More

Social Media

Light
Dark

নাদিয়া নাদিম: সিনেমা নয়, জীবনের গল্প

জীবন মানেই এক যুদ্ধ। জীবনের প্রতিটা পদেই টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হয়। জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে অনেকেই মাঝ পথে দমে গিয়েছে। অনেকেই লড়াই করে নিজেকে নিয়ে গেছেন সফলতার শীর্ষে। জীবন সংগ্রামে লড়াই করে সফলতার চৌকাঠ পেরিয়ে সাফল্যে আলো খুঁজে পাওয়া এমন একজন হলেন নাদিয়া নাদিম।

হ্যাঁ, ডেনমার্ক নারী ফুটবল দলের বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় নাদিয়ার কথাই বলছি। শুধু ডেনমার্কই নয় বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা নারী ফুটবলারদের একজন এই ড্যানিশ স্ট্রাইকার।

নাদিয়া নাদিমের এই পরিচিতি, খ্যাতি, যশ সব কিছুর পেছনে আছে এক সংগ্রামের গল্প। একটা সময় বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জীবনের স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়া নাদিম এখন বিশ্ব তারকা। মৃত্যুভয় আর করুন আর্তনাদের সেই অন্ধকারছন্ন অতীতকে দূরে সরিয়ে জীবনে নতুন আশার আলো জ্বালানো নাদিমের উঠে আসার গল্পটা জানা যাক।

ads

সাল ২০০০। তালেবানরা তখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশের উচ্চপদস্থ অনেকের সাথেই মিটিং করছিলেন। অনেককেই মেরে ফেলারও খবর আসে। একদিন সেনাবাহিনীর জেনারেল রাবানি নাদিমকে এক মিটিংয়ে ডাকে তালেবানরা।

রাবানি সেদিন মিটিংয়ে গেলেও আর ফিরে আসেননি! এর এক মাস পর জানা যায় তেলাবানদের হাতে নিহত হয়েছেন তিনি। রাবানি নাদিমই ছিলেন নাদিয়া নাদিমের বাবা। বাবার নৃশংস মৃত্যুর সময় নাদিয়ার বয়স ছিলো মাত্র ১২!

১৯৮৮ সালের ২রা জানুয়ারি আফগানিস্তানের হেরাতে জন্মগ্রহণ করেন নাদিয়া নাদিম। পাঁচ বোন আর বাবা-মা’কে নিয়ে তাদের সাত জনের সংসার। বাবা জেনারেল হওয়ায় বাড়ি, গাড়ি, অর্থসম্পদের অভাব ছিলো না তাঁদের। তবে নাদিয়ার বাবা মৃত্যুতে মা হামিদা নাদিম মেয়েদের জীবন নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন।

তিনি জানতেন যেকোনো সময় পুরো পরিবারকেই তারা মেরে ফেলতে পারে। তাই স্বামীর রেখে যাওয়া সব সম্পত্তি বিক্রি করে রাতের আঁধারে পাঁচ মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট এক ঠেলাগাড়িতে করে রওনা হন হামিদা। বর্ডার পার হয়ে পৌঁছে যান পাকিস্তানে। দুই মাস থাকেন করাচিতে।

জীবন বাঁচাতে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে এক স্মাগলারকে টাকা দিয়ে ইতালি যাওয়ার ব্যবস্থা করিয়ে নেন। অবশ্য এরপর কয়েকদিনের মাঝেই ইতালি পৌঁছেও যান নাদিয়ার পরিবার। ইতালি যাওয়ার পর বেশ কয়েকদিন একটি ট্রাকের মধ্যে কাঁটান তারা।

তাদের ধারণা ছিলো এই ট্রাক ইংল্যান্ড যাবে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল লন্ডন পৌঁছানো। ইংল্যান্ডে নাদিয়ার পরিবারের কিছু পরিচিত লোক থাকতো, মূলত সেখানেই যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন হামিদা। কিন্তু পারেননি! বেশ কয়েকদিন বাসে ভ্রমণের পর যখন গিয়ে পৌঁছুলেন। দেখলেন লন্ডন নয় ডেনমার্কের এক শরনার্থী শিবিরে এসে পৌঁছেছেন তারা। সেখান থেকেই নতুন শুরু নাদিয়ার পরিবারের।

নাদিয়া সবসময়ই ভাবতেন তাঁর বাবা একদিন ফিরে আসবেন। ডেনমার্কে গিয়েও ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত নাদিয়া স্বপ্ন দেখতেন একদিন তাঁর বাবা ফিরে এসেছে। সেই শরনার্থী শিবিরে নাদিয়ার পরিবার ছিলো প্রায় ৯ মাসের মতো।

শরনার্থী শিবিরে থেকে বাইরের আলো-বাতাস সবকিছুই নাদিয়াকে এক ভিন্ন রকম প্রশান্তি দিচ্ছিলো। নিজ মাতৃভূমির চেয়েও নিরাপদ জায়গা আছে সেটি বোধহয় প্রথমবার অনুভব করছিলেন তিনি।

সেখানে খুব কাছেই একদিন নাদিয়া মেয়েদের একটি গ্রুপকে ফুটবল খেলতে দেখলেন। বাঁশের বেড়ার পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে ফুটবল খেলা দেখতো সে। এভাবেই নাদিয়ের মনেও ইচ্ছা জাগলো ফুটবল খেলার। তবে মনে সাহস জোগাতে পারছিলোনা মাঠে যাওয়ার।

শরনার্থী ক্যাম্পে থাকায় সীমারেখার বাইরে যাওয়া ছিলো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নাদিয়া মনে মনে নিজেকে কল্পনা করতো মাঠে খেলা সেই মেয়েদের মাঝে।

একদিন সব ভয় পাশ কাটিয়ে সে পৌঁছে গেলো মাঠে! ইংরেজী না জানলেও দলের কোচকে বোঝাতে সক্ষম হলো সে খেলতে চায়। নাদিয়ার স্পৃহা দেখে কোচ তাঁকে অনুশীলনের সুযোগ দিলেন। দুই মাস অনুশীলনের পর নাদিয়া প্রথমবার ডাক পেলেন প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে।

শরনার্থী ক্যাম্পে থেকেই নাদিয়া নিজের স্কিলে আরো উন্নতি করতে থাকলো। সেখান থেকে অন্য এক জায়গায় আশ্রয় পায় নাদিয়ার পরিবার। শরনার্থী শিবির ছেড়ে সেখানকার মানুষের সাথে বসবাস শুরু করে নাদিয়ার পরিবার।

নাদিয়ার ফুটবল স্কিল দেখে বি৫২ অলবর্গ ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দেন তাঁর কোচ। সেখান থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি নাদিয়াকে। পরবর্তীতে ভিবোর্গ, আইকে স্কোভবাকেন এবং ফরচুনার হয়ে খেলেন তিনি। এছাড়া স্কাই ব্লু এফসি’র হয়ে আমেরিকায় ন্যাশনাল উইমেন্স ফুটবলও খেলেন নাদিয়া। আমেরিকায় পোর্টল্যান্ড থ্রোনসের হয়ে ৩৭ ম্যাচে ১৯ গোল করার পরই চোখে পড়ে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির।

নাদিয়ার স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিতেই ছুঁটছিলো অদম্য গতিতে।

খেলা ছাড়া নাদিয়া চাইলো ভিন্ন প্রোফেশনে যোগ দিতে। তাই ডাক্তারি পড়া শুরু করেন তিনি। কারণ খেলাকে নিজের প্যাশন হিসেবেই ভেবেছেন সবসময়। ৫ বছর পড়ার পর তিনি ডাক্তারি সার্টিফিকেট পান। নাদিয়ার ডাক্তারি পড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো অসহায় মানুষের সহযোগিতা করা। মানুষের পাশে থাকার ইচ্ছে থেকেই নাদিমের এই প্রোফেশনে আসা।

নাদিয়া এখন মোট সাতটি ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারে। খেলার ও ডাক্তারির পাশাপাশি প্রায়ই নাদিয়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শরনার্থী ক্যাম্পে ঘুরতে যান। সেখানে নিজের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসার গল্প শোনান। প্রত্যেক নারী আর মেয়েদের সাহস যোগান যাতে করে তারাও এভাবে ভয় না পেয়ে উঠে আসতে পারে নতুন উদ্যমে।

২০০৫ থেকে ০৬ পর্যন্ত নাদিম ভিবোর্গের হয়ে খেলেন। এরপর ২০১২ পর্যন্ত আইকে স্কোভবাকেনের হয়ে খেলেন তিনি। ২০১২ সালে যোগ দেন ফরচুনাতে। সেখান থেকেই চুক্তিবদ্ধ হন ম্যানচেস্টার সিটির সাথে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইনে যোগ দেন এই ফুটবলার।

জীবন যুদ্ধে হার না মেনে সংগ্রাম করেই নাদিয়া নিজেকে নিয়ে গেছেন সাফল্যের চূড়ায়। একসময় জীবন বাঁচাতে অবিরত অজানা গন্তব্যে ছুঁটতে থাকা নাদিয়া এখন নারী ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link