More

Social Media

Light
Dark

হেরে যাওয়া আহত পাখি

২০১৬ সালের অলিম্পিক ফুটবলের ফাইনাল। মারাকানা স্টেডিয়ামে পিনপতন নীরবতা। উৎকন্ঠার তীব্র চাহনী খেলোয়াড় কিংবা দর্শক – সবার চোখে মুখে স্পষ্ট।

পেনাল্টি শ্যুটআউটের শেষ শটটি নিতে যাচ্ছেন নেইমার। এর আগে জার্মানির শট রুখে দিয়েছেন তাঁর সতীর্থ গোলরক্ষক উভেরটন। তাই কিছুটা নির্ভার, কিছুটা স্নায়ুচাপ আর স্বপ্নের হাতছানি নিয়ে ডি-বক্সে নেইমার। সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে নেইমার গোল করলেন।

জিতে নিলেন নিজেদের ফুটবল ইতিহাসের প্রথম অলিম্পিক স্বর্ণ পদক। হলুদ-নীল জার্সিধারীদের হয়ে এখন পর্যন্ত সেটিই নেইমারের শেষ অর্জন। ঘটনাটা ২০১৬ এর, মাঝে চলে গেছে একটি বিশ্বকাপ ও তিনটি কোপা আমেরিকা।

ads

পাঁচটি বিশ্বকাপের মালিক ব্রাজিল। শুধুই কি পাঁচটি বিশ্বকাপ? ফুটবলের প্রথম মহারাজা পেলের জন্মভূমিও তো দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি। গারিঞ্চা, সক্রেটিস, রোনালদিনহো এর মত কত শত নানন্দিক খেলোয়াড়ও উপহার দিয়েছে দেশটি। ব্রাজিলের প্রতিটি খেলোয়াড় দাপিয়ে বেড়ায় ইউরোপিয় লিগ থেকে শুরু করে এই উপমহাদেশের লিগগুলোও।

বিশ্বের এমন একটি লিগ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে দেখা মিলবে না নূন্যতম একজন ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়ের। এত এত প্রতিযোগিতার মাঝেও ব্রাজিলের আস্থার প্রতিক হয়ে তাঁদের জাতীয় দলে জায়গা করে নেন অনেকেই। গেলো এক দশক ধরে ব্রাজিলিয়ান এই আস্থার প্রতিক ছিলেন নেইমার জুনিয়র।

২০১০ বিশ্বকাপ পরবর্তী যুগে ব্রাজিলের ‘পোস্টার বয়’। কেবল মাত্র ২৯ বছর বয়সেই ছাড়িয়ে গেছেন বহু কিংবদন্তিকে, অপেক্ষায় রয়েছেন গোলের বিচারে পেলেকে ছাড়িয়ে যাবার। আট গোল, জাতীয় দলের হয়ে আর মাত্র আটটি গোল করতে পারলে তিনি নিজেকে নিয়ে যাবেন অনন্য উচ্চতায়।

যে উচ্চতায় নেই সয়ং পেলেও। তবে এই তারকা ফুটবলার কিছুদিন যাবৎ রয়েছেন আলোচনায় কিংবা ধরুন সমালোচনায়। পেছনের কারণ তাঁরই এক বক্তব্য।

সম্প্রতি তিনি এক ডকুমেন্টরিতে জানিয়েছেন ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে তাঁর জন্যে শেষ বিশ্বকাপ। এতেই যেন সরগরম মূলধারার গনমাধ্যম থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া। চর্চা হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে সাথে খানিক সমালোচনা। তাঁর সাথে নিন্দুকের নিন্দার বিষাক্ত বাণ ক্রমশই ছুটে যাচ্ছে নেইমারের দিকে।

কেন তিনি এমন এক বক্তব্য রাখলেন? কেন এত জলদি তিনি হাল ছেড়ে দিতে চাইছেন? মেসি-রোনালদো তো এখনও দিব্বি  স্বগৌরবে খেলে যাচ্ছেন জাতীয় দলের হয়ে। তাঁরা তো নেইমার থেকে বছর পাঁচ কিংবা ছয় বড়। তাঁদের সাথে বিশ্ব ফুটবলে লড়াই করা নেইমার এত দ্রুত দমে যাবেন?

তিনি দমে যাবেন কি না এটা সময় বলে দেবে। তবে তাঁর চোখে আসন্ন বিশ্বকাপ কেন শেষ মনে হলো তা একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।  ইনজুরি নাকি প্রত্যাশার চাপ কিংবা অর্জন খরা। কিংবা ধরুণ এই তিনটি কারণেই হয়ত নেইমার চাচ্ছেন তাঁর জাতীয় দলের জার্সি আগামী বিশ্বকাপের পর বাধাই করে তুলে রাখতে।

এখন পর্যন্ত নেইমার ব্রাজিলের হয়ে দুইটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁকে ঘিরেই যেন সকল পরিকল্পনা সাজাতেন সাবেক কোচ কিংবা ম্যানেজার। এতে সেই কোচদের খুব বেশি দায়ভার রয়েছে তা বলা মুশকিল। নেইমার নিজেকে প্রমাণ করেছেন, আস্থার প্রতিদান দিয়ে ভরসা জিতে নিয়ে হয়েছেন দলের প্রাণ ভোমরা। স্বভাবতই তিনি বনে গেলেন সকল কিছুর মধ্যবিন্দু। সেই বিন্দুকে ঘিরে করা বৃত্তেই যেন গেলো এক দশক ধরে আটকে আছে ব্রাজিল দল। বৃত্তের বাইরে যেতে চাইছে না কিংবা যেতে পারছে না।

বৃত্তের কেন্দ্রে থাকা নেইমার স্বভাবতই এক প্রকার প্রত্যাশার চাপে পিষ্ট হচ্ছেন। বয়স হয়েছে সাথে তাঁর সাথে নতুন করে সংসার বেঁধেছে বেশ কিছু ইনজুরি। ২০১৪ বিশ্বকাপে কলোম্বিয়ার বিপক্ষের ম্যাচে কি নির্মম এক ট্যাকেলে শিকার হয়েছিলেন তিনি।

শুধু যে ছিটকে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপ থেকে তা নয়, সম্ভাবনা জেগেছিল জীবনের পথচলা থেকে ছিটকে যাবার, ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার। কিন্তু তিনি তাঁর অদম্য ইচ্চাশক্তির বলে আবার ফিরে এলেন। উজ্জ্বল বার্সা ক্যারিয়ারে আশা জাগালেন দেশের হয়ে বিশ্বজয়ের।

কিন্তু তিনি পুঃরায় ব্যর্থ হলেন। কোয়াটার ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে হেরে নেইমারের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন হয়ে যায় ম্লান। ২০১৪ তে ইনজুরি তাঁকে বাঁধা দিলেও ২০১৮ তে বাঁধা হয়েছিলেন বেলজিয়ামের গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া আর তাঁর রক্ষণ দূর্গ। নেইমারকে ঘিরে প্রত্যাশার দিনে তিনি চেষ্টা চালিয়েছেন নিজের সর্বোচ্চ। কিন্তু ভাগ্য বিধাতা প্রসন্ন হলেন না। নেইমার হারলেন, সাথে হেরে গেলো কোটি ভক্তের প্রত্যাশা।

তবে কি ভক্তের প্রত্যাশা তাঁর জন্যে হয়ে যাচ্ছে বোঝা?  তাছাড়া ইনজুরি তো লেগেই আছে তাঁর সাথে। ক্যারিয়ারে আরো কতসব রেকর্ড গড়ার ছিলো তাঁর। আরো কত অর্জনের পাশে লেখার কথা ছিল তাঁর নাম। শুধু এক কনফেডারেশন কাপ আর অলেম্পিক গোল্ড মেডেল অবধি থেমে থাকার কথা তো ছিলনা।

আরো একটি শিরোপা জয়ের সম্ভাবনার মৃত্যু হয় গত কোপা আমেরিকায়। মেসির আর্জেন্টিনার কাছে হেরে ২০১৬ এর পর কোন শিরোপা জয়ের আক্ষেপ হয় আরো সুদীর্ঘ।

প্রত্যাশার চাপ আর মারাত্মক সব ইনজুরি আর মনের গহীন কোণে দেশকে শিরোপা জেতাতে না পারার আক্ষেপ থেকেই হয়ত নেইমার ২০২২ বিশ্বকাপকে নিজের শেষ সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছেন। কিংবা জাতীয় দলে তাঁর উপর নির্ভরশীলতা থেকে দলের সামগ্রিক পারফর্মেন্সের অধ:পতন অথবা আশানুরুপ ফলাফল না আসা তাঁকে ভাবিয়েছে ইতি টানবার কথা।

সম্প্রতি নেইমার বিহীন ব্রাজিল ১-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও ৩-১ গোলে হারিয়েছে ভেনেজুয়েলাকে, বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে। কিন্তু কলম্বিয়ার বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে নেইমার থাকা সত্ত্বেও। তাঁর একার প্রতি নির্ভরশীলতা দলকে বিপদেই ফেলছে।

সামগ্রিক সব কিছু বিবেচনায় নেইমার হয়ত শেষ চেষ্টাটা করবেন ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে। ২০০২ এর পর আবার তাঁর হাত ধরেই রিও ডি জেনেরিওতে আসবে স্বর্ণালী সেই ট্রফিটি। ঘুচবে দুই দশকের অপেক্ষা, আক্ষেপ ও প্রত্যাশার অবসান। এর পরে হয়ত শরীরটা আর সঙ্গ দেবে না, প্রত্যাশার চাপ বইতে পারবে না কাঁধগুলো। মন হয়ত বলবে, ‘থাক, ইতি টানা যাক!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link