More

Social Media

Light
Dark

রোনালদিনহোর পাগলাটে সেই ১২ মিনিট

১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বকাপের প্রথম আসর। এর আরো অনেক আগে থেকে বিশ্বের অবিসংবাদিত সেরা খেলা হল এই ফুটবল। আর ফুটবলের সবচেয়ে জমজমাট খেলাগুলোর দেখা মেলে বিশ্বকাপের মঞ্চে।

তেমনই এক জমজমাট ক্লাসিকে জড়িয়ে আছে ২০০২ বিশ্বকাপের নাম। দিনটা ছিল ২১ জুন। সেদিন জাপানের সিজুকা স্টেডিয়ামে। মুখোমুখি হয় ব্রাজিল ও ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের লড়াইয়ে।

  • কী হয়েছিল সেদিন?

রোনালদিনহোর ফ্রি-কিকটা কি সত্যিকারভাবেই গোলের উদ্দেশ্যেই ছিল? কাকতালীয় কী? নাকি ক্রস করতে গিয়ে সৌভাগ্যবশত গোল হয়েছে? – সেই ফ্রি-কিক গোলটা নিয়ে আজও এমন প্রশ্ন করে থাকেন অনেক ফুটবল সমালোচক। কিন্তু সব অমর কৃতিত্বই কী এমনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় না!

ads

সেটা যাই হোক, আপনি গোলটা যে কোণ থেকেই দেখেন না কেন আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না রোনালদিনহো গোল করার উদ্দেশ্যে বলটি বাতাসে ভাসাননি। আরও কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যায় এই ম্যাচ নিয়ে, অসাধারণ এই ফ্রি-কিক গোলটা না হলে কি হতো? কিংবা গোলরক্ষক ডেভিড সিম্যান যদি আরেকটু পিছনে থাকতেন?

যে যেটাই ভাবুক, ২০০২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে একজন উদীয়মান তারকার জন্ম হয়েছিল বিশ্বমঞ্চে যে কিনা ঠিক করে দিয়েছিল একটি বিশ্বকাপ ক্ল্যাসিক ম্যাচের গতিপথ। দুই ফুটবল পরাশক্তির লড়াইয়ে ছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ছিল পিছিয়ে পড়েও ফিরে আসার গল্প এবং অনেকগুলো ‘যদি, কিন্তু’ প্রশ্ন।

  • পেছনের গল্প

১৯৭০ বিশ্বকাপের পর এই প্রথম মুখোমুখি ব্রাজিল আর ইংল্যান্ড। একদিকে আছে ফুটবলের উদ্ভাবক, আরেকদিকে ফুটবলকে যারা ‘দ্য বিউটিফুল গেম’ তকমা এনে দিয়েছে। এমন দুই দলের মাঠের যুদ্ধ ঐতিকাসিক কিছু নিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক, ১৯৭০ এর মতো ২০০২ ও উপহার দেয় জমজমাট একটি লড়াই। যে হারবে তাকে ধরতে এয়ারপোর্টের বাস, আর বাকি দল যাবে সেমিফাইনালের টিকেট।

আগের নক আউট ম্যাচে স্কলারির ব্রাজিল হারিয়ে এসেছে পরিশ্রমী দল হিসেবে পরিচিত বেলজিয়ামকে। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ছিল ডেনমার্ক। পরাশক্তি না হলেও ইউরোপের যেকোন মধ্যম সারির দলই বড় দলের জন্য ভোগান্তির কারণ, তবে দুই দলই সেই বাঁধা পেড়িয়ে এসেছে বিশ্বকাপে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে।

  • ম্যাচের গল্প

৪৭০০০ এর বেশি সৌভাগ্যবান দর্শকে ঠাসা জাপানের সিজুকা স্টেডিয়াম। অপেক্ষা রোনালদো ব্যাকহামদের ফুটবল দর্শনের।

দুই দলই বিপদ এড়িয়ে খেলার চেষ্টাই ছিল, ব্রাজিল ডমিনেট করছিল। এর মধ্যেই ২৩ মিনিটের মাথায় গোল হজম করে ব্রাজিল। এমিল হেস্কি মাঝমাঠে হঠাত ফাঁকায় বল পেলে থ্রু বল বাড়িয়ে দেয় ওয়েন উদ্দেশ্যে।

সেখানে তাকে মার্ক করছিল লুসিও, কিন্তু বলের এঙ্গেল ধরতে ভুল করায় তার পা থেকে বল চলে যায় ওয়েনের কাছে। লিভারপুল তারকার সামনে শুধু গোলরক্ষক। লুসিও প্রার্থনারত, ওয়েন যদি কোন ভুল করে বসে। কিন্তু বড় মঞ্চে ওয়েন যে ভুল করার পাত্র না।

ইংল্যান্ড ১-০ ব্রাজিল। খেলা জমে গেল। ইংল্যান্ডের প্রথম ছোবলের জবাব কিভাবে দিবে ব্রাজিল, কিংবা আদৌ কি পারবে?

ব্রাজিলের সমতাসূচক গোল আসে শক্তিশালী একটা কাউন্টার এটাক থেকে – প্রথমার্ধের ইনজুরি টাইমে। বাম প্রান্তে ব্যাকহামের কাছ থেকে বল নিতে সক্ষম হোন রকি জুনিয়র, বল বাড়িয়ে দেন মাঝমাঠে যেখানে পউল স্কোলসকে পরাস্ত করেন ক্লেবারসন। বল চলে যায় রোনালদিনহোর পায়ে।

দুরন্ত গতিতে ছুটলেন ২২ বছর বয়সি রোনালদিনহো। দুইবার স্টেপওভারে ছিটকে ফেলে দিলেন এশলে কোলকে। সামনে দুই সেন্টারব্যাক, বামে রোনালদো, ডানে রিভালদো। রোনালদিমহো বেছে নেনে রিভালদোকে, আর আস্থার প্রতিদান দিতেও ভুল করেন নি বার্সা তারকা। তার বাম পায়ের দুর্দান্ত ফিনিশ সমতায় এসে দেয় ব্রাজিলকে।

ইংল্যান্ড ১-১ ব্রাজিলে, এই স্কোরলাইন নিয়ে হাফটাইমে যায় দুইদল। সমতা নিয়ে খেলা শুরু হলেও আগের হাফের শেষ মিনিটে গোল দিয়ে যেন ব্রাজিল একটু বেশি উজ্জীবিত। অন্যদিকে, ইংলিশ মিডফিল্ডকে ক্লান্ত মনে হচ্ছিল, অন্তত ইংল্যান্ড বস এরিকসেন এর তাই মনে হয়েছে।

মাঝ মাঠে বল ধরে রাখতে না পারার ফলস্বরূপ গোলপোস্টের প্রায় ৩৫ গজ দূরে স্কোলস ফাউল করেন ক্লেবারসনকে। ফ্রি-কিকে আসেন রোনালদিনহো, তার পাশে ছিলেন অধিনায়ক কাফু। ইংল্যান্ড গোলের সামনে প্লেয়ারদের জটলা। গোলরক্ষক সিম্যানও একটু সামনে আসেন, তারও অপেক্ষা রোনালদিনহোর ক্রসের।

কিন্তু সবাইকে বোকা বানিয়ে বলটি সবার মাথার উপর দিয়ে চলে যায় টপ কর্ণার দিয়ে জালে। রোনালদিনহোর ভাসানো বলটার হাইট এমন ছিল যে সেটা ঠেকানোর কোন বুদ্ধি ইংল্যান্ড গোলরক্ষকের ছিল না। ফলাফল ব্রাজিল ২-১ এ এগিয়ে গেল ম্যাচে।

এরপর ইংল্যান্ড অনেক চেষ্টা করেও ম্যাচে ফিরতে পারেনি। ওই গোলের সাত মিনিট পর রোনালদিনহো বিতর্কিতভাবে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন। কিন্তু দশজনের ব্রাজিল পেয়েও সেটার সুবিধা নিতে পারেনি ইংল্যান্ড। অনেকের মতে, বল ধরে রাখতে না পারার জন্য ইংল্যান্ড ম্যাচটিতে ফিরতে পারেনি।

অন্যদিকে, অনবদ্য ফুটবল প্রদর্শনী উপহার দিয়ে নায়ক বনে যান রোনালদিনহো। এই জয়ের হাত ধরে ব্রাজিল পরবর্তিতে ফাইনালে জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয়।

  • প্রতিক্রিয়া

ম্যাচের নায়ক রোনালদিনহোর দাবি ছিল, গোল করার উদ্দেশ্যেই ফ্রি-কিক নেন তিনি। ম্যাচ শেষে কিংবা সব সময়ই রোনালদিনহো তেমন দাবিই করেন।

এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি কতবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি তা গুণে শেষ করতে পারবো না। কিন্তু আমার উত্তর একটাই – আমি গোল করার জন্যই শট নিয়েছিলাম। ফ্রি-কিক নেয়ার আগে আমি আর কাফু ওদের গোলরক্ষকের সামনে এগিয়ে আসা নিয়ে কথা বলেছি। এটা ঠিক যে, আমি অতোটা সূক্ষ্মভাবে হিসেব করে শট নি নাই, কিন্তু অবশ্যই আমি গোল করার উদ্দেশ্যেই শট নিয়েছি।’

তবে, ইংল্যান্ডের কিংবদন্ততুল্য গোলরক্ষক ডেভিড সিম্যানের জন্য গোলটা ছিল অপমানজনক। ইংল্যান্ডের কোচ সভেন গোনার এরিকসন বলেন, ‘সিম্যান একটু বেশি হতাশ হয়ে পড়েছিল। আমি ওর সাথে ড্রেসিংরুমে কথা বলেছি, অন্তত চেষ্টা করেছি, কিন্তু মনে হয় না সে কিছু শুনেছে। আমি হোটেলেও তাঁকে বলতে চেয়েছি – তুমি যদি সেই গোলটা মাথা থেকে ঝাড়তে না পারো তাহলে তুমি শেষ হয়ে যাবে, তুমি আমাদের অনেক ম্যাচই জিতিয়েছো।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link