More

Social Media

Light
Dark

ক্রিকেট কমেন্ট্রির কচকচি

অজয় বসুর – বাংলা বেতার ধারাভাষ্যের রবীন্দ্রনাথ তিনি। তাঁর ধারাভাষ্য শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু তাঁর জন্মদিনে একটু ক্রিকেট ধারাভাষ্য নিয়ে চর্চা হলে বোধহয় ক্ষতি নেই। প্রথমেই বলে রাখি, বেতার ধারাভাষ্য শোনার খুব একটা সৌভাগ্য আমার হয়নি। বাংলায় তো নয়ই।

মনে আছে ২০০৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা যেবার ইডেনে খেলতে এল, সেবার বেতারে বাংলা ধারাভাষ্য শুনিয়েছিল। তবে তা মনে তেমন দাগ কাটতে পারেনি। এছাড়া ইশকুলে লুকিয়ে হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে খেলা শোনা ছিল। কিন্তু তার ধারাভাষ্য যেন গদ্য। কোনো কাব্যিক মোচড় তাতে থাকতো না। আমার ধারাভাষ্য শোনার পুরোটাই মূলত বোকাবাক্সয়।

প্রথমেই বলি, একটা আদর্শ কমেন্ট্রি প্যানেল আমার মতে, কেমন হওয়া উচিত। আদর্শ প্যানেল বললেই আমার চ্যানেল নাইনের প্রবাদপ্রতিম প্যানেলের কথা মনে হয়। শান্তি ও উচ্ছাসের আদর্শ মিশেল। চ্যানেল নাইনের ধারাভাষ্যের মুখ বহুদিন যাবৎ যিনি ছিলেন, ক্রিকেট ধারাভাষ্যের তিনিই গুরু। রিচি বেনো। পুরো প্যানেলটা আগলে রাখতেন যেন।

ads

তাঁর স্বল্পভাষী অথচ শ্রুতিমধুর, মাঝে মধ্যে হাস্যরসের উদ্রেক করা অথচ কখনোই সেটা ড্যানি মরিসন সুলভ ছ্যাবলামিতে পরিণত না করা ধারাভাষ্য ঘন্টার পর ঘন্টা শোনা যায়। প্রতি ওভারের শেষে স্কোর বলার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন বেনো। যেহেতু বেতার ধারাভাষ্যে সবাই শ্রোতা এবং কেউই সামনাসামনি খেলাটি দেখতে পাচ্ছেন না, কাজেই সেখানে প্রতি ওভারের বা বলের শেষে শ্রোতাকে স্কোরের জানান দেয়া ধারাভাষ্যকারের কর্তব্য।

কিন্তু, টিভিতে তো দর্শক স্কোর সহ খেলাটা দেখতেই পাচ্ছেন। একই জিনিস জানান দেয়ার কি আছে? তার চেয়ে এমন কিছু, যেটা দর্শকের আম চোখে ধরা পড়ছে না সেটাই তো ধারাভাষ্যকার বলবেন। কেন একটা সিদ্ধান্ত মাঠের কুশীলবরা নিলেন, তার প্রভাব কি হতে পারে সেসব আর কি। কিন্তু শুধু তাই না। মাঝে মধ্যেই একটা হাস্যরসাত্মক মন্তব্য তার মাঝে ঢুকিয়ে দিতেন বেনো।

বেনোর ধারাভাষ্যের গুণে টেস্ট ক্রিকেটের কিছু ক্লান্ত মুহূর্তও রঙিন হয়ে উঠতো। তবে ধারাভাষ্যকার বেনোর যে গুণটি সবচেয়ে কম আলোচিত অথচ অত্যন্ত জরুরি, তা হলো সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার ক্ষমতা। আন্ডারআর্মের পর গলা খুলে গ্রেগ চ্যাপেলের নিন্দে করেন তিনি।

এরপর আসি চ্যানেল নাইনেরই টনি গ্রেগের কথায়। গ্রেগ আবার বেনোর বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী ভাষ্যকার। প্রচণ্ড জীবন ছিল তাঁর গলায়। অন-এয়ার বেটিং জাতীয় ব্যাপার স্যাপার নিয়েও বলেছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, বেনো তো শুধু পিটারের জন্যে ধারাভাষ্য দেন। যে ক্রিকেট খেলে, বোঝে। কিন্তু পিটারের মা ও বান্ধবী। তাঁরা তো ক্রিকেট সম্পর্কে ততটা জানে না।

তাঁরা তো বেনোর ধারাভাষ্যে ঘুমিয়ে যাবেন। তাই গ্রেগ ছিলেন অনেক বেশি সার্বজনীন। চ্যানেল নাইনে বেনো স্কুলের ধারাভাষ্যকার ছিলেন মার্ক টেলর, ইয়ান চ্যাপেল। গ্রেগ স্কুলের ছিলেন বিল লরি, ইয়ান হিলি, মাইকেল স্লেটার। অর্থাৎ দুরকম ধারাভাষ্যেরই এক আদর্শ মিশেল ছিল নাইনের প্যানেলে।

এরা বাদে আবার আরেকজন রয়েছেন যিনি একান্তই নিজের একটি ধারাভাষ্য স্কুল বানিয়ে নিয়েছেন। তিনি মার্ক নিকোলাস। অসম্ভব সুন্দর ভরাট গলা। সাথে অসাধারণ শব্দের ভান্ডার। এবং বিশেষ মুহূর্তে তিনি এমন ভাবে এমন কিছু একটা বলবেন, যা দর্শক ভাবতেই পারবে না। একটা আধঘন্টার সেশনকে শ্রবণোপযোগী ভাবে একা চালিয়ে নিয়ে যেতে খুব বেশি ভাষ্যকার পারেন না। মার্ক নিকোলাস পারেন। বেনোর বয়েস বাড়ার সাথে সাথে সঞ্চালকের কাজটাও করতেন নিকোলাস। এবং বেনোর অভাব যে খুব একটা অনুভূত হতো তা নয়।

এছাড়াও স্কাই টিভির ধারাভাষ্য বরাবর খুব ভালো লাগতো। ডেভিড গাওয়ারের ধারাভাষ্যের বিরাট ভক্ত ছিলাম। তাঁর বাচনভঙ্গি ও গলা যেন তাঁর কভার ড্রাইভ গুলোর মতোই মিষ্টি ও পেলব ছিল। অথেরটন, বোথাম, হুসেন, হোল্ডিং প্রত্যেকেই আমার খুব পছন্দের। এছাড়াও যাদের নাম করতেই হবে তাঁরা বয়কট, ইয়ান স্মিথ, ইয়ান বিশপ, মাইক হেসমান, সুনীল গাভাস্কার, সৌরভ গাঙ্গুলি।

রবি শাস্ত্রীর ধারাভাষ্যে আমি কখনোই খুব একটা বৈচিত্র পাইনি। যদিও তাঁর গেম রিডিং ভালো। গাভাস্কারও তাই। গাভাস্কার শাস্ত্রীর চেয়ে কিঞ্চিৎ এগিয়ে থাকবেন মন খুলে সত্যিটা বলতে পারার সাহসটার জন্য। আজকে টি-টোয়েন্টি যুগে গাভাস্কার হয়তো বেশ কিছু ভুলভাল বলে ফেলেন। হবেও বা বয়সের দোষ। কিন্তু সেরা সময়ের সানি সত্যিই অসাধারণ।

অক্রিকেটার ধারাভাষ্যকারদের মধ্যে টনি কোজিয়ার ও হার্শা ভোগলের ওপরে কেউ নেই। ওই দুজনের প্রতি আমার বরাবরই একটু বেশি টান, কারণ নিজেও এক সময় এই পেশায় যাবার স্বপ্ন দেখতাম। বর্তমান প্রজন্মের ভারতীয় ধারাভাষ্যকারদের মধ্যে আগারকার ভালো। তবে গলায় সেই পেলবতা নেই।

কার্থিক অবশ্য প্রথম শ্রবণেই আমার কান ও মন জয় করেছে। হিউমার, কণ্ঠ, ভাষা এবং সর্বোপরি বিশ্লেষণ-প্রতিটাতেই দারুণ তিনি। বাকি জুনিয়র গাভাস্কার, মুরলি কার্তিক এবং দীপ দাশগুপ্তর কথা কম বলাই ভালো। আসলে ক্রিকেট ধারাভাষ্য এমন একটা ব্যাপার যা নিয়ে যতই কথা বলি শেষ হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link