More

Social Media

Light
Dark

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী ফুটবলময়

দারিদ্রতা আর নানা প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে পৃথিবীতে টিকে আছেন এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। দারিদ্রতার সাথে লড়তে লড়তে অনেকেই হেরে গিয়েছেন, কেউ আবার নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে দিন পার করেছেন এভাবেই। আবার কেউ কেউ দারিদ্র্যতার সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন সফলতার শীর্ষে। দারিদ্র্যতার সাথে লড়াই করে পৃথিবীতে অনেকেই বনে গিয়েছেন বিখ্যাত। জীবনে নানা প্রতিকূলতার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে সেরা বনে যাওয়া এক তারকার নাম – সার্জিও আগুয়েরো।

কুন আগুয়েরো নামেও ফুটবল পাড়ায় বেশ পরিচিত তিনি। দারিদ্র্যতার সাথে লড়াই করে জীবন যুদ্ধ সফল হওয়া গল্পগুলোতে আগুয়েরো অনায়াসে টিকে যাবেন।

আর্জেন্টিনা তথা ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফুটবলারের একজন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার হয়ে সর্ব কনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ডিভিশন ফুটবলে খেলার রেকর্ডটা ছিল ম্যারাডোনার নামে। কিন্তু মাত্র ১৫ বছর বয়সে ডিভিশনে অভিষেক হয়ে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন সার্জিও আগুয়েরো। এক দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে ম্যারাডনার রেকর্ড নিজের করে নেন! সেখান থেকে বনে যান আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা।

ads

জন্ম নিয়েছিলেন এক দরিদ্র পরিবারে। পৃথিবীর আলো দেখতে পারবেন কি-না সে নিয়েও ছিল ভয়। বাবা লিওনেল দেল কাস্তিলো ও মা আদ্রিয়ানা আগুয়েরো। নিজেদের প্রথম সন্তানের সময় কাস্তিলোর বয়স ১৭ ও আদ্রিয়ানার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর।

জীবনযাপন একটু সহজ আর ভাল করতে আর্জেন্টিনার তুকুনাম নামক অঞ্চল থেকে লিওনেল ও আদ্রিয়ানা মেয়েকে নিয়ে পাড়ি জমান বুয়েন্স আয়ার্সে। সেখনে দূষিত নদী লস ভিবোরাসের কাছে পারিবারিক সূত্রে (সৎ ভাই) পাওয়া এই খন্ড জমিতে শূন্য থেকে শুরু করেন। কোনো রকমে মাথা গোজার ব্যবস্থা করেন লিওনেল। মাথা গোজার ঠাই হলেও সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হত প্রতিনিয়ত। খাবার সংকট তো ছিলই।

বাড়ির কাছেই ছিল ফুটবলের মাঠ। লিওনেলের ফুটবলের প্রতি ঝোঁকটা ছিল বেশ। সেখানেও টুকটাক কাজ করে আয় করতেন। আর খেলা দেখার সুযোগ তো ছাড়তেন না বললেই চলে। ধীরে ধীরে সময় গড়াতে থাকে আর আগুয়েরোর ভূমিষ্ঠ হবার সময় ঘনিয়ে আসে। ঠিক সে সময় প্রকৃতির বিরূপ আচরণ!

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ঘরে থাকার মত অবস্থাও ছিল না। বন্যায় বাড়ির অনেকাংশই ডুবে গেল। কোনরকমে গর্ভবর্তী স্ত্রীকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছালেন লিওনেল। কিন্তু সেখানে আরও বিপত্তি। প্রসব বেদনায় ছটফট করছিলেন স্ত্রী আদ্রিয়ানা।

আর্থিক ভাবে চরম বিপদে থাকা লিওনেল স্ত্রীকে এই মূহুর্তে হাসপাতালে কিভাবে নিবেন ভেবেও পাচ্ছিলেন না। রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। জীবন বাঁচাতে দলে দলে মানুষ আশ্র‍য় নিয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। আশেপাশের স্কুলগুলোকেই আশ্র‍য়েকেন্দ্র বানানো হয়েছিল।

অনেক বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে গঞ্জালেস কাতান হাসপাতালে স্ত্রীকে নিয়ে পৌঁছালেন লিওনেল। আদ্রিয়ানার শারীরিক অবস্থাও ভাল না। সময়ের আগেই ডেলিভারি করতে হবে! এমন অবস্থায় সন্তান কিংবা মায়ের যেকোনো কিছুই হতে পারে। সুস্থভাবে আসা তো দূর আগুয়েরো দুনিয়ার আলোর মুখ দেখবেন কি-না সে নিয়েও ছিল সংশয়। কিন্তু সব সংশয় আর সম্ভাবনা দূর করে প্রতিবন্ধকতা পার করে সুস্থভাবেই সেদিন পৃথিবীর বুকে এসেছিলেন আগুয়েরো।

বাড়ির পাশের ফুটবল মাঠে খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠা। বাবার মত ছেলেরও ঝোঁক ফুটবলের প্রতি। পাঁচ বছর বয়স থেকে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন তিনি। পাঁচ বছর বয়স থেকেই টাকার বিনিময়ে খেলতেন তিনি! স্থানীয় টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলে ইয়ুথ স্কাউটস ক্লাবের হয়ে চুক্তিবদ্ধ হন। এরপর পরের কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ক্লাবের হয়ে তিনি খেললেন; যেখানে খেলেছেন নিজের প্রতিভা দিয়ে নজর কেড়েছেন সবার।

আট বছর বয়সে ইন্ডিপেন্ডিয়েন্ট ক্লাবে যুক্ত হন আগুয়েরো। সেখান থেকে দ্যুতি ছড়িয়ে আর্জেন্টিনার বয়স ভিত্তিক দলে সুযোগ পেয়ে গেলেন। স্ট্রাইকার হিসেবে শুরু থেকেই খেলতেন তিনি। অনূর্ধ্ব-১৭, ২০ ও অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে খেলেছেন এই আর্জেন্টাইন তারকা।

২০০৬ সালে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে অভিষেক। তরুণ বয়সেই দুর্দান্ত পারফর্ম করে নজর কাড়লেন ক্লাবগুলোর। ওই বছরই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে চুক্তিবদ্ধ হলেন। সেখান থেকে পরবর্তীতে পাড়ি জমান ম্যানচেস্টার সিটিতে। দুই দলের হয়েই তিনি বেশ সফল একজন। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে ২৩৪ ম্যাচে ১০১ গোল আর সিটির হয়ে ১৬ হ্যাটট্রিক সহ করেছেন ২৬০ গোল। সিটির জার্সিতে পাঁচবার জিতেছেন তিনি।

প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা অবশ্য আগুয়েরো। প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে ২৭৫ ম্যাচে করেছেন ১৮৪ গোল; লিগের চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। প্রিমিয়ার লিগে করেছেন ১২ হ্যাটট্রিক; যা কিনা ওই লিগে সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিকের রেকর্ড। এরপর সিটি ছেড়ে সতীর্থ লিওনেল মেসির সাথে আসেন বার্সেলোনায়। সেখানে থেকেই বিদায়!

২০০৪ সালে প্রথম পেশাদার ফুটবলে গোলের দেখা পান। এরপর পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে সব ধরনের ৩৭৯ গোল করেছেন। সেই সাথে অ্যাসিস্ট করেছেন ১৪৬ গোলে। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়েও তিনি তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার ৫৪ গোলের পরই ৪২ গোল নিয়ে তিনি আছেন তৃতীয়তে।

জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া সেই আগুয়েরো ৩৩ বছর বয়সে এসে হার মেনেছেন হৃদরোগের কাছে। শরীরটা অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠেছে। আর সায় দিচ্ছিল না। তাই বেশ খানিকটা আগেই ফুটবলকে বিদায় জানাতে হল এই আর্জেন্টাইন তারকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link