More

Social Media

Light
Dark

অগ্নিবান হাতে দানব

স্টেফান চোও এর ‘কুংফু হাসল’ ছবিটা দেখেনি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। পার্ভেটেড ল্যান্ডলর্ড আর স্মোকার ল্যান্ডলেডির একমাত্র ছেলে ছোটবেলায় হারিয়ে যায়। ছবির একেবারে শেষের দিকে যদিও তাঁদের দেখা হয়। এই পরিবারের সবাই দুর্দান্ত মার্শাল আর্টিস্ট ছিল। ছেলে তো বাবা-মায়ের থেকেও অসাধারণ। এরপরেও টিপিক্যাল এশিয়ান বাবা-মা এর মত তাঁদের ইচ্ছা ছিল ছেলে হবে উকিল কিংবা ডাক্তার। আর এই কথা যখন বলেছিল তখন ছেলে বেধড়ক পেটাচ্ছে এক্স গ্যাং এর লোকদের।

এদিকে এই লেখার নায়কের ইচ্ছে ছিল বাস্কেটবল খেলোয়াড় হবার। উচ্চতাটাও একেবারে সেদিকে ডাকছে। ৬ ফুট ৭ ইঞ্চির অ্যামব্রোসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল জীবনে কি হতে চাইতেন, যার উত্তরে তিনি বলেছেন মিউজিশিয়ান। আরেক বিখ্যাত ক্রিকেটার রিচি রিচার্ডসনের সাথে মিলে আছে তাঁদের রক ব্যান্ডও। কিন্তু এই সবের আগে কার্টলি অ্যামব্রোস হচ্ছেন একজন ভয়ংকর, বিধ্বংসী, ত্রাশ সৃষ্টিকারী পেসার।

ক্রিকেটে আসার সব কৃতিত্ব নিজের মাকে দিয়ে থাকেন অ্যামব্রোস। অ্যামব্রোসের মা হিলি অটো( পরবর্তীতে হিলি অ্যামব্রোস) একেবারে উল্টো আমাদের এশিয়ান মায়েদের থেকে। ছেলেকে ক্রিকেটার বানিয়েই ছেড়েছেন। এই পেসারের গল্পের আগে একটু অন্যদিকে ঘুরে আসি।

ads

মাঝেমধ্যে ফুটবলে একটা ব্যাপার আমরা দেখি না যে ভুল পেনাল্টি দিল রেফারি আর প্লেয়ার মানা করলেন বা পেনাল্টি নিলেন না।এই রকম ভদ্রলোকচিত আচরণ বেশ প্রশংসনীয়। আঠারো সনের শেষের দিকে আর উনিশ সনের শুরুর দিকে ব্রিটিশ ফুটবলে বেশ নামকরা ক্লাব ছিল করিন্থিয়ান্স ফুটবল ক্লাব। এই দলের ফুটবলাররা আরো বেশি জনপ্রিয় ছিল তাঁদের জেন্টেলম্যানলি স্বভাবের জন্য।

ভুলে পাওয়া পেনাল্টি বারের উপরে কিংবা সাইডে মেরে দিতেন। অথবা নিজেদের গোলিকে বলতেন একটা গোল ‘অ্যালাউ’ করতে। এরা বিশ্বাস করতেন সাম্যে সমতায়। এদের এই আচরণকে বলা হয় ‘করিন্থিয়ান্স স্পিরিট’।

এই করিন্থিয়ান্স স্পিরিটের কথা বলেছি আরেক বিখ্যাত দলের কারণে। ১৯৮৮ সালে কার্টলি অ্যামব্রোসের বলে চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান পেসার জিওফ লওসনের। মোটামুটি এরপর থেকেই ক্যারিবীয় ক্রিকেট দলের ক্রিকেটীয় শক্তিকে কমিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু ‘লাল ফিতা’ এর ‘আমলাতান্ত্রিক’ কৌশলে যায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া।

এই নিমিত্তে ক্যারিবীয়দের ‘কালো চামড়ার বুনো বা জংলি বলেও ডাকা হয়েছিল। সাবেক ইংলিশ পেসার মাইক সেলভি ব্যাপারটার পুরো সমালোচনায় না গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটারদের সাইকি বা মনস্তত্ব নিয়ে বলেছিলেন যে এদের ব্যাপারটাই আলাদা। এরা নিজেদের ঘরোয়াতে নিজেদের বাউন্সার দিয়ে আক্রমণ করে আবার পুল-হুক শটে মেতে ওঠে।ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সংস্কৃতিই এমন। আক্রমণাত্মক কিন্তু উপভোগ্য একই সাথে ভদ্রও। যেন একেবারে করিন্থিয়ান্স স্পিরিট।

ফিরে আসি অ্যামব্রোসে। কার্টলি অ্যামব্রোসের বিপক্ষ ব্যাটিং অর্ডারে ধস নামানো স্পেল আছে অনেক। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আরও বেশি ভয়ংকরী ছিলেন তিনি। পার্থে অস্ট্রেলিয়া টসে জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিলেন। উইকেট দেখেই মনে হল ব্যাটসম্যানদের জন্যে স্বর্গ। অথচ অস্ট্রেলিয়া অল আউট মাত্র ১১৯ রানে।

বিকজ, অ্যামব্রোস জাস্ট কজড অ্যা মেহ্যাম। সে ইনিংসে তাঁর বোলিং ফিগার ছিল ১৮-৯-২৫-৭ । এক সময়ে সে ফিগারটা ছিল ১ রানের ব্যবধানে ৭ উইকেট। ক্যারিবিয়ানরা ম্যাচ জেতে ইনিংস ব্যবধানে। এরকম আরও বেশ কয়েকটি স্পেল আছে। সেগুলোর খোঁজ নিজ দায়িত্বে নিবেন ক্রিকেটপ্রেমী হয়ে থাকলে।

ডিন জোন্স একবার অ্যামব্রোসকে তাঁর হাতের সাদা রঙের রিস্টব্যান্ড খুলে বোলিং করতে বললেন। সাদা বলের সাথে সাদা ব্যান্ড তাঁকে বিভ্রান্ত করতে পারে এই যুক্তিতে। ব্যাপারটা অ্যামব্রোসকে বেশ বিরক্ত করল। অ্যামব্রোসকে বিরক্ত করার ফল কখনোই ভাল হয় না।জোন্সকে করা ওই ওভারের বলগুলো যেন একেকটা গোলাবারুদ।

ওই ম্যাচে অ্যামব্রোসের পাঁচ উইকেট প্রাপ্তি ক্যারিবীয়দের ম্যাচ জেতাটা সহজ করে দিয়েছিল। জোন্স পরবর্তীতে মজা করে বলেছিল ওই ম্যাচে ১১ উইন্ডিজ খেলোয়াড়র সাথে জোন্সকে তাঁর ব্যাটিং পার্টনার মার্ক টেইলর পর্যন্ত স্লেজিং করেছিল। এমনকি অ্যামব্রোসকে ক্ষ্যাপানোতে টেইলর জোন্সকে বলেছিল, ‘কেন শুধু শুধু ওকে ক্ষ্যাপালে, আমার দুটো বাচ্চা রয়েছে।’

মার্ক টেইলরের কথাটা সবচেয়ে ভাল বুঝতে পেরেছিল স্টিভ ওয়াহ। জোন্সের মত একই ভুল বড় ওয়াহও করেছিল। যার স্মৃতিচারণ করে নিজের আত্মজীবনীতে স্টিভ লিখেছিল, ‘অ্যামব্রোস হয়তো আমাকে সেদিন মেরেই ফেলত।’ তেড়েও গিয়েছিলেন স্টিভের দিকে, শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন রিচি রিচার্ডসন তাঁকে টেনে নিয়ে আসেন।

স্টিভ ওয়াহ আরো বলেছিলেন অ্যামব্রোসের দুর্দান্ত লাইন-লেন্থ মোকাবেলা করার পরে আপনাকে ব্যস্ত রাখবে ওর বাউন্সার যা আপনার মাথার দিকে তেড়ে আসছে। তাতেও শেষ নয়। এরপর রয়েছে অ্যামব্রোসের ফিজিক্যালিটি। তার লং ইমোশনলেস স্টেয়ারিং। একবার অস্ট্রেলিয়া সফরে তাঁর বলে বারবার পরাস্ত হল ডেভিড বুন। একটা বাউন্সার মিস করল আর অ্যামব্রোস তাঁর বিখ্যাত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বুনের দিকে। পরে অবশ্য হাতে ব্যথা পেয়ে মাঠ ছেড়েছিল বুন। এমন অনেক গল্পের সাথে জড়িয়ে আছে কার্টলি অ্যামব্রোসের নাম।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের অ্যান্টিগার সোয়েটেসে জন্ম নেয়া অ্যামব্রোস কখনোই ক্রিকেটার হতে চাননি। নেই কোনো আইডল ক্রিকেটারও। বরঞ্চ জুলিয়াস আরভিং, চার্লস বার্কলি, ডমিনিখ উইলকিন্স, টিম ডানকানদের ভালোবেসে বাস্কেট বলই খেলতে চেয়েছিলেন। কেভিন ডুরান্ট, মাইকেল জর্ডান, ম্যাজিক জনসনরাও তাঁর প্রিয়। ক্রিকেটে এসেছেন সম্পূর্ণ মায়ের জন্য।

তার মা হিলি অটো এতটাই ক্রিকেট ভালবাসতেন যে অ্যামব্রোসের মধ্য নাম লিনওয়াল রেখেছেন অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট পেসার রে লিন্ডওয়ালের নামেই যদিও বানানে রয়েছে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন। হিলি অটো এমনকি ছেলে অ্যামব্রোস যখনই টেস্ট উইকেট পেতেন সোয়েটাসে তাঁদের বাড়ীতে রাখা ঘন্টা বাজাতেন। মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে জেগে রেডিওতে শুনতেন ছেলের কীর্তি।

অ্যামব্রোস যখন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে পা রাখলেন তখন তাঁর বয়স ছুঁয়েছে ২১। ভিভের দলে খেলেছিলেন প্রথম ম্যাচ।চার উইকেট পেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর থেকেও বড় অর্জনটা ছিল ভিভের প্রশংসা পাওয়া।ভিভ এতটাই পছন্দ করেছিলেন অ্যামব্রোসকে যে বলেই বসলেন, ‘এতদিন তুমি কোথায় লুকিয়ে ছিলে?’।

মাঠে যতই ত্রাসের সৃষ্টি করুক না কেন মাঠের বাইরে তিনি একজন পুরোদস্তর ভদ্রলোক। হাস্য রসে মেতে থাকতেন সব সময়। মাঠে অ্যাগ্রেশনটা না দেখালে পেসার হয়ে কী লাভ! কিন্তু অন্যসব ক্যারিবিয়ানদের মত করিন্থিয়ান্স স্পিরিটের অনুসারী তিনিও। বব মার্লে তাঁর সবচেয়ে পছন্দের মিউজিশিয়ান। মার্লের মত রক-র‍্যাগে মিউজিক ব্যান্ডও ছিল অ্যামব্রোসের। বেজ গিটার বাজাতে খুবই ভালবাসেন।

আমি কখনোই কারো রেকর্ডস নিয়ে লিখিনি। স্ট্যাটাস আমার ভালোই লাগে না। অ্যামব্রোসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। উইকেট সংখ্যা বা ৫/১০ উইকেট কবার পেলেন এইসবে আমি নেই। আমি অ্যামব্রোসের বোলিং গুণাবলি নিয়েও কিছু লিখিনি। আসলে লিখার দরকার পড়েনি। স্টিভ ওয়াহ এক লাইনেই বলে দিয়েছে সেটি। একবার অবশ্য অ্যামব্রোস নিজেই বলেছিলেন তিনি মোটেও সুইং বোলার নয়, জাস্ট সিম। অ্যামব্রোসকে খেলা কিংবা তাঁর বোলিং দেখা লোকেরা কি এই মন্তব্যের সঙ্গে এক মত? অ্যামব্রোস কি শুধুই সিম?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link