More

Social Media

Light
Dark

ভুল শট, দীর্ঘ অনুশোচনা

বছরখানে আগে আগে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত হওয়া ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্টে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে চূড়ান্ত অবিবেচকের মতো শট খেলতে গিয়ে আউট হন ঋষাভ পান্ত, এবং ভারত একটা বড়ো লিড নেওয়া থেকে বঞ্চিত হয়, এবং শেষপর্যন্ত একটা ৫০-৫০ পরিস্থিতি থেকে টেস্ট ম্যাচটি হেরে বসে।

যথারীতি, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এই শটের যথেষ্ট সমালোচনা হয়েছে, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ থেকে নিয়ে সাংবাদিক সকলেই পান্তের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কড়া নিন্দা করেছেন। আজকে আলোচনা করা যাক টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে খারাপ শট খেলে দলকে বিপদে ফেলার কয়েকটি উদাহরণ নিয়ে, এবং সেই শটের প্রভাব সংশ্লিষ্ট ক্রিকেটারের জীবনে কি হয়েছিল তাই নিয়ে।

  • মার্ক রামপ্রকাশ: অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ট্রেন্টব্রিজ টেস্ট, ২০০১

এটি এমন একটি শট যা নিয়ে তাকে বছরের পর বছর ধরে দোষারোপ করা হবে। ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে পাঁচ রানের লিড পাওয়া ইংল্যান্ড, মাইক আথারটন এবং অ্যালেক স্টুয়ার্টের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট হারিয়ে ৪ উইকেটে ১২৬ রানে তখন নড়বড়ে অবস্থায় ছিল।

ads

রামপ্রকাশ প্রায় দেড়ঘন্টা ধরে সতর্ক ব্যাটিং করে মাত্র ২৬ রান করে অপরাজিত ছিলেন। সেই পর্বের শেষের দিকে, ওয়ার্ন তাকে স্লেজিং করতে শুরু করেন, তাকে এগিয়ে এসে তুলে মারার আহবান জানান। দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হতে থাকে এবং দিন শেষের মাত্র নয় ওভার বাকি থাকতে রামপ্রকাশ হঠাৎ স্টেপ আউট করেন এবং ওয়ার্নের ক্লাসিক লেগ ব্রেকে বিট হন।

অ্যাডাম গিলক্রিস্টের জন্য বাকিটা ছিল ছেলেখেলা। রামপ্রকাশ পরে বলেন, ‘আমার পুরো টেস্ট ক্যারিয়ার জুড়েই আমাকে শট না খেলার জন্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে, এবং আমি মনে করি ডিফেন্স করতে গিয়ে ফরওয়ার্ড শর্ট লেগের হাতে ধরা পড়ার থেকে আক্রমণ করতে গিয়ে আউট হওয়া অনেক ভালো – এমনকি যদি তার মানে শেন ওয়ার্নের বিরুদ্ধে স্টেপ আউট করা হয়, তো তাই সই।’

  • কপিল দেব: ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দিল্লী টেস্ট, ১৯৮৪

এই ঘটনা বহুল চর্চিত এবং সকলেই প্রায় জানেন। এই ঘটনা দেশের ক্রিকেট ফ্যানদের দুটি শিবিরে বিভক্ত করে দিয়েছিলো। গাভাস্কার এবং কপিল দেব; পরের টেস্টে কপিলকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যা গাভাস্কার প্রভাবিত করেছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন।

যদিও কয়েক বছর আগে, গাভাস্কার একটি পুরানো সংবাদপত্রের ক্লিপিং দেখিয়ে প্রমাণ করছিলেন যে এটি তার সিদ্ধান্ত নয়। দিল্লির সেই টেস্টে ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে টার্গেট সেট করতে নেমে ৫ উইকেটে ২১৪ রানে পৌঁছেছিল। তখন কপিল প্যাট পোককে ছক্কা মেরেই পরের বলে আরেকটি ছয় হাঁকানোর চেষ্টা করেন, যা অ্যালান ল্যাম্বের হাতে লং অফে ক্যাচ হয়।

পরবর্তীকালে কপিল বলেছেন – ‘আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমাকে বাদ দেওয়া নির্বাচকদের বোকামি ছিল। আমাকে এমন একজন খেলোয়াড়ের নাম বলুন যিনি খারাপ শট খেলার জন্য বাদ পড়েছিলেন? যেহেতু আমরা টেস্ট ম্যাচটা হেরে গেছিলাম তাই কাউকে একটা বলির পাঁঠা করতে হতো।’

ফিরে এসে কপিল পরের টেস্টেই দু ইনিংসে স্বভাবসিদ্ধ হাফ সেঞ্চুরি করেন, আক্রমণাত্মক ভাবে এবং বার্তা দেন, যে আমি এভাবেই খেলি, এভাবেই খেলবো।

  • কেভিন পিটারসেন বনাম অস্ট্রেলিয়া, ২০০৯

এই শটটি ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক টনি গ্রেগকে এতটাই ক্ষুব্ধ করেছিল যে তিনি অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রসকে পিটারসেনকে বলতে অনুরোধ করেছিলেন যে তিনি এই ধরনের শট খেললে তাকে বাদ দেওয়া হবে। পিটারসেন দুরন্ত ছন্দে ছিলেন এবং ৬৯ রানের মাথায় তিনি নাথান হারিৎজের অফ স্টাম্পের বাইরের একটি নিরীহ ডেলিভারি প্যাডেল সুইপ করার সিদ্ধান্ত নেন। বলটি ব্যাটের ইনসাইড এজে লেগে তার নিজের হেলমেট থেকে ডিফ্লেক্ট করে শর্ট-লেগে ক্যাটিচ এর তালুবন্দি হয়।

গ্রেগ বলেছিলেন – ‘কখনও কখনও আপনাকে কিছু ক্ষেত্রে কড়া সিদ্ধান্ত নিতেই হবে এবং আমি মনে করি পিটারসেন এর এই শট সেই পর্যায়ে পড়ে। পিটারসেন যদি এরকম বোকার মতো শট খেলেন তাহলে তাকে সতর্ক করা স্ট্রসের কাজ।’

এর এক বছর আগে, পিটারসেন ছয় মেরে সেঞ্চুরি করতে গিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে লং-অনে ক্যাচ আউট হন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করে ফেলে সফলভাবে।

  • নয়ন মোঙ্গিয়া, পাকিস্তানের বিপক্ষে চেন্নাই টেস্ট, ১৯৯৯

সেই ম্যাচে খাদের কিনারা থেকে ভারত ম্যাচে ফিরে এসেছিলো শচীন টেন্ডুলকার আর মোঙ্গিয়ার মরিয়া লড়াইয়ে, একদিকে সচিন পিঠের খিঁচুনি সহ্য করে স্বপ্নের ইনিংস খেলছিলেন। ধীরে ধীরে আবার এক অবিশ্বাস্য জয়ের আশা জাগছিল; এমন সময়েই ৫২ রানের মাথায় মোঙ্গিয়া ওয়াসিম আকরামের লেভেলের একজন বোলারের বিরুদ্ধে ক্রস ব্যাট স্লগের আটটেম্প্ট নেন, এবং মিড-অফের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন।

অন ​​এয়ার মাইকেল হোল্ডিং বলেছিলেন – ‘এই শট খেলার কোনো দরকার ছিল না!’ কোচ আংশুমান গায়কোয়ার মোঙ্গিয়ার এই আউটটিকেই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে উল্লেখ করেছেন কারণ ভারত মাত্র ১২ রানে ম্যাচটি হরে। মোঙ্গিয়া পরে নিজের আউট সম্পর্কে বলেন – ‘খুব কষ্ট পেয়েছি, কারণ আমরা পুরো হারের সামনে থেকে জয়ের এত কাছাকাছি এসে গিয়েছিলাম।’

  • ড্যামিয়েন মার্টিন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিডনি টেস্ট, ১৯৯৪

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ছ-ছটি বছর মূল্য দিতে হয়েছিল ড্যামিয়েন মার্টিনকে তাঁর এই শটের জন্যে। সিডনিতে নতুন বছরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল মাত্র ১১৭ রান এবং ১ উইকেটে ৫১ রানে খুবই সহজ জয়ের দিকে এগোচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া।

এরপর ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্স এবং অ্যালান ডোনাল্ড তাদের ৮ উইকেটে ১১০ রানে নামিয়ে আনেন। তরুণ মার্টিন ৫৯ বলে মাত্র ৬ রান করেছিলেন কিন্তু কঠিন লড়াই করছিলেন ১০৬ মিনিট ধরে। ক্রেগ ম্যাকডারমটের সাথে পার্টনারশীপ করে মনে হচ্ছিল তিনি অস্ট্রেলিয়াকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেন কিন্তু হঠাৎ তিনি অ্যালান ডোনাল্ডকে তুলে মারতে যান কভারের উপর দিয়ে।

কিন্তু, মিসটাইম হয়ে যায় শট এবং তিনি হাডসনের হাতে ধরা পড়েন। গ্লেন ম্যাকগ্রা বেশিক্ষন টেকেন নি, ৭ বল খেলে মাত্র ১ রান করে আউট হন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা পাঁচ রানে জিতে যায়। অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া মার্টিনকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল এবং মার্টিন সেই যে বাদ পড়েন, টেস্ট ক্রিকেটে ফিরে আসতে তাঁর আরও ছয় বছর লেগেছিল।

মার্টিন পরে বলেছিলেন, ‘সেই সময়ে আমি ভেবেছিলাম আমার সাথে চরম অন্যায় হলো, কিন্তু এখন ভাবলে মনে হয় যে আমি খেলার যোগ্য ছিলাম না, যদিও এই হতাশা কাটিয়ে উঠতে আমার দুই বছর লেগেছিল – যা একটু বেশিই সময়।’

  • ডন ব্রাডম্যান, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মেলবোর্ন টেস্ট, ১৯৩২-৩৩

আঁতকে ওঠার মতোই ব্যাপার! স্যার ডন নাকি টেস্ট ম্যাচের অনুপযোগী শট খেলেছিলেন!

হ্যাঁ, এটি ছিল কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজের ঘটনা। প্রথম টেস্টে ব্র্যাডম্যান খেলেন নি, যেটি ডগলাস জার্ডিনের দলবল অস্ট্রেলিয়া কে লেগসাইডে এ অধিকাংশ ফিল্ডার রেখে বডিলাইনে বাউন্সার দিয়ে গুটিয়ে দিয়েছিলো। ডন মানসিকভাবে প্রস্তুত নন বলে জল্পনা শুরু হয়েছিল। তবে অস্ট্রেলিয়ান ভক্তদের জন্যে সুখবর আসে যখন তিনি মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামেন।

তিনি যখন ক্রিজে আসেন, দলের রান ২ উইকেটে ৬৭। দর্শকদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা ও করতালির জন্যে পরের বলটি হতে মিনিট দুয়েক দেরি হয়। কিন্তু এক নিমেষের মধ্যেই সব শেষ। স্যার ডন একটি বাউন্সার এক্সপেক্ট করছিলেন, প্রথম বলেই তিনি অফের দিকে সরে এসে হুক মারার জন্যে ব্যাট চালান। কিন্তু বলটি যতটা উঠবে ভেবেছিলেন ততটা ওঠেনি এবং তাঁর ব্যাটের তলার দিকের কানায় লেগে বল সোজা স্টাম্পে আছড়ে পড়ে। শর্ট পিচ বোলিং তাঁর মাথায় ঘুরছিলো ও তিনি এই কারণেই প্রি ডিটারমাইন্ড হয়ে শট টি খেলেন।

এটি ছিল স্যার ডনের প্রথম গোল্ডেন ডাক। তিনি ড্রেসিং রুমে ফিরে যাওয়ার সময় হতবাক এমসিসি ক্রউড নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে সেই টেস্ট জিততে সাহায্য করেন তিনি। সেই গোটা সিরিজ জুড়ে, তিনি প্রায়শই পূর্বনির্ধারিত ভাবে শট খেলেছিলেন, অধিকাংশই অফ সাইডে সরে গিয়ে। সেই সময়ে এটি একটি দারুন সমালোচনার জন্ম দেয়, তবে সে গল্প এই লেখার বিষয় নয়।

  • সুনীল গাভাস্কার, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কলকাতা টেস্ট, ১৯৮৩

সম্প্রতি ঋষভ পান্থ এর জোহানেসবার্গ টেস্টে অবিবেচকের মতো শট খেলার সমালোচনা করেছেন সুনীল গাভাস্কার। কিন্তু ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের প্রতিমূর্তি সুনীলও খেলেছিলেন এমনই একটি খারাপ শট, যা অন্তত কলকাতাবাসীরা এখনও মনে রেখেছেন।

এটি ১৯৮৩ সালের ঘটনা। ০-২ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ভারত ছয় টেস্টের সিরিজে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছিল শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে এবং পঞ্চম টেস্ট সেবার কলকাতায় ইডেন গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয়। গাভাস্কার প্রথম ইনিংসে ম্যালকম মার্শালের কাছে ইনিংসের প্রথম বলেই শূন্য রানে আউট হয়ে গেলে ভারত ২৪১ রানে অলআউট হয়ে যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এক সময়ে ৫ উইকেটে ৮৮ অবস্থা থেকে ক্লাইভ লয়েডের অতুলনীয় ১৬৯ রানের ইনিংসে ভর করে (মার্শাল আর রবার্টস ও যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন, দুজনেই হাফ সেঞ্চুরি করেন) ৩৭৭ রানে পৌঁছে যায়।

দ্বিতীয় ইনিংসে গাভাস্কার নেমেই স্বভাববিরুদ্ধভাবে চালিয়ে খেলতে থাকেন। এতটাই দৃষ্টিকটু ছিল ১৩৬ রানে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় তাঁর খেলার ভঙ্গি যে উইজডেন পরে এই ইনিংস নিয়ে লেখে যে – ‘ম্যাচে ভারতের চরম খারাপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও, গাভাস্কার চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ব্যাটিং করছিলেন।’

গোটা চারেক বাউন্ডারি মেরে ২০ রান করে মাইকেল হোল্ডিংয়ের বলে অফ স্টাম্পের বাইরে আরেকটি বড় স্ল্যাশ করার চেষ্টা করে তিনি খোঁচা দিয়ে উইকেটকিপার দুজোর হাতে ধরা পড়েন। ভারত মাত্র ৯০ রানে গুটিয়ে যায় এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসে জিতে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নেয়।

বিক্ষুব্ধ কলকাতার জনতা গাভাস্কারের প্রতি চরম বিক্ষোভ দেখায়, জলের বোতল ছোঁড়া হয়, টিম বাসে পাথর ছোঁড়া হয় এমনকি তার স্ত্রী, যার ক্লাইভ লয়েডের স্ত্রীর সাথে একত্রে সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছিলো, তিনিও রেহাই পাননি, তাঁকে লক্ষ্য করে উত্তেজিত জনতা ফল ছুঁড়ে মেরেছিলো। পরবর্তীকালে গাভাস্কারের ইডেন বিদ্বেষের সূচনাও এখন থেকেই হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link