More

Social Media

Light
Dark

এখনও বিশ্বাস হয় না যে স্যার আমাদের মাঝে নেই

স্যার এত দ্রুত স্মৃতি হয়ে যাবেন এটা কখনো ভাবতেই পারিনি। এখনও বিশ্বাস হয় না যে স্যার আমাদের মাঝে নেই। স্যার চলে যাওয়ার পর তাঁর সাথে কাটানো অনেক মুহুর্তই কাতর করে দিচ্ছে আমাকে। স্যারের সাথে এত সময় কাটিয়েছি, তাঁর সাথে এত এত সুন্দর মুহুর্ত যে কোনটা রেখে কোনটা শেয়ার করি সবার সাথে বুঝতে পারছি না। অনেক কিছু মনেও নেই।

আমি স্যারকে প্রথম দেখি ১৯৯৭ সালে। আমি তখন ধানমন্ডি ক্লাবে প্রথম বার ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলাম। তখনই প্রথম পরিচয় হয় তাঁর সাথে। কিন্তু আমি ধানমন্ডি ক্লাবে সুযোগ পাইনি। তখন আমার এসএসসি পরীক্ষাও চলছিল। এজন্য আমি আবার ঢাকা থেকে যশোরে চলে যাই। পরীক্ষা শেষে ঢাকায় এসে স্যারের সাথে আমার আবার পরিচয় হয়।

কিন্তু ঐ বছর আমার ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে  খেলার সুযোগ হয়নি। স্যার আমাকে পরামর্শ দিলেন নিচের সব টুর্নামেন্ট গুলো যেন খেলে আসি। কোয়ালিফায়ার, এরপর তৃতীয় বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ খেলে আমি আবার ধানমন্ডি ক্লাবে ফিরে আসি। তখন থেকেই স্যারের কাছাকাছি আসার সুযোগ হয় আমার।

ads

আমাদের যশোরের সাজ্জাদ হোসেন বিপুল ভাই ধানমন্ডিতে খেলতো। স্যার ওনাকে বলেছিল ভালো কোন ছেলে থাকলে, ভালো ব্যাটিং করে এমন কেউ থাকলে যেন নিয়ে আসে। এরপর ভাই আমাকে ধানমন্ডিতে নিয়ে আসে। এরপর থেকেই মূলত স্যারের সান্নিধ্যে এসেছি। স্যারের অধীনে অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছি।

কিন্তু এরপর স্যার যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের কাছে  চলে যায়। কিন্তু স্যার ধানমন্ডি ক্লাবে বলে গিয়েছিল আমাকে রেখে দিতে। স্যারের কথা মতো আমি প্রথম বিভাগে খেলতে থাকি। ঐ বছর ভালো খেলি। পরের বছর আবার স্যার ফিরে আসে। স্যার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসে প্রথম বিভাগে আবার কাজ শুরু করলো। সাথে আরো একজন কোচ ছিল। দু’জনের অধীনেই খেলতে থাকি।

প্রথম বিভাগে ভালো খেলার পর স্যার আমাকে প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ করে দিল। স্যার কাউকে ছাড়েনি। দুই একজন হয়তো ছিল না। স্যার তো আমার খেলা দেখেছে। স্যার পছন্দ করতেন আমাকে। ক্রিকেটার হিসাবেও পছন্দ করতো, ব্যক্তি হিসাবেও স্যারের প্রিয় ছিলাম আমি। এরপর থেকে ধানমন্ডিতেই নিয়মিত  খেলতে থাকি।

কিন্তু বেশি দিন খেলা হয়নি স্যারের অধীনে। স্যারের একটা আক্ষেপও ছিলো। স্যার আমাকে সুযোগ করে দিয়েছিল। পাঁচ ছয়টা ম্যাচ খারাপ খেলার পরেও প্রিমিয়ার লিগে মোহামেডানের বিপক্ষে স্যার আমাকে সুযোগ দিয়েছিল। কারণ আমার উপর স্যারের একটা আত্মবিশ্বাস ছিলো যে ভালো খেলবো এক সময়। আমি মোহামেডানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করি। আমার সেঞ্চুরিতেই মোহামেডানকে হারাই আমরা। এরপর থেকে স্যারের সাথে আমার সম্পর্কটা আরো ঘনিষ্ঠ হয়।

আর আক্ষেপের কথা যেটা বললাম, ২০০২ সালের পরে স্যারের সাথে আমার বাজে একটা ঘটনা ঘটে যায়। স্যার আমাকে অনূর্ধ্ব- ১৯ দলের সাথে সফরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যাই। আমি জাতীয় দলের হয়ে খেলি। স্যার অনূর্ধ্ব-১৯ দল নিয়ে নিউজিল্যান্ড সফরে যায়। জাতীয় দলের হয়ে আমি দেশের মাটিতে খেলি। কিন্তু স্যার নিউজিল্যান্ডে থাকাতে আমার খেলা দেখেনি।

এরপর আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাই। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকেই আমি সিটি ক্লাবের সাথে চুক্তি করি। আমার ভুল ছিল আমি স্যারকে না জানিয়ে অন্য একটা ক্লাবে চলে যাই। স্যার অনেক দিন আমার সাথে কথা বলেনি। ঐ এক বছরই একটু স্যারের সাথে মনমালিন্য ছিলো। এরপর থেকে আবার সম্পর্কটা ভালো হয়।

এরপর ভালো খেলার কারণে স্যার আমাকে একটা জ্যাকেট উপহার দেয়। এরপর স্যান্ডেল উপহার দেয়। শুধু আমি না, সবার সাথেই স্যারের ভালো সম্পর্ক ছিলো। আমাদের ধানমন্ডির একটা ব্যাচ ছিলো। আমি, দেবুদা, রবিন ভাই, তামিম মোর্শেদ তুষার। তুষারের সাথে স্যারের সম্পর্কটা অনেক ভালো ছিল। সে অনেক আগেই মারা গিয়েছে।

কম বেশি সবার সাথেই স্যারের ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাদের পরের ব্যাচে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, এরপর ইমন, ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক ছিল। স্যারের অধীনে যারা খেলেছে কম বেশি সবার সাথেই তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিলো। স্যার সবাইকে তাঁর সর্বোচ্চটা দিয়ে সব সময় সাহায্য করতো। সবার যে কোন প্রয়োজনে এগিয়ে আসতো।

ক্রিকেটার, কোচ, সংগঠক, মেন্টর, সব গুনই স্যারের ভিতর ছিল। এই সুযোগটা অনেকেই হয়তো নিয়েছে। আমারও ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি এক সময় ছোট ছিলাম। তখন ঐ ভাবে বুঝতাম না। স্যারকে না বলে অন্য ক্লাবে চলে গিয়েছি। শুধু আমি না। এই সুযোগটা অনেকেই নিয়েছে। স্যারকে না বলে, স্যারকে কষ্ট দিয়ে অন্য ক্লাবে চলে গেছে, অন্যদের সাথে চুক্তি করছে। স্যার এতো ভালো মানুষ ছিল, অন্য কোন মানুষ হলে হয়তো বা রেগে যেত।

আমি স্যারকে যে ভাবে দেখেছি, স্যার খুব আড্ডা প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। স্যার তো যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে স্যারের ছেলে মেয়ে থাকতো, স্যারের স্ত্রী থাকতো। খেলাধূলার জন্য, আমাদের সাথে চলার জন্য, আমাদের সাথে মেশার জন্য স্যার যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে  চলে আসে। স্যারের কিন্তু সব সময় সুযোগ ছিল যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার। ক্রিকেটটা স্যার এতো ভালোবাসতো। স্যারকে আমরা বলতাম স্যার আপনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান না কেনো। স্যার বলতো তোমাদের জন্যই আসলাম, আর তোমরা চলে যেতে বলছো।

স্যারের স্ত্রী যখন মারা যায়, তখনও আমরা বলছি স্যার যুক্তরাষ্ট্রে আপনার ছেলে মেয়ে রয়েছে, নাতি নাতনি রয়েছে, আপনি ওখানে চলে যান। কিন্তু স্যার বলতো আমি ক্রিকেটের জন্য ফিরেছি, তোমাদের কাছে ফিরেছি। আবার কেনো চলে যেতে বলো। তো আমরাই খোঁজ খবর নিতাম। স্যারের সাথে যাদের ভালো সম্পর্ক সবাই স্যারের বাসায় যাওয়া আসা করতো। আমরা নিয়মিত যেতাম।

স্যারের সাথে তো অনেক স্মৃতি। সব বলে তো শেষ করা যাবে না। অনেক গুলো মনেও নেই। কিছু বলি, আমি অনেক দিন রান করতে পারছিলাম না, স্যার আমার কাঁধে হাত রেখে বললো চিন্তা করো না, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি তোমার মত খেলতে থাকো। মনে হলো এটা বলতে গিয়ে স্যারই কেঁদে দেবে।

এর পরের ম্যাচেই আমি ভালো খেলি। ছয়টা ম্যাচ খারাপ করার পরেও অন্য কোন কোচ হলে আমাকে হয়তো এই সুযোগটা দিত না।

মোট ৪২ রান করেছিলাম ছয় ম্যাচে। আমার জীবনে স্যারের অবদান বলে আমি শেষ করতে পারবো না। ওনার সাথে আমি এত এত সময় কাটিয়েছি, যার সব হয় তো মনে নেই। যখন স্যারকে না বলে অন্য ক্লাবে চলে গিয়েছিলাম। স্যার অনেক দিন আমার সাথে কথা বলতো না। স্যারের কাছে আমি কী ভাবে মাফ চাইবো, সেটাও বুঝে উঠতে পারিনি। পরবর্তীতে দ্রুতই  সব ঠিক হয়ে যায়।

২০১৫-১৬ সালে আমি স্যারের অধীনে আবার খেলার সুযোগ পাই কলাবাগানের হয়ে। তখন স্যারের রাগও আমি দেখেছি। স্যার আমাকে খুব ভালোবাসতো। আগে স্যারের রাগ দেখিনি, তখন দেখছি। স্যার আমার একটা জিনিস নিয়ে আপসেট ছিলো, এজন্য স্যার আমাকে ধমক দিয়েছিল। আমি কেঁদেও দিয়েছিলাম। কত স্মৃতি স্যারের সাথে।

আমরা একটা ম্যাচে জয় পেলেই প্রিমিয়ার ডিভিশনে উঠবো, তখন অনেক পাতানো ম্যাচ টাইপের হতো, আমাদেরও ইচ্ছে ছিলো যে পাতানো ম্যাচ খেলবো। কিন্তু স্যার রাজি হয়নি। স্যার বললো খেলে যদি উঠতে পারো তবে ওঠো, না পারলে না ওঠো। স্যার এরকমই ছিলো। উনি ওনার জায়গা থেকে অসাধারণ একটা ব্যক্তি ছিল।

গত দুই তিন বছর স্যারের সাথে ঐ ভাবে কাজ করা হয়নি। স্যার আমাকে বলতো এখনো খেলে যাচ্ছো এটাই তো অনেক কিছু। তোমার বয়সের অনেক ছেলে খেলা ছেড়ে দিয়েছে। তুমি যত দিন পারো খেলে যাও, রান করে যাও। নির্বাচকরা যদি নাও নেয়, কিন্তু তুমি তো একটা উদাহরণ তৈরি করে যাচ্ছো। এটাই বড় কিছু, এটা নিয়েই থাকো অসুবিধা নাই। উনি সব সময় উৎসাহ দিতেন আমাকে।

শেষ কয়েক বছরে স্যারকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমাদের একটা গ্রুপও হয়েছিল। আমি, দেবুদা ও রবিন ভাই। আমরা প্রায় এক দেড় ঘণ্টা আড্ডা দিতাম। যখনই স্যারের মন খারাপ হতো, তখনই স্যারকে ফোন দিতাম। আমার কাছে মনে হয় স্যার বুকে অনেক কষ্ট নিয়ে চলে গেছেন। স্যার যে কতটা কষ্ট নিয়ে চলে গেল কাউকে জানতেই দিল না। স্যারকে দেখলে বোঝা যেত, স্যারের সাথে কথা বললে বোঝা যেত। আমরা বুঝতাম।

স্যার তো ক্রিকেট নিয়েই বেঁচে থাকতো। কিন্তু করোনা আসার পর থেকে স্যার পুরোপুরি একা হয়ে থাকতো আর কি। স্যারকে সঙ্গ দেওয়ার মত তেমন কেউ ছিল না। এজন্য স্যার খুব কষ্টে  থাকতো। স্যার কোচ হিসাবে, সংগঠক হিসাবে ক্রিকেটকে যে ভাবে দীর্ঘ দিন আগলে ধরে রেখেছিল শেষ জীবনে সে প্রতিদান পায়নি। আমরাই আসলে প্রতিদান দিতে পারিনি।

স্যার খুব চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না এরকম। উনি ওনার কষ্টের কথা সব বলতে চাইতেন না। আমার কাছে মনে হয় স্যারের অনেক স্বপ্ন গুলো তিনি  পূরণ করতে পারেন নাই। ক্রিকেট বোর্ডেও তখনকার মত এখন সেই ভাবে যেত না স্যার। স্যার যদি শেষ জীবনেও বোর্ডের সাথে থাকতে পারতো, আমার মনে হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটকে আরো অনেক কিছু দিতে পারতেন তিনি।

স্যার হসপিতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তাকে নিয়মিত দেখতে যেতাম। কিন্তু আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার পর সব সময় সুযোগ হতো না। সাত দিন ছিল আনোয়ার খান মর্ডানে, ঐ সময় আমরা প্রায়ই যেতাম। স্যার ভালো হয়ে বাসায় ফিরেও আসে। কিন্তু দ্বিতীয় বার ভর্তি হয়ে আর ফিরতে পারলো না। স্যার এভাবে চলে যাবে ভাবতেই পারিনি। মহান আল্লাহ তাআলা স্যারকে বেহেশত নসিব করুক, আমিন।

_______________

বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ তুষার ইমরান। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও তিনি। জাতীয় দলের হয়ে ৪১ টি ওয়ানডে ও পাঁচটি টেস্ট খেলা এই ব্যাটসম্যানের উঠে আসা সদ্য প্রয়াত সর্বজন শ্রদ্ধেয় কোচ ও ক্রীড়ালেখক জনাব জালাল আহমেদ চৌধুরীর হাত ধরে।

জালাল আহমেদ চৌধুরীর সবচেয়ে কাছের এবং প্রিয় ছাত্রও ছিলেন তুষার। প্রথিতযশা এই কোচের সাথে অনেক স্মৃতিও রয়েছে এই ক্রিকেটারের। যার শুরু থেকে একদম শেষ পর্যন্ত তুষার ইমরান লিখেছেন খেলা ৭১-এ। অনুলিখন করেছেন আল-শাহরিয়ার রুবেল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link