More

Social Media

Light
Dark

কপিল-দাউদ ও সেকালের শারজাহ

একটা সময়ে ভারতের অপরাধজগতের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে চলে আসত দাউদ ইব্রাহিমের নাম। কয়েক দশক ধরে ভারতের মাফিয়া জগতের একছত্র সম্রাট অপরাধ জগতটা শুধু আন্ডারওয়ার্ল্ডেই আটকে রাখতে চাননি। ছড়িয়ে নিতে চেয়েছেন বহুদূর।

রাজনৈতিক সংসর্গ, বলিউডে সখ্যতাসহ বিভিন্ন দিকে নিজের ডালপালা ছড়ানো দাউদ চেয়েছিলেন উপমহাদেশীয় বিশেষ করে  ভারতীয় ক্রিকেটে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে।

একটি ঘটনা সকলের সামনে আসায় ব্যাপারটি শোরগোল তুলছে। ১৯৮৭ সালে দুবাইয়ের শারজায় অনুষ্ঠিত হচ্ছিল অস্ট্রো-এশিয়া কাপ। সে টুর্নামেন্টে ভারত বাদে অংশ নেয় পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড।

ads

সেই আসরে খেলা দেখতে আসা দাউদ ইব্রাহিম দলবল নিয়ে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে ঢুকে পড়েন এবং অদ্ভুত প্রস্তাব রাখেন যে, ভারত যদি এই টুর্নামেন্ট জিতে নেয়, তবে তিনি দলের ক্রিকেটারদের টয়োটা গাড়ি উপহার দেবেন। যদিও দল এ প্রস্তাবে পাত্তা দেয়নি, অধিনায়ক কপিল দেব আসা মাত্রই তাঁকে ড্রেসিংরুমই ছাড়তে হয়।

ব্যাপারটি তেমন অনৈতিক মনে নাও হতে পারে, একজন ভারতীয় ধনী ভারতের খেলায় খুশী হয়ে উপহার দিতেই পারেন। কিন্তু প্রকাশ্য ঘোষণা না দিয়ে এরকম গোপনে একদম ড্রেসিংরুম পর্যন্ত চলে আসা এবং তাঁর অতীত ইতিহাসই সন্দেহ প্রকাশে বাধ্য করে।

দাউদ ও তাঁর ‘ডি কোম্পানি’-র ম্যাচ ফিক্সিংয়েও কুখ্যাতি ছড়িয়েছে। দুবাইতে ক্রিকেটকে নিয়ে কোটি কোটি টাকার জমজমাট জুয়ার আখড়া বানানোর অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন তাঁরা।

ঘটনাটি প্রায় ২৬ বছর আড়ালে ঢাকা ছিল, বিসিসিআই-এর সাবেক সেক্রেটারি জয়ন্ত লিলির বই এবং প্রাক্তন ক্রিকেটার দিলীপ ভেংসরকারের লেখায় সেসব অজানা ও অন্ধকার অধ্যায়ের খবর জানা যায়।

এত বছর ঘটনাটি জনসম্মুখে না আসায় অধিনায়ক কপিল দেবের দিকে অনেকেই বাঁকা চোখ দেখাতে শুরু করেন। তবে কপিল দেব ঘটনাটি মিডিয়ায় অস্বীকার করেন।

তিনি বলেন, ‘আমি দূর থেকে দেখেছিলাম বটে, এক ‘ভদ্রলোক’ ড্রেসিংরুমের বারান্দায় দীর্ঘক্ষণ পায়চারি করছেন। খেলোয়াড়দের সাথে কিছুক্ষণ কথাও বলেন। কিন্তু বহিরাগত প্রবেশের অনুমতি না থাকায় আমি এসে তাঁকে বেরিয়ে যেতে বলি। তখন এক লোক আমাকে জানায়, সে ছিল দাউদ ইব্রাহিম, চোরাচালান ব্যবসায়ী। এর বেশি কিছু ঘটেনি। আমার জানা মতে, ড্রেসিংরুমে ওরকম কোনো প্রস্তাব আসেনি। যদি দিলীপ এরকম বলেই থাকে, তবে সেই সেটা আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবে।’

দিলীপ ভেংসরকারের বক্তব্য ছিল এই রকম – ‘সে আমাদের চমকে দিয়ে ড্রেসিংরুমে আসে, কুশলাদি বিনিময় এবং উৎসাহব্যঞ্জক কথার এক পর্যায়ে বলে বসে, “তোমরা যদি এই ট্রফি জিতিয়ে দেখাও, তবে আমি তোমাদের প্রত্যেককে একটি করে টয়োটা গাড়ি উপহার দেব।” এই কথায় ক্রিকেটাররা হকচকিয়ে গেলেও সেই প্রস্তাবে কেউ সাড়া দেন নি।’

সেই বক্তব্যকে আরেকটু শক্তিশালী করে জয়ন্ত লিলির প্রকাশিত বই, যেখানে তিনি পুরো একটি অধ্যায় নিয়ে শুধু এই ঘটনাকে আলোকপাত করেছেন। তিনি লিখেছেন –

‘আমি সেখানে ছিলাম বোর্ডের একজন সদস্য হিসেবে। সে আমাকে এবং ম্যানেজার দানেশ্বর আগাসিকে পেয়ে এই কথা জানায়, যখন আমরা দুবাইয়ে এক পরিচিত ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম।’ সে আমাকে বলে, “তোমার দলকে বল, তাঁরা জিতলে আমি সত্যই গাড়ি দেব। কিন্তু তাঁদেরকে জিততেই হবে।”

দুর্ভাগ্য এই যে, ভারত সেবার জিততে পারেনি, নেট রান রেটের মারপ্যাঁচে অস্ট্রেলিয়া কাপ বাগায়। কিন্তু সেই হারে ভারতীয় ক্রিকেটারদের থেকেও মনে হয় একজন বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন।

আমরা তাঁকে সেভাবে চিনিনি, কিন্তু এর বেশ কবছর পর ১৯৯৩ এ যখন ভারত বোমায় বোমায় কেঁপে উঠল, তখন চিনলাম কার সাথে আমরা দেখা করলাম। ডন ইব্রাহিম, মুম্বাই হামলার কারিগর।

আমাদের সাক্ষাত কোনভাবে পুলিশের আতস কাঁচে চলে এসেছিল। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের তদন্তের মুখে পড়তে হল। তবে ভাগ্য ভাল ছিল যে, পুলিশ বিশ্বাস করেছিল যে, আমাদের তাঁর সাথে দেখা করার কোন ইচ্ছাই ছিল না।’

এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, শারজার স্টেডিয়ামেও ডনের হাত বেশ ভালই প্রভাব বিস্তার করেছিল। হয়তো সেই উপহার ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের অন্দরমহলে প্রবেশের মুখে এক উপঢৌকন। মাঠে প্রায়ই তার সাথে ফিল্মস্টারদেরও দেখা যেত। এর মধ্যে অনিল কাপুর কিংবা ‘রাম তেরি গাঙ্গা ম্যাইলি’ খ্যাত মন্দাকিনিরা ছিলেন।

একবার এক দলের দুয়ার থেকেই ফিরে এসেছেন বটে, কে জানে অন্য কোন দেশের ক্রিকেটকে তিনি হাতের মুঠোয় পুরেছেন কিনা, এ কাজে যে তিনি পারদর্শী।

২০০১ সালে ভারত সরকার শারজা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে খেলা নিষিদ্ধ করে অতিরিক্ত ফিক্সিংঝুঁকির কারণে। আসলে ১৯৯০ থেকে শারজা তাঁর ক্রিকেটীয় জৌলুস হারাতে থাকে অতিরিক্ত জুয়াপ্রাবল্যের কারণে। অনেক দলই সেখানে খেলতে রাজি হত না।

একটা সময়ে শারজায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই বন্ধ হয়ে যায়। ভেন্যুটা এখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের মধ্যেই টিকে আছে কেবল। প্রকাশ্যে ক্রিকেট বিষয়ক জুয়া ও ফিক্সারদের আনাগোনাও তুলনামূলক কমে গেছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link