More

Social Media

Light
Dark

অজি সভ্যতার গিলি-হেইডেন

সৌরভ গাঙ্গুলি যখন ভারত অধিনায়ক, কিংবা পরবর্তী সময়ে যখন রাহুল বা প্রথমদিকের ধোনির হাতেও ক্যাপ্টেনসি ছিল, অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের ওয়ানডে থাকলে প্রথম দশ ওভার জহির খান, আশিষ নেহরা, ইরফান পাঠান, অজিত আগারকারদের থেকে শুধু চাতক পাখির মতো আশা করে থাকতেন গোটা দুয়েক ম্যাজিক ডেলিভারির। কেন? না, বাইশ গজে তখন যে ধ্বংসলীলায় মেতেছেন দুই অজি ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আর ম্যাথু হেইডেন।

ভারতীয় পেসারদের হাত থেকে বেরোনো বল গুলোকে একদম আপাত নিরীহ বানিয়ে তাকে বাউন্ডারিতে আছড়ে ফেলার চেষ্টায় ততোক্ষণে মত্ত অ্যাডাম গিলক্রিস্ট  ও ম্যাথু হেইডেন জুটি। শুধু কী ভারতীয় পেসারদের ওপরেই তাণ্ডব চলতো?

মোটেই নয়, বিপক্ষের বোলারকূলে যদি পোলক, এনটিনি, আক্রম, শোয়েব, ভাস, গফ, ডিলন, স্ট্রিকরাও থাকতেন, তাঁদের পরিণতি ও জাহিরদের মতোই হতো, আর কপালে ভাঁজ পড়তো গ্রেম স্মিথ, জয়াসুরিয়া, নাসের, ভন, হুপার, ইনজামাম বা লারাদের। একমাত্র কিউই স্পিডষ্টার শেন বন্ডকেই একটু সমঝে চলতেন এই জুটি। গিলি – হেডেনের ব্যাটিং এ বেদম প্রহারের পরে বল হাতে নেহরা বা আগারকারের অধিনায়ক সৌরভের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকার ছবিগুলো যেন সব দলের বোলারদের কাছেই প্রতীকী ছিল।

ads

ওয়ান ডেতে বিশ্ব ক্রিকেটে বহু দারুণ ওপেনিং কম্বিনেশন এসেছে ; শচীন – সৌরভ, গ্রিনিজ – হেইন্স, আনোয়ার – আমির সোহেল, ট্রেসকোথিক – নাইট, শেবাগ – শচীন, গাপটিল – ম্যাককালাম, ধাওয়ান – রোহিত এরকম অসংখ্য জুটিই কিন্তু যথেষ্ট ধারাবাহিক ছিলেন, কিংবা আজকের দিনের দুই অজি ওপেনার ফিঞ্চ – ওয়ার্নার জুটিও যথেষ্ট মারাত্মক, কিন্তু গিলি – হেইডেনের মত এমন ধ্বংসাত্মক ওপেনিং জুটি আর নিয়মিত বোলারদের ওপর তাণ্ডব চালানোর প্রক্রিয়া বিশ্বক্রিকেটে মনে হয়না খুব বেশি এসেছে।

প্রথম ১৫ ওভারের ফিল্ডিং বাধানিষেধটা চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়ে প্রথম বল থেকেই বিপক্ষকে একদম গুঁড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে যেভাবে নামতেন দুই বাঁহাতি, ইনিংস গড়াতে থাকলে তার ফায়দা তুলতেন পন্টিং, মার্টিন, সাইমন্ডস, ক্লার্করা আর কাজ শেষ করে আসতেন বেভানের মত কেউ কেউ। যে ভঙ্গিতে প্রথম বল থেকেই দু’জন উঠে পড়ে লাগতেন সাদা বলটাকে বাউন্ডারির বাইরে পাঠানোর চেষ্টায়, বোলাররা মানসিক ভাবে ওখানেই পিছিয়ে পড়তেন, আর ড্যাঙ ড্যাঙ করে ওখানেই যেন একের পর এক ম্যাচ অর্ধেক জিতে নিতো অস্ট্রেলিয়া।

কয়েকটা তথ্য দেখলেই ব্যাপারটা পরিস্কার হবে, দুই মহারথী ১১৪ ম্যাচে একসাথে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ওপেন করতে নেমেছেন, করেছেন ৫৩৭২ রান, প্রায় ৪৯ গড়ে এবং ৯০ স্ট্রাইক রেটে। ২৯ বার ৫০ এর বেশি রান তুলেছেন ওপেনিং জুটিতে, ১৬ বার ১০০’র বেশি! ওপেনিং এ মোট রানের বিচারে তাঁদের স্থান ঠিক শচীন – সৌরভ জুটির পরেই একদম দ্বিতীয় স্থানে। বিশ্বকাপের মত কোনো টুর্নামেন্টে তাঁদের ওপেনিং জুটির গড় যেন আরো বেড়ে যেতো, অর্থাৎ বড় মঞ্চে নিশ্চিতভাবেই জ্বলে উঠতো তাঁদের উইলো।

বিশ্বকাপে গিলি – হেইডেন একসাথে মাত্র ২০টা ইনিংসেই করেছেন ১২২০ রান, এই ২০ ইনিংসের মধ্যেই ১২ ইনিংসেই ৫০ এর বেশি রান তুলেছেন বোলারকূলকে পিটিয়ে ছাতু করে। বিশ্বকাপ ফাইনালে দু’বার একসাথে নেমেছেন তাঁরা, প্রথমবার ২০০৩ সালে জহির, শ্রীনাথদের বিরুদ্ধে জোহানেসবার্গে এসেছিলো ১০৫ আর দ্বিতীয়বার ২০০৭ এর বার্বাডোজের ফাইনালে যেন শেষ বিশ্বকাপ ফাইনাল বলে আরো মারাত্মক হয়ে উঠেছিলেন; ভাস, মালিঙ্গা, মুরালিদের বিষাক্ত বোলিং এর দাঁত নখ উপড়ে করেছিলেন ১৭২ রানের ওপেনিং জুটি।

গিলি সেবার ফাইনালে খেলে যান ১৪৯ রানের একটা অমর ইনিংস। ঐ দুই ফাইনালে দুই ওপেনিং জুটির স্থায়িত্বই মোটামুটি অর্ধেক ম্যাচ জিতিয়ে দেয় অজিদের, এবং মানসিক ভাবে পুরো দুমড়ে মুচড়ে দেয় ভারত বা শ্রীলঙ্কাকে। এর আগে ২০০২ এ অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ডারবান ম্যাচে অসাধারণ ১৭০ রানের জুটি উপহার দেন এই জুটি, ওয়ান ডেতে দু’জনের এটাই প্রথম ১০০+ ওপেনিং জুটি।

সেবারও অসাধারণ সেঞ্চুরি করেন গিলক্রিস্ট – পোলক, এনটিনি, ক্যালিসদের বিরুদ্ধে ২৭০+ তাড়া করতে গিয়ে। এই দু’জন প্রথমবার একসাথে ওপেনিং করা শুরু করেন ভারতের বিরুদ্ধে ২০০১ এর সেই ধুন্ধুমার ওয়ান ডে সিরিজে, প্রথম ম্যাচে ব্যর্থ হলেও গোয়াতে দ্বিতীয় ম্যাচেই আসে ৭০ রানের পার্টনারশিপ। এর আগে বেশ কয়েকটা বছর ওপেনিং এ মার্ক ওয়ার সঙ্গী হয়ে কাটান গিলক্রিস্ট, ঐ জুটিও যথেষ্ট ভালো ফুল ফুটিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু হেইডেন আসার পর অস্ট্রেলিয়ার ওয়ান ডে ক্রিকেট খেলার ধরণে আরো খানিকটা পরিবর্তন আসে।

২০০১ এর ভারত সিরিজ ছিল হেডেনের ও ফিরে আসার মঞ্চ, এরপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। ২০০৫ এর কিছু সময় হেডেনের অফ ফর্ম বা ২০০৮ এর সি বি সিরিজটায়, যেটা এই জুটির ও শেষ সিরিজ, সেখানেই এই জুটি খানিক ম্রিয়মান ছিল। গিলি – হেডেনের দুর্ধর্ষ ওপেনিং জুটির পরেও অজিদের হারতে দেখা গিয়েছিলো ভারতের বিরুদ্ধে ২০০৩ এর ত্রিদেশীয় সিরিজে গোয়ালিওর ম্যাচে, যেখানে ১৩২ রানের ওপেনিং জুটির পরেও জাহির, ভাজ্জি, কুম্বলে, শেহবাগের সামনে আটকে যায় অস্ট্রেলিয়া।

গিলক্রিস্ট – হেইডেন ওপেনিং জুটি আজ হয়তো অতীত, এখনকার সব দেশের ওপেনাররাই মোটামুটি ১০০র বেশি বা তার কাছাকাছি স্ট্রাইক রেটে নিয়মিত ঝড় তুলছেন, কিন্তু আজ থেকে ১৫-১৮ বছর আগে একদিনের ক্রিকেটের গতি এযুগের থেকে অনেকখানিই আলাদা ছিল। তখন ৫০ ওভারে ২৫০+ রান ও যথেষ্ট ভালো স্কোর বলেই গণ্য হতো।

একসময়ে ওয়ান ডে ক্রিকেটে গ্রেটব্যাচ – মার্টিন ক্রো কিংবা সনাথ জয়াসুরিয়া – রমেশ কালুভিথারানা জুটি যে প্রথম বল থেকেই মার মার কাট কাট ব্যাটিং শুরু করেন, সেই ব্যাপারটাকেই পরবর্তীকালে গিলক্রিস্ট – হেইডেন যেন পূর্ণতা দেন, আর সেটাই যেন আজকের দিনে ওয়ান ডে ক্রিকেটে ওপেনিং ব্যাটারদের ঘোষিত টেমপ্লেট হয়ে গিয়েছে। ওপেনিং জুটি একদিনের ক্রিকেটে অনেক আসবে, যাবে কিন্তু সেকালের অজি সভ্যতার গিলি – হেইডেন জুটি যুগ যুগ বেঁচে থাকো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link