More

Social Media

Light
Dark

‘বিরাট’ মানুষের বন্দনা করি

প্রায়ই দেখি যে লোকে বলে, বিরাট কোহলিকে মানুষ হিসেবে সে দেখতে পারে না। কিন্তু ব্যাটসম্যান কোহলিকে স্বীকার না করে পারে না! আমিও প্রথমদিকে কোহলিকে ‘বেয়াদব’ মনে করতাম। আস্তে আস্তে যতই কোহলিকে দেখি ততই মুগ্ধ হই এবং হচ্ছি!

কিন্তু তাঁকে শুধু ‘ক্রিকেটার’ বিবেচনায় ভাল কেন বলতে হবে?

সে মানুষ হিসেবেও খুব ভাল! মাঠের বাইরে তার একটা খারাপ উদাহরণ আছে? ফিল হিউজের মৃত্যুর পরে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের বাইরে সে একমাত্র ক্রিকেটার যে হিউজের ফিউনারেলে গিয়েছিল। তার কোহলি ফাউন্ডেশনের কাজের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তাতে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের থেকে শুরু করে এতিম শিশু, আবার ক্রিকেটার তৈরি করার জন্য তরুণ প্রতিভাও খুঁজে বের করা হয়। সে নিজে এতিম শিশুদের সাথে গিয়ে সময় কাটায়, বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে সময় কাটায়।

ads

হিউম্যানিট্যারিয়ান দিক না হয় সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি। বাদ দেই। ক্রিকেটে আসি। সে মাঠের বাইরে তার লেভেলে সব জিনিয়াসদেরই শ্রদ্ধা করে। একটা ছোট উদাহরণ দেই। ২০১৬ এশিয়া কাপের আগে সংবাদ সম্মেলনে নিজে থেকে পুরো সংবাদ সম্মেলন জুড়ে মুস্তাফিজ আর রাবাদার প্রশংসা করে গিয়েছেন। সাংবাদিকরা কিছু বলেনি। তাঁরা দু’জন সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বোলার। কিভাবে তাদের আরও ভাল করতে হবে, তাদের সমীহ করতে হবে; সেগুলো বলে গিয়েছেন।

পাকিস্তানের আমিরকে সে এতোটাই এপ্রিশিয়েট করেছেন যে বিশ্বকাপ ম্যাচের আগে গিয়ে আমিরকে নিজের ব্যাট উপহার দিয়ে এসেছিলো। এশিয়া কাপের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ সেরা হবার পরে নিজের কথা বাদ দিয়ে আমিরের স্পেলের প্রশংসাই করে গিয়েছেন!

নিজের ব্যাটিং নিয়ে এত রেকর্ডের পরেও শচীন টেন্ডুলকারের সাথে তুলনা হলেই বলেন যে তাঁরটা পুরোটাই পরিশ্রমের ব্যাপার। শচিনের সাথে তাঁর তুলনাই হতে পারে না। এবিডি ভিলিয়ার্স তাঁর চেয়ে ভাল ব্যাটসম্যান বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেন। স্টিভেন স্মিথ, কেন উইলিয়ামসনকে তার চেয়ে ভাল মানেন। রোহিত শর্মা তার চেয়ে বেশি প্রতিভাবান; এটা সব জায়গায় বলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে আসি। এখনকার মিডিয়ার যুগলরা সবকিছু লুকাতে পছন্দ করে। অথচ সে সব জায়গায় হাই ভোকালে আনুশকাকে আগলে রাখেন। ২০১৫ বিশ্বকাপের পরে প্রবল সমালোচনার মুখে এয়ারপোর্টে শক্ত হাতে আনুশকাকে ধরে রেখে জনগণের সামনে নিজের স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন।

সব জায়গায় বলেন যে আনুশকা তার জীবনকে গোছাচ্ছেন! তাঁর কথাগুলো একটা মেয়ের মধ্যে নির্ভরতার বার্তা দেয়। এখন আনুশকাকেই বিয়ে করে আপাতত ভারতের অনুসরণীয় জুটি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছেন।

বাকি রইলো মাঠে কম্পিটিটিভ থাকার বিষয়টা, গালি দেবার বিষয়টা। লক্ষ্য করলে দেখবেন আগে সে যেভাবে গালি দিতো গেল কয়েকটা বছরে তা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি ‘আপ কি আদালত’ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। ওখানে তার বিরূদ্ধে এই অতি আক্রমাত্মক ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে তাঁর এই ব্যবহার বাচ্চারা শিখবে। তখনই কোহলি কথা দিয়েছিল যে সে চেষ্টা করবে এই ব্যাপারটা পরিহার করতে।

তিনি এরপরে অনেকটাই কমিয়েছেন। এটাকেই নিজেকে শোধরানো বলে। তবু এখনও তিনি যে স্লেজিং করেন না, বা অতি আক্রমাত্মক হন না, তা নয়। কিন্তু মাঠের মধ্যে যেমন বাউন্সার খেয়ে মিচেল স্টার্ককে গালি দেন, তেমনি মাঠ থেকে বের হয়েই সেই স্টার্কের সাথেই গলা মেলান, সংবাদ সম্মেলনে স্টার্কের প্রশংসা করেন। আবার যেমন স্টিভেন স্মিথের প্রশংসা করেন ব্যাটসম্যান হিসেবে, সমীহ করেন; ঠিক তেমনি স্মিথের ‘ব্রেইন ফেড’ নিয়ে তীব্র ঝাঁঝালো মন্তব্য করেন!

আইপিএল-এর প্রথম দুই মৌসুমের পরে তিনি বুঝে ফেললেন যে ফিট না হলে একটুও উপায় নেই। তিনি দিল্লীর ছেলে। তাঁর প্রিয় খাবার ‘বাটার চিকেন’। গত ৫-৬ বছর হয় তিনি ‘বাটার চিকেন’ খান না, মিষ্টি খান না। সেদ্ধ মুরগী, সবজিই তাঁর খাওয়া। অফ সিজনেও প্রতিদিন ন্যূনতম গড়ে চার ঘণ্টা জিমে কাটান।

তাঁকে এতো পার্টিবাজ হিসেবে জানি আমরা, বলিউড নায়িকা তাঁর স্ত্রী। অথচ, একেবারেই বিশেষ কোন অনুষ্ঠান ছাড়া সব সময়ই রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। প্রতিদিন রাত ১০ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন, এমনকি খেলা না থাকলেও!

আমি জানি দর্শকদের মত কোহলি নিজেও খুব করে অপেক্ষা করে ছিলেন পরবর্তী ইংল্যান্ড সফরের জন্য। গত কয়েক বছরের মধ্যে ইংল্যান্ডের মাটিতে অফ ষ্ট্যাম্পের বাইরের বল খেলতে না পারাটাই তার একমাত্র ব্যর্থতা। ১০ ইনিংসে ৫৯.৩০ গড়ে ৫৯৩ রান করে জবাব দিয়েছেন, দেখিয়েছেন একাগ্রতা নিয়ে নিজেকে উন্নত করার আদর্শ উদাহরণ!

প্রত্যেকটা ম্যাচ শেষে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করেন। কোন একটা শট ভুল হলে সেটা কিভাবে ঠিক করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করে। এমন রেকর্ড থাকার পরেও কয়জন ব্যাটসম্যান প্রতিটা ম্যাচ শেষে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে এতোটা প্যাশনেট থাকে?

সেদিন এক সাক্ষাৎকারে তার ট্রেনিং আর হার্ডওয়ার্ক নিয়ে কথা বললেন, ‘একটা ক্যাচের কথাই ধরেন, ক্যাচ ধরতে দৌড় শুরু করলেন, মিস হলো, মানুষ বললো ‘গ্রেট এফোর্ট’। কিন্তু আপনার ক্যাচ ধরতে গিয়ে পয়েন্ট এ থেকে পয়েন্ট বি-এর দূরত্ব কাভার করতে আপনার ত্বরণ কত সেকেন্ডে হয়েছে, তার জন্য আপনি কতটুকু ট্রেনিং করেছেন, আপনার পুষ্টি কতটুকু ছিল, ঘুম ঠিক টাইমে ছিল কিনা এসব জিনিসই ঠিক করবে অই দূরত্ব আপনি ৩ সেকেন্ডে কাভার করেছেন নাকি ২ সেকেন্ডে কাভার করেছেন।

আপনি ২ সেকেন্ডে কাভার করতে পারলে সহজ ক্যাচ। আপনি ৩ সেকেন্ডে কাভার করলে ‘গ্রেট এফোর্ট’ এটা খুব সামান্য মার্জিন এর ব্যাপার, এক সেকেন্ডের ব্যাপার। আপনি কি ওই এ সেকেন্ডের জন্য ট্রেনিং এবং হার্ডওয়ার্ক করছেন কিনা সেটাই হল আসল কথা!’ – এভাবে কে চিন্তা করে, কয়জন চিন্তা করে?

বিরাট কোহলির প্রফেশনালিজম, ক্রিকেটীয় সেন্স, পরিশ্রম, মানুষ হিসেবে কাজকর্ম দেখার পরে শুধুমাত্র মাঠের মধ্যে তার প্যাশন বা অ্যাগ্রেশন দেখে তাঁকে ‘গালি দেয়া’ বা ‘শুধু ব্যাটসম্যান’ হিসেবে ভাল বলা একেবারেই উট পাখির বালিতে মুখ ডুবানোর পরিচায়ক!

বাবার মৃত্যুর পরের দিন শুধুমাত্র প্যাশন আর প্রফেশনালিজম থেকে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন। ফলো অন বাঁচানো ৯০রান করেছিলেন ২৩৮ বলে। নিজেই বলেছেন যে যেদিন সকালে উঠে মনে হবে শরীর আর চলছে না, অথবা ক্রিকেটের প্রতি প্যাশনটা কমে গিয়েছে, অথবা জয়ের ক্ষুধা আসছে না। সেদিনই তিনি ক্রিকেট ছেড়ে দিবেন!

এটাই বিরাট কোহলি। তাঁর রেকর্ডের খতিয়ানে গেলাম না। যেদিন অবসর নিবেন সেদিন এ নিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করা যাবে! তিনি ব্রায়ান লারার মতো ব্যাটিংয়ের বরপুত্র নয়। তিনি শচিন টেন্ডুলকারের মতো প্রতিভা আর বিশুদ্ধতার মিশেলও নন। এমনকি নিজ দলের রোহিত শর্মার মতো টাইমিং করার প্রতিভা নিয়েও আসেনি!

তবুও তিনি অনুকরণীয়। প্রত্যেকটা মুহূর্তে নিজেকে কিভাবে উন্নতি করতে হয়, পরিশ্রম করে কিভাবে নিজেকে খুব ভাল থেকে গ্রেট থেকে গ্রেটেস্টদের কাতারে নিয়ে যেতে হয়, তাঁর আদর্শ উদাহরণ বিরাট কোহলি! আপাতত ‘মানুষ’ কোহলির বন্দনা করি। আর নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবি যে এই কোহলিকে আমরা ‘লাইভ’ দেখতে পারছি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link