয় দলে। ২০১২ সালে চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভার‍তের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক। বছর খানেকের মাথায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক।

সাদা পোশাকে ফিরতে পারেননি আর। তবে রঙিন জার্সিতে কিপটে বোলিংয়ে পাকিস্তানকে আশা দেখিয়েছে। নতুন বলে দুর্দান্ত স্যুইং আর বাউন্সে প্রতিপক্ষের ওপেনারদের মাত দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। প্রত্যাবর্তনের পর বছর চারেক দলের অনেকটা নিয়মিত মুখ ছিলেন তিনি।

ওয়ানডেতে পাঁচের নিচে আর টি-টোয়েন্টিতে আটের নিয়ে ইকনমি – সময়ের বিচারে বেশ ভালই বলা চলে। কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেট আর ফিক্সিং যেন এক সূত্রে গাঁথা। সেই সূত্রের বাঁধনে সন্দেহের তালিকায় নাম যুক্ত হল ইরফানের।

২০১৭ সালে ফিক্সিং ইস্যুতে আটকা পড়েন ইরফান। ফিক্সিং সন্দেহে ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা পান এই পেসার। ক্যারিয়ারটাও সেখানেই থমকে গেল। এরপর নিষেধাজ্ঞা উঠলেও জাতীয় দলে আর নেই তিনি। ২০১৯ সালে ৬ ওয়ানডেতে সুযোগ পেয়েছিলেন; কিন্তু অচেনা এক ইরফানকে দেখা গেল বল হাতে। কিপটে শব্দটাকে যেন ছেঁটে ফেলে খরুচের খাতায় নাম লিখিয়েছেন!

ফ্র‍্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে দেখা মিললেও জাতীয় দলের গালিচায় আর দেখা নেই ইরফানের। এখনও তিনি ফিরতে মরিয়া। তবে সেটা আদৌ আর সম্ভব হবে কি-না সেটাও অজানা। ‘অনিশ্চিত ক্যারিয়ার’ – এর মানেটা হয়ত এখন তিনি বেশ ভাল করেই উপলব্ধি করতে পারছেন। তবু নিজের স্বপ্নকে সত্যি হতে দেখে হয়ত কখনো আফসোস করবেন না। কিন্তু মনের গহীনে কোথাও তিনি ভাবছেন – বাস্কেটবলই হয়ত সফলতার সেরা মঞ্চ হত?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link