More

Social Media

Light
Dark

মধ্য দুপুরের মায়াবী বিভ্রম

তার ড্রাইভ নিয়ে নতুন করে বলার আছে সামান্যই। আজকে মুগ্ধতায় ভেসে গেলাম তার পুল শটে। তাঁর শিল্পী সত্তা তো জানা আছেই। আজকে মন ভরে গেল তার অথোরিটি দেখে। কর্তৃত্ব আর দাপট।

লেগ সাইডে পাঁচ জন ফিল্ডার নিয়ে বল করছিলেন কাইল জেমিসন। রাউন্ড দা উইকেটে শরীর তাক করে। তিনি পুল করলেন, গুলির বেগে। ৫ প্রহরীকে অসহায় বানিয়ে বল বাউন্ডারিতে। নিখুঁত হাতে কাজ করা কোনো সার্জন যেন। এক ওভারে দুবার। দ্বিতীয়টি আরও দুর্দান্ত।

এই দুই পুল শটের মাঝে জেমিসনের একটা বল অ্যাঙ্গেলে বেরিয়ে যাচ্ছিল মাথার ওপর দিয়ে। তিনি আপার কাট করে বল ফেললেন গ্যালারিতে। এর আগে নিল ওয়াগনারকে টানা দুই বলে দুটি পুল করেছেন। একটি বাহাইন্ড দা স্কয়ার, একটি ইনফ্রন্ট অব স্কয়ার। ফিল্ডাররা স্রেফ তাকিয়ে দেখেছেন।

ads

ওয়াগনারকে ইনফ্রন্ট অব স্কয়ার বাউন্ডারি আরও মেরেছেন। পুল করে ওয়াইড মিড অন দিয়ে চার মেরেছেন। কিছু পুল খেলেছেন, যেগুলো বাউন্ডারি হয়নি বলে হয়তো আলাদা করে নজর কাড়েনি অনেকের। কিন্তু সেগুলোও ছিল দারুণ। বলের ওপর চড়ে, পুরোপুরি কন্ট্রোলে থেকে, রিস্ট দারুণভাবে রোল করে।

এমন নয় যে পুল থেকে আজকে হুট করে ভালো খেলে ফেলেছেন। আগেও খেলেছেন যথেষ্ট। আজকে তবু মনে হচ্ছিল, এই শট যেন তার নামে নিবন্ধন করা। জেমিসন-ওয়াগনাররা একটা পরিকল্পনা করে বল করছেন, বাংলাদেশের একজন ব্যাটসম্যান জবাব দিচ্ছেন বুক চিতিয়ে ও মাথা খাটিয়ে, কী দারুণ!

জবাবটা নাজমুল হাসেন শান্তও দিচ্ছিলেন। সকালের সেশনের রোমাঞ্চকর অধ্যায় ছিল ওয়াগনারের সঙ্গে শান্তর দ্বৈরথ। কিন্তু শান্ত সাহস থেকে চড়ে যান দু:সাহসে। তাই ফাঁদে পড়ে যান। কিন্তু এই তিনি, সেখানেই দারুণ সফল। ডানা যেমন মেলেছেন, প্রয়োজন বুঝে নিজের লাগামও টেনেছেন।

ট্রেন্ট বোল্টের ওই ওভারটির কথা তো বলতেই হয়। ফিফটি ছোঁয়ার বাউন্ডারিতে ভাগ্যের ছোঁয়া ছিল। শরীর থেকে দূরে খেলেছিলেন, একটু এদিক-সেদিক হলেই ক্যাচ হতে পারতেন। এরপর যে তিনটি ড্রাইভ তিনি খেললেন, অফ ড্রাইভ, কাভার ড্রাইভ, অন ড্রাইভ। আহ, চোখে মায়াঞ্জন বুলিয়ে দিল যেন।

পুরনো সেই উপমা আবার মনে পড়ে গেল। সেই যে, রঞ্জিতসিনজির ব্যাটিং দেখে নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন, ‘এটা কি সত্যি, নাকি মধ্য দুপুরের মায়াবী বিভ্রম!’ সেরকমই যেন ঘোর লাগা মুহূর্ত এল আবার।

তাঁর ব্যাটিংয়ের সৌন্দর্য নিয়ে নানা কথা হয় নিত্য। ২০১৫ সালের নিজের একটা লেখা বের করলাম আজকে। সেখানে লিখেছিলাম, ‘মার্শাল আইয়ুবের ব্যাটিংয়ে অলস সৌন্দর্য, লিটনের ব্যাটিংয়ে ব্যস্ত সৌন্দর্য।’ নান্দনিকতার দিক থেকে অলক কাপালিও বাংলাদেশের ক্রিকেটে ওপরের দিকে। তবে লিটন আসলে অন্য লেভেলে এখানে।

তবে শুরুতে যেটা লিখেছি, সৌন্দর্যই শেষ নয়। আজকে তার ব্যাটিংয়ে ছিল নান্দনিকতা ও নিয়ন্ত্রণের অদ্ভূত সংযোগ। ছিল কর্তৃত্ব আর কাব্যিক রূপের মিশেল। কখনও তিনি শিল্পী, হ্যাগলি ওভালের সবুজ ক্যানভাসে তুলির মোহনীয় আঁচড় দিয়েছেন। কখনও তিনি দাপুুটে রাজা, সব বাধা সপাটে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন।

ম্যাচের পরিস্থিতি, দলের বাস্তবতা, প্রতিপক্ষের পেস আক্রমণ, সবকিছু একদিকে, আর তিনি যেন ভিন্ন এক ভুবনে। তার ব্যাটিংয়ের সৌন্দর্য নিয়ে এত আলোচনা নয়, অনেক সময় স্কিল আড়ালে পড়ে যায়। কিন্তু টেস্ট স্কিল ও মানসিকতায় এখন তিনি দারুণ সমৃদ্ধ।

সব ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারের একটা পর্যায় আসে, যখন নিজের খেলাটা বুঝতে শেখে। ২২ গজে নিজেকে প্রকাশ করাটা তখন সহজ হয়ে ওঠে। তিনি সেই পর্যায়ে পা রেখেছেন। সেটি বোঝা যায় যতটা না শট খেলা থেকে, তার চেয়ে বেশি ডিফেন্স থেকে। ডিফেন্সে তিনি এখন খুব ডিসাইসিভ। সেই আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি তার সামগ্রিক ব্যাটিংয়ে পড়ে।

উইকেটের অবস্থা যা-ই থাকুক, প্রতিপক্ষের আক্রমণ যেমনই হোক, তিনি মাঠে নামলেই যে ব্যাটিং করা খুব সহজ মনে হয়, এটা শুধু নান্দনিকতার ব্যাপার নয়, আরও বেশি বরং স্কিল, মানসিকতা ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপার। ক্যারিয়ারের প্রথম ১৯ টেস্টে তার রান ছিল স্রেফ ৮০৬। গড় ২৫.১৮, ফিফটি মোটে ৪টি। সবশেষ ১০ টেস্টে তার রান ৮৪৩। গড় ৫২.৬৮। সেঞ্চুরি ২টি, ফিফটি ৭টি।

এই সময়টায় টেস্টে তার চেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় বিশ্ব ক্রিকেটের আর কোনো কিপার-ব্যাটসম্যানের নেই। প্রথম ২৫ টেস্টে কোনো সেঞ্চুরি ছিল না। চার টেস্টের মধ্যে দুটি হয়ে গেল। আশা করি, এটা অভ্যাসে পরিণত হবে এবং কনভার্শন রেট আরও ভালো হবে।

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের কল্যাণে বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ এখন নিয়মিতই থাকবে। অন্তত ২০টি টেস্ট সেঞ্চুরি করতে না পারলে, তিনি প্রতিভার প্রতি অবিচারই করবেন। সীমিত ওভারেও তাকে মিডল অর্ডারে নামালে এমন ফর্ম দেখা যাবে কিনা, জানি না। যেহেতু স্ট্রাইক রোটেট করতে পারেন, ভালো বলে বাউন্ডারি বের করতে পারেন, তাই হতে পারে, মাঝের ওভারগুলো তিনি ভালো কাজে লাগাতে পারবেন। আবার নাও হতে পারে।

লাল আর সাদা বলের ক্রিকেট এক নয়। শুধুু জানি, লাল বলের মতো সাদা বলেও তার পথ খুঁজে পাওয়া জরুরি। তার নিজের জন্য যতটা, আরও বেশি দেশের ক্রিকেটের জন্য। বাংলাদেশের প্রথম সত্যিকার অর্থে ওয়ার্ল্ড বিটার ব্যাটসম্যান তিনি হতে পারেন। এবার যখন তাঁর সেঞ্চুরি হলো, মাঠে দর্শকদের উদ্দেশে কিংবা সতীর্থদের দিকে, তিনি স্যালুট দিলেন। আসলে, স্যালুট তো প্রাপ্য তাঁরই।

লিটন কুমার দাস, আপনাকে কুর্নিশ। বেলা বেশ বয়ে গেছে, এখন কেবলই আলো ছড়ানোর পালা।

– ফেসবুক থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link