More

Social Media

Light
Dark

বিরাট-বাবর: ব্যাটিং বিপ্লবের তারতম্য

একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকের ক্রিকেট ভক্তদের নি:সন্দেহে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল রিকি পন্টিং বনাম শচীন টেন্ডুলকার দ্বৈরথ। ক্রীড়াক্ষেত্রে যেকোনো প্রতিযোগিতা সবসময়ই অভিভূত করে দর্শকদের আর সেটা যদি হয় এমন দুই কিংবদন্তির মাঝে তবে ভক্তদের অনুভূতি কোন সীমারেখার বাঁধা যায় না। ফুটবলের মেসি-রোনালদো এর লড়াই যেমন মোহিত করে রেখেছে ফুটবল প্রেমীদের তেমন করেই তখন রিকি-শচীন মুগ্ধ করে রেখেছিলেন ক্রিকেটবিশ্বকে।

কিন্তু সময়ের আবর্তনে কিংবদন্তিদ্বয়ের দ্বৈরথের অবসান ঘটেছিল। এরপর সাঙ্গাকারা, দিলশান, কুক এর মত ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটসম্যানরা রান করেছেন ঠিকই তবে ক্রিকেট ভুগেছিলো একটি ব্যক্তি পর্যায়ে লড়াইয়ের অভাবে। মাঝে রিকি পন্টিং আর শচীনের এর উত্তরসূরি স্টিভ স্মিথ এবং বিরাট কোহলি এর মাঝে সৃষ্টি হয়েছিল এমন দ্বৈরথ তবে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের পারফরম্যান্স এর বিচারে স্মিথ ঠিক সুবিধা করতে পারেননি।

ক্রিকেটেপ্রেমীদের আবদার অবশেষে পূরন হয়েছে। পাকিস্তানের লাহোর থেকে উঠে এসেছেন একজন বাবর আজম যিনি জাভেদ মিয়াদাঁদ,সেলিম মালিকদের মতই ব্যাটিংয়ের নান্দনিকতা নিয়ে এসেছেন ক্রিকেট দুনিয়ায়।

ads

২০১৫ সালের মে মাসে অভিষেক; এরপর ধীরে ধীরে নিজেকে তিন ফরম্যাটেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাবর। প্রজন্মের ফেভারিট ফোর-এ নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, এখন ফেভারিট ফাইভ তারা। তবে বাবরের সবচেয়ে বড় অর্জন, তিনি ফিরিয়ে এনেছেন ভক্তদের বহুল কাঙ্খিত এক ক্রিকেটীয়-দ্বৈরথ। যেখানে তার সঙ্গী ভারতের ব্যাটিং অহংকার বিরাট কোহলি।

বিরাট বনাম বাবর – টক অব দ্য ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড এখন নিশ্চয়ই। সাদা পোশাকের টেস্ট কিংবা সাদা বলের ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি; তিন ফরম্যাটেই দলের সবচেয়ে ভরসার ব্যাটসম্যান দুজন। আইসিসির র‍্যাংকিং তালিকায় তিন ফরম্যাটেই দুইজন আছেন উপরের দিকেই। বিরাটের যেমন আছে অ্যাডিলেডের মহাকাব্য, তেমন বাবরের ঝুলিতে সর্বশেষ সংযুক্তি করাচি-গাঁথা।

বিরাটের আন্তজার্তিক অভিষেক ২০০৮ সালে, তার সাত বছর পরে বাবরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পন। তাই শুধু পরিসংখ্যান আর সংখ্যায় দুজনের দ্বৈরথ পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলা যায় না। বিরাট কোহলি এতদিনে যা অর্জন করেছেন সেসব অর্জনের দিকে প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন পাকিস্তানের বর্তমান অধিনায়ক।

বিরাট কোহলি’র টেস্ট রান আট হাজারের বেশি, ওয়ানডেতে রান সংখ্যা বারো হাজার পেরোনো। অন্যদিকে বাবরের টেস্ট রান তিন হাজার এর কম, আর ওয়ানডেতে চার হাজারের কাছাকাছি। অপেক্ষাকৃত নতুন ফরম্যাট টি-টোয়েন্টিতে বিরাট ১৩৭.৬৮ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৩২৯৬ রান অন্যদিকে বাবর করেছেন ২৬২০ রান; স্ট্রাইক রেট ১২৯.১! সংখ্যাগুলো দেখে মনে হতে পারে তুলনাই হয় না দুজনের।

এজন্য আগেই বলে রেখেছিলাম বিরাটের চেয়ে বছর সাতেক পরে আসা বাবর আজমকে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে দেখলে ভুল বোঝা হবে। তবে ব্যাটিং এভারেজ দেখে অন্তত কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন। ওয়ানডেতে বিরাটের এভারেজ ৫৮ এর একটু বেশি আর বাবরের ৫৬.৯৩। টেস্টে বিরাটের এভারেজ ৫০ এক কাছেই আর বাবরের সেটা প্রায় ৪৬। বিশ ওভারের ফরম্যাটে বাবরের এভারেজ যেখানে ৪৫ সেখানে বিরাটের অবশ্য ৫১.৫। সমান না হলেও কাছাকাছি বলাই যায়।

সাদা পোশাকে ঘরের মাঠে বিরাটের ফর্ম ঈর্ষনীয়, ৬১ এভারেজে প্রায় চার হাজার রান। আর অ্যাওয়ে-তে ৪২.৮২ এভারেজে রান করেছেন ৪১৯২। অন্যদিকে বাবর আজম পাকিস্তানের মাঠে টেস্ট খেলেছেন মোটে ছয়টি। ৮৮.৩৩ গড়ে রান করেছেন ৮০০ এর মত। আর বিদেশে প্রায় ৩৮ গড়ে দুই হাজারের কাছাকাছি রান সংগ্রহ করেছেন বাবর আজম।

ওয়ানডে ফরম্যাটে হোম কন্ডিশনে বিরাটের সংগ্রহ ৫৮.৩৭ এভারেজে পাঁচ হাজারে বেশি রান।
অ্যাওয়ে সিরিজে বিরাটের ব্যাটে এসেছে সাত হাজার রান,এভারেজ ৫৭.৮৭। ঘরের মাঠে মাত্র ৬ ম্যাচ খেলা বাবর রান করেছেন ৪২১,গড় ৮৪.২০! দেশের বাইরে তার সংগ্রহ ৫৪.৮৩ গড়ে সাড়ে তিন হাজারের বেশি রান।

দারুণ বোলিং আক্রমণ, চরম প্রতিকূল পরিবেশ,ব্যাটারদের জন্য ফাঁদ পাতা পিচ; এসব কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাই যদি হয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই তবে দুই দেশের দুই মহারথী তাতে পাশ করেছেন লেটার মার্কসহ-ই। রানসংখ্যা পাশে সরিয়ে রাখি; দল যখন চাপের মুখে,প্রতিকূল পরিবেশে তখন এই দুজনের পারফরম্যান্সই বলে দেয় দু’জনের লড়াইয়ের যৌক্তিকতা। ঘরের মাঠের চেনা কিংবা অ্যাওয়ে-তে অচেনা পরিবেশ; কোথাও থামেনি দুজনের ব্যাটের হাসি। শক্তিশালী বোলিং আক্রমণ কিংবা খর্বশক্তির বোলিং আক্রমণ তাদের ব্যাট থেকে ছাড় পায়নি কোন দলই।

অবশ্য গত দুই-আড়াই বছর বিরাটের ব্যাটে রান আছে, তাকে অফ ফর্মের ব্যাটারও বলা যায় না,তবে ঠিক কোহলি-ময় ব্যাটিংটা নেই। শতকের দেখা পাননি প্রায় ৮০০দিন হতে চলছে। তিন ফরম্যাটেই পঞ্চাশের বেশি এভারেজে ব্যাট করা বিরাটের টেস্ট এভারেজ নেমে গিয়েছে পঞ্চাশের নিচে।

শচীনের সেঞ্চুরির সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙা যার জন্য ছিল সময়ের ব্যাপার সেই বিরাট এখন অন্ধকারে হাতড়ে মরেন একটা শতকের জন্য। অন্যদিকে প্রতিদিন নিজেকে যেন আরো উপরে তুলে নিচ্ছেন বাবর। তিনিও অনেকদিন তিন অঙ্কের ম্যাজিকাল ফিগারের দেখা পাননি তবে করাচি-তে অজি বোলারদের বিপক্ষে এক অতি মানবীয় ইনিংস খেলে সেঞ্চুরির খরা কাটিয়েছেন।

বাবর আজম আর বিরাট কোহলি কে যদি সূর্য ধরা হয় তবে বিরাটের সূর্য গত একযুগ ধরে আলো ছড়িয়ে এখন কেমন যেন ম্লান হয়ে উঠেছে। মধ্য আকাশ ছেড়ে যেন পশ্চিম আকাশকে গন্তব্য ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাবর আজম নামক সূর্য পূর্ব দিগন্তে উদিত হয়ে এখন মধ্য আকাশের দিকে আসছে; তেজদীপ্ততার সাথেই নিজের অস্তিত্বের ঘোষনা দিয়ে যাচ্ছে।

বয়ে বেড়াচ্ছে তেজস্বী এক ক্রিকেটীয় অধ্যায়ের সম্ভবনা। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়া শুধুই বাবরের কাজ। বিরাট কোহলি’র এতদিনের অর্জন ছুঁয়ে দেখা সম্ভব নয় সবার জন্য, তবে যে প্রত্যাশা নিয়ে এসেছেন বাবর তার জন্য খুব একটা কঠিন হওয়ারও কথা নয়। তার জন্য বাবরকে বেছে নিতে হবে এক কঠোর সংগ্রামের পথ; যে পথে তাকে হাঁটতে হবে একা। ফিটনেস থেকে পারফরম্যান্স সব হতে হবে নিঁখুত; তবেই তিনি কোহলি’র রাজত্বের সমান কিংবা তারও বেশি কিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন।

একজন নিরপেক্ষ ক্রিকেট ভক্ত হিসেবে দিল্লীর ছেলে বিরাটের এমন রূপ দেখতে চাই না। বাবর আজম যেভাবে নিজেকে তুলে নিচ্ছেন উপর থেকে আরো উপরে তেমন করে বিরাটও উঠুক আরো উপরে। তাদের এমন দ্বৈরথ স্থায়ী হোক আরো কিছুকাল। ক্রিকেটের আকাশে দুজনের সূর্য একই সাথে অবস্থান করে উত্তপ্ত করুক দর্শকদের। বাবর ধরে রাখুক ধারাবাহিকতা আর কোহলি ফিরে আসুক স্বরূপে; অফ ফর্ম নামক ব্যাধিতে ক্লান্ত বিরাট যে চোখের জন্য বড্ড পীড়াদায়ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link