More

Social Media

Light
Dark

অনিল গুরাভ: হতে পারতেন শচীনের চেয়েও গ্রেট!

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। কোচ রমাকান্ত আচরেকার তার প্রিয় দুই শিষ্যকে নিয়ে মাঠের এক কোনায় বসে। কিছুটা দুরেই লম্বা ছিপছিপে এক তরুণ নাক সমান উচ্চতার বাউন্সারে হুক করে যাচ্ছে। ব্যাট বলের সংঘর্ষের মধুর শব্দে বিমোহিত পরিবেশ।

নেটের সেই ছিপছিপে তরুণকে দেখিয়ে প্রিয় দুই শিষ্যকে রমাকান্ত বললেন, ‘ওকে দেখেছো? স্কিলের উন্নতি করতে হলে ওকে ফলো করো।’

উপরে উল্লেখিত রমাকান্তের প্রিয় দুই শিষ্যের একজন ছিলেন কাম্বলি, অপরজন শচীন! আর নেটের ছেলেটি? রমাকান্তের সবথেকে প্রিয়, সবথেকে কাছের ছাত্র – অনিল গুরাভ।

ads

এটুকু পড়েই পাঠকের ভুরু কুঁচকে ওঠা স্বাভাবিক, কে এই অনিল গুরাভ, যার স্কিল ফলো করতে খোদ শচীন আর কাম্বলিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন রমাকান্ত!

দ্য ভিভ রিচার্ডস অফ মুম্বাই থেকে বস্তির মাতাল হয়ে ওঠা, বাইশ গজে বোলারদের দুরন্ত বাউন্সারকে শাসন করা থেকে ভাগ্যের নির্মমতায় শাসিত হওয়া সেই অনিল গুরাভ!

ওয়েল, অনিলকে জানতে হলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে আশির দশকে! দ্য এইট্টিজ, মাইটি ডিকেড ফর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট!

কষ্টের সংসারে মায়ের অবলম্বন বলতে দুই ছেলে, অনিল আর অজিত। স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলের খরচ যোগান দিতে হিমশিম মায়ের আশায় ফুল ফোটাতে কোচ রমাকান্তের অধীনে ক্রিকেট প্রশিক্ষন বড় ছেলে অনিলের। পাড়ার ক্রিকেট থেকে শুরু করে স্কুল ক্রিকেটে তখন একটি নামের গুঞ্জন- অনিল গুরাভ!

স্কুল ক্রিকেটে তখন অনিল রীতিমতো সেঞ্চুরির ঝড় তুলে চলেছেন। মুম্বাইয়ের বয়সভিত্তিক দলে অটোচয়েজ হিসেবে একের পর এক রেকর্ড! ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে সহজাত, পাওয়ার ইন স্ট্রোক মেকিং, আলতো হাতের গ্ল্যান্স, ভারতের নেক্সট সুনীল গাভাস্কারকে আবিস্কার করার নেশায় তখন মত্ত পুরো মুম্বাই ক্রিকেট! প্রতিটি ম্যাচে গ্যালারি থেকে শুরু করে রাস্তায় তখন একই স্লোগান – গুরায়ায়াভ… গুরায়ায়াভ!

মিল পাচ্ছেন কিছু? মুম্বাই তথা ভারত ক্রিকেটে শচীইইন…শচীইইন… চ্যান্টের আগে অনিল গুরাভকে নিয়ে স্লোগান হত, যা পরবর্তীতে ভারত তথা বিশ্ব ক্রিকেটে বাজার কথা ছিল, কিন্তু বাজেনি! বেজেছে শুধু ভাগ্যের বিউগলে করুন সুর!

শচীনের ট্রেডমার্ক ব্যাটিং স্টাইল দেখে তৃপ্তি পাননি এমন ক্রিকেট অনুরাগী খুঁজে পাওয়া দুস্কর! কিন্তু, যদি বলি এই স্টাইলের প্রায় পুরোটাই কপি! মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটাই সত্য, গুরাভের প্রায় পুরো স্টাইলই শচীন কপি করেছিলেন তার কোচ আচরেকারের পরামর্শে! প্রতিটা শট, প্রতিটা স্টাইল, প্রতিটা ফলোথ্রু!

সিনিয়র হবার কারণে শচীন গুরাভকে ডাকতেন ‘স্যার’ বলে! গুরাভের ব্যাট ইউজ করতে খুব ইচ্ছে হত শচীনের, কিন্তু লজ্জায় কখনো বলতে পারেননি। কোন এক সতীর্থকে দিয়ে আকারে ইঙ্গিতে সেটা গুরাভকে জানিয়েছিলেন। গুরাভ সেদিন শচীনকে ডেকে নিজ হাতে ব্যাট দিয়ে বলেছিলেন, ‘শর্ত একটাই, খুব বড় ইনিংস খেলতে হবে।’

ম্যাচে শতরান করে শচীন কথা রেখেছিলেন, আর স্যুভেনির হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন সেই ব্যাট! শচীনের ঘরে অসংখ্য ট্রফির সাথে আজও সেই ব্যাট শোভা পায়!

ব্যাট হাতবদলের সাথে সাথে কি সেদিন ভাগ্যকেও বদল হতে দিয়েছিলেন গুরাভ! নেক্সট সেনসেশন হবার পথে কি সেদিনই কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছিল শচীনের ভাগ্য! আহা ভাগ্য! শচীন, গুরাভ দুজনেরই ভাইয়ের নাম ছিল অজিত। এক অজিত যখন তার ছোট ভাই শচীনকে সাফল্যের চুড়ায় পৌছে দিতে মরিয়া, আরেক ছোট ভাই অজিত তখন গুরাভের ভাগ্যকে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলতে মরিয়া! মিল, তবুও কত অমিল!

গুরাভ যখন বাইশ গজে ব্যাট হাতে বোলারদের শাসন করতে ব্যস্ত, ছোট ভাই অজিত তখন বন্দুক হাতে মুম্বাই শাসন করতে মরিয়া! দু’জনেই ত্রাস, কেউ মাঠে, কেউ আন্ডারওয়ার্ল্ডে! ভাগ্যের দড়ি তাই সুতায় রুপ নিতে খুব বেশি দেরি করেনি। মোস্ট ওয়ান্টেড অজিতকে ধরতে মুম্বাই পুলিশ তখন আগ্রাসী! অনিল আর তার মাকে নিয়মিত থানায় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার রুটিন শুরু। মাঠ থেকে উঠিয়ে নিয়েও নির্মম ইন্টারোগেশন চলতো! কার্যত সেখানেই সমাপ্তি এক যুব প্রতিভার সুপারস্টার হয়ে ওঠার গল্পে!

১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রুটিন করে পুলিশি নির্যাতন চলেছে অনিল আর তার মায়ের উপর। মুম্বাইয়ের ভিভ রিচার্ডসের সময় কেটেছে পুলিশি ডান্ডার জবাব দিতে, বাউন্সারের জবাব দেবার অবকাশ তার হয় নি! ততদিনে শচীন-কাম্বলিরা অসংখ্য ক্রিকেট উপাখ্যানের জন্ম দিয়ে দিয়েছেন, শুনিয়েছেন অসংখ্য রুপকথা! গুরাভ তখনও পুলিশকে শুনিয়ে চলেছেন তার নির্দোষ হবার গল্প! আস্তে আস্তে ক্রিকেট সরে গেছে তার জীবন থেকে, কাছে এসেছে হতাশা, অক্ষমতা আর ভয়!

ক্রিকেটের বর্ম গুরাভকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি, কিন্তু হতাশা, ভয় থেকে তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে এলকোহল! নেশায় ডুবে থেকে গুরাভ ভুলতে চেয়েছে তার ফেলে আসা অতীতকে! অতীতের রং সোনালী নাকি ধুসর, সেটা গুরাভ কাউকে বলেননি!

তারা বলে, কেউ নিজের ভাগ্য নিজেই গড়তে পারে, যদি তার ইচ্ছা থাকে! হ্যাঁ, উৎসাহ হিসেবে হয়ত বেশ ভালো একটা লাইন, কিন্তু সবক্ষেত্রেই কি এটা সত্য! সাহস থাকলে গুরাভকে জিজ্ঞেস করুন।

‘Fate is that supreme, unconquerable, and invisible something that eventually pronounces the judgement on how a man has lived.’

উপরের এই ইংলিশ বাক্যটির কারণেই কেউ সাফল্য পেয়ে সুপারস্টার হয়, কেউ পারে না। কিন্তু এর মানে এটা নয় যে, ফেইল করা মানুষটি কম প্রতিভা নিয়ে এসেছিল! এর মানে এটা নয় যে, ব্যর্থ হওয়া মানুষটি তাঁর সবটুকু দিয়ে চেষ্ঠা করেননি। এর মানে এটাই যে, ভাগ্য তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন গল্প লিখেছিল! শচীন আর গুরাভের গল্পটাই ভাগ্যের এক ক্লাসিক উদাহরণ!

৫১ বছরের গুরাভ এখন মুম্বাইয়ের বস্তি নালাসুপারাতে বাস করেন। ছোট করে ছাটা ধুসর হয়ে যাওয়া চুল, নুয়ে পড়া দেহ, ক্লান্ত চোখের এক সচরাচর মানুষ! কিন্তু ভীড়ের ভেতর চোখে না পড়া এই গড়পড়তা চেহারার মালিক হয়তো হতে পারতেন এক ক্রিকেট বাদশাহ! এই নাম বা চেহারাই হতে পারত হাজার-লক্ষ পন্যের বিজ্ঞাপন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!

এই মানুষটির বাস হতে পারত মুম্বাইয়েরই কোন এক আলিশান বাঙলোতে! এই মানুষটির অবসর কাটতে পারতো নিজের ড্রয়িংরুমের জায়ান্ট টিভির পর্দায় নিজের করা অসংখ্য সেঞ্চুরির ভিডিও ফুটেজ দেখে। গুরাভের ঘরে আজ কোন টিভি নেই, ঘরটির আয়তন ২০০ স্কয়ার ফিট!

গুরাভের প্রতিভার অংকুর অপেক্ষা করে গেছে কোন এক অনাগত বসন্তের! বসন্ত এসেছে পাশের গাঁয়ে, গুরাভকে মিস করে গেছে ইচ্ছাকৃত অবহেলায়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link