More

Social Media

Light
Dark

অনবদ্য এক অলিখিত অধিনায়ক

২০১২ সালে যখন টটেনহ্যাম হটস্পার থেকে রিয়াল মাদ্রিদে এসেছিলেন তিনি, তখন কানে বেজে উঠেছিল – ‘The worst signing of this season for Real Madrid!’ কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের মৌসুমের সবচেয়ে বাজে সাইনিং কাল ক্রমে হয়ে উঠলো ড্রেসিং রুমের আরাধ্য একজন, মাঠের কাঙ্ক্ষিত একজন। তিনি ‘লুকা মদ্রিচ’ – রিয়াল মাদ্রিদের অলিখিত একজন অধিনায়ক।

মদ্রিচের জন্ম ক্রোয়েশিয়া নামক ছোট্ট একটি দেশের জাদার নামক শহরে। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে পড়ার পর বলকান অঞ্চলে যে নির্মম গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, মদ্রিচ সেই সময় বেড়ে ওঠা একজন ক্রোয়েশিয়ান। আট দশটা সাধারন শিশুর মত নয়, মদ্রিচ বেড়ে উঠেছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত এক শহরে। বেড়ে উঠেছিল বন্দী শিবিরে। মদ্রিচের অবশ্য বলেছেন, যুদ্ধ তাকে আরো শক্তিশালী করেছে।

সে-সময় যেখানে মাইনের ভয়ে ভয়ে মাটিতে হাঁটতে হতো, সেখানে সারাদিন বল নিয়ে মাঠে ঘাটে দৌড়ে বেড়াতেন লুকা৷ না, কোনদিন মাইন দুর্ঘটনার শিকার হননি তিনি, বিধাতা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাঁচিয়ে রেখেছে ক্রোয়েশিয়া জাতীয় দলের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য, বাঁচিয়ে রেখেছে অগনিত মাদ্রিদিস্তা’র চোখের মনি হয়ে উঠার জন্য।

ads

২৬ বছর বয়সী লুকা মদ্রিচ রিয়াল মাদ্রিদে এসেছিলেন মৌসুমের সবচেয়ে বাজে সাইনিং হিসেবে, এরপর দুই মৌসুম ছিলেন খোলসের ভিতরেই। নতুন জায়গা, নতুন দলে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে মদ্রিচ খারাপ থেকে হয়েছেন ভাল, ভাল থেকে হয়ে উঠেছেন অতুলনীয়। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সম্ভাব্য সবকিছু জিতেছেন, জিতেছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা, ক্লাব বিশ্বকাপ, কোপা দেল রে সহ সবই। তবু ৩৬ বছর বয়সী মানুষটার জয়ের ক্ষুধা কমেনি এক বিন্দু।

এই ৩৬ বছর বয়সে এসেও তার ক্ষিপ্রতা কমেনি একটুও। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মদ্রিচের ফিটনেস কমে না, ক্লান্তি ভর করে না দুই পায়ে। প্রতিপক্ষের আক্রমণ থামিয়ে দিয়ে দলের আক্রমণ গড়ে দিতে একটু সমস্যাও হয় না। তার এমন মানসিকতা ফুটে উঠে প্রতিটি ম্যাচে। ঠাণ্ডা মাথায় মধ্যমাঠ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে দু’দলের মাঝমাঠের যুদ্ধে একক বিজয়ী হয়ে উঠেন লুকা মদ্রিচ।

এইতো সেদিন প্যারিস সেইন্ট জার্মেই এর বিপক্ষে কাব্যিক এক কামব্যাক হিস্টোরি সৃষ্টি করেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। সেই ইতিহাস সৃষ্টির জন্য সবার আগে যে দুইটি নাম আসবে তার একটি লুকা মদ্রিচ। স্তুতিবানী বলা এখনো শেষ হয়নি ভক্তদের অথচ আরেকটা ম্যাচ, আরো একটা সম্মোহনী পারফরম্যান্স লোকটার। এবার চেলসির বিপক্ষে।

ঘরের মাঠে চেলসির কাছে দলের যখন প্রায় – ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা, তখন লুকা মদ্রিচ এগিয়ে এসেছেন তার শক্তিশালী কাঁধ নিয়ে। ৩৬ বছর বয়সী এই কাঁধ জোড়া আরো অনেক রাতের মতই আবারো তুলে নিয়েছে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু-য়ের স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব। ছোট থেকে লড়াই করতে করতে এ পর্যন্ত আসা লুকিতা এবারও লড়াই করেছেন, জিতেছেন।

চাপের মুখে থাকা দলকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন জয়ের পথে। স্বীকৃতি দিতেও ভুল হয়নি কতৃপক্ষের, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগ এর ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন ক্রোয়াট মিডফিল্ডার।

গত একযুগে লিওনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো’র বলয় ভেঙে ব্যালন ডি’অরের মঞ্চে উঠতে পারা একমাত্র ফুটবলার লুকা মদ্রিচ। মিডফিল্ডার হওয়াতে নিয়মিত গোল পাওয়া হয় না, আলোচনার কেন্দ্রতেও তাই কম থাকা হয়। তবু তিনি খেলেন, নিজের সবটুুকু দিয়ে।

বলা হয়, মদ্রিচ তাঁর শরীরের কথা শোনেন না। শরীর মদ্রিচের কথা শোনে। না হলে মাঝবয়সে এসেও এভাবে ১২০ মিনিট ধরে প্রতিপক্ষের তরুনদের সাথে সমানে সমানে বল দখলের লড়াই করা কোন সাধারন খেলোয়াড়ের কাজ নয়।

অতিমানবীয় পারফরম্যান্স করলেও তিনি মানুষ, হয়তো আর অল্প কিছু সময় রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে জড়াবেন। এরপর তো শেষ, কিন্তু ক্রোয়াট এই তারকা থেকে যাবেন তার প্রতিটি অর্জনে। মাদ্রিদিস্তাদের হৃদয়ে থাকবেন এমন স্বপ্নীল কিছু রাত উপহার দেয়ার জন্য। লুকা মদ্রিচ থাকবেন রয়্যাল মাদ্রিদের ইতিহাসেও। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়ের কোথাও লুকা মদ্রিচের ভাস্কর্য কখনো তৈরি হবে কি না সেটা জানি না, তবে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়ের দূর্বাদলে সবসময়ের জন্য মিশে থাকবেন রিয়াল মাদ্রিদের এই মাঝমাঠের জাদুকর কিংবা কাণ্ডারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link