More

Social Media

Light
Dark

তুমি সেই অপূর্ণতা আমার অনুভবে

১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। ফাইনালে পা দিতে অজিদের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের জন্য তিন বলে প্রয়োজন মাত্র ১ রান, হাতে ১ উইকেট। স্ট্রাইকে তখন ল্যান্স ক্লুজনার। এর আগে ওভারের প্রথম দুই বলে দুই চার মেরে ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন তিনি।

ক্লুজনারের ব্যাটে তখন জয়ের স্বপ্ন দেখছিলো প্রোটিয়া ভক্তরা। এদিকে মূহুর্তেই ম্যাচের মোড় পালটে বার্মিংহামে ১৭ হাজার দর্শকের সামনে তখন টান টান উত্তেজনায় ম্যাচ। আউট হলেই গ্রুপ পর্বের দুই দলের দেখায় অজিদের জয়ের কারণে ফাইনালে চলে যাবে অজিরা। আর প্রোটিয়াদের জয়ের জন্য দরকার স্রেফ ১ রান।

আগের বলেই নন স্ট্রাইকে থাকা অ্যালান ডোনাল্ড ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান রান আউট থেকে। ওভারের চতুর্থ বল করলেন ড্যামিয়েন ফ্লেমিং; স্ট্রেইটে পুশ করে দিয়েই দৌঁড় দিলেন ক্লুজনার। আরেকপ্রান্তে ছুটছেন অ্যালান। কিন্তু ততক্ষণে মার্ক ওয়াহ বল ধরে উইকেটরক্ষক অ্যাডাম গিলক্রিস্টের হাতে ছুঁড়ে দিয়েছেন। অ্যানাল মাঝ ক্রিজ অবধি পৌঁছানোর আগেই স্টাম্প ভেঙ্গে গিলক্রিস্টের সাথে ফাইনালের উল্লাসে মেতে উঠেন অজিরা। জয়ের খুব কাছে গিয়েও শেষ মূহুর্তে স্বপ্নভঙ্গ হয় প্রোটিয়াদের।

ads

সেই স্মৃতি মনে করে ক্লুজনার বলেন, ‘আমার মনে হয় এটা দুইজনের (ক্লুজনার ও অ্যালান) মাঝে কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণে হয়েছে। যত দ্রুত ম্যাচটা শেষ করা যায় সেটাই চাচ্ছিলাম। একটা সময় আমাদের খুব বেশি সম্ভাবনা ছিলো না ম্যাচে। ফিল্ডারের হাতে বল যাওয়ার পর অ্যালানের নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়াটা উচিত ছিলো। দর্শকদের সোরগোলে অ্যালান খেয়ালও করেনি আমি কি করছিলাম।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি বলের সেরা ভিউটা পাচ্ছিলাম। আমার মনে হয় যদি বোলিং প্রান্তেও ডিরেক্ট থ্রোতে স্টাম্প ভাঙতো আমিও সেখানে আউট হতে পারতাম। এটা সত্যি দূর্ভাগ্যজনক। আপনি একজন দক্ষিণ আফ্রিকান হন কিংবা ইন্ডিয়ান সাপোর্টার আপনার জন্য বেশ কষ্টকর এটি। অ্যালানের সাথে ভুল বুঝাবুঝির কারণেই এমন হয়েছে। সে আমার দিকে তাকায়ওনি, মাথে দর্শকদের সোরগোলও ছিলো অনেক।’

নিজের এলাকা থেকে উঠে এসে জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাও খেলাটাকে অনেক বড় প্রাপ্তি হিসেবেই মনে করেন ক্লুজনার। তিনি বলেন, ‘আমার স্টেট থেকে উঠে এসে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য খেলাটা বড় ব্যাপার। বিশ্বকাপ দেখাটা আমাদের জন্য অনেক বড় কিছুই ছিলো। যখনি আমি ওয়ার্ল্ডকাপের কথা চিন্তা করি, সবাই জানি এটা ওয়ানডেতে সবচেয়ে বড় একটা ইভেন্ট। আমরা টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে কথা বলি যে, এটা আপনার স্কিল এবং ক্যারেক্টার তুলে ধরে। কিন্তু বিশ্বকাপে যেয়ে লড়াই করাটা টেস্ট ক্রিকেটের কঠিন মূহুর্তের চেয়েও কম নয়।’

সেই ঐতিহাসিক সেমিফাইনালে ক্লুজনার যখন সপ্তম উইকেটে ব্যাটিংয়ে নামলেন তখন দলের প্রয়োজন ছিলো ৩১ বলে ৩৯ রান। সে সময় নির্দিষ্ট কোনো স্ট্র্যাটেজি কিংবা পরিকল্পনাও সাজাননি তিনি। শুধু চেয়েছিলেন স্ট্রাইক রোটেট করে ম্যাচ বের করতে।

তিনি বলেন, ‘আমার তেমন কোনো স্ট্রাটেজি ছিলো না। আমাদের জয়ের একটা সুযোগ ছিলো। এটা স্ট্রাইক রোটেটিংয়ের ব্যাপার ছিলো, ম্যাচে থিতু হওয়াটা দরকার ছিলো। শেষ ওভারে ম্যাচ যাওয়াটা একটা বড় প্রেশার। আমি যখন ক্রিজে যাই ৩১ বলে তখন ৩৯ রান দরকার ছিলো। প্রেশার সিচুয়েশনে মাঠে যাওয়া, তাও এতো সেমিফাইনালের মতো একটা ম্যাচে। স্ট্রাইক রোটেট করলেই ম্যাচটা জিতা সম্ভব। তাই আমাদের বিশেষ কোনো প্ল্যান ছিলোনা। এরপর ধীরে ধীরে আমার লক্ষ্যের কাছে পৌঁছাই।’

শেষ উইকেটে অ্যালান ডোনাল্ডের উপর ভরসা করতে পারছিলেন না কিনা সে নিয়ে ক্লুজনার বলেন, ‘আমার কি তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখা দরকার ছিলো? হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি তাঁর উপর বিশ্বাস রেখেছিলাম। ব্যাটসম্যান হিসেবেও তাঁর প্রতি ট্রাস্ট করা ছাড়া আমার কাছে আর অপশন ছিলো না। আমি সবসময়ই বলি যে ওই স্টেজে সেদিন আমাদের ব্যাটসম্যানরা কোথায় ছিলো? আমাদের টপ সেভেনরা কোথায় ছিলো?’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি সবসময় অ্যালানের প্রতি দু:খ প্রকাশ করি যে, তাকে ব্যাট হাতে সেখানে নেমে একজন ব্যাটসম্যানের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিলো। ওই সিচুয়েশনে আপনাকে অবশ্যই অ্যালানের প্রতি ভরসা রাখতে হবে। আমি জানতম আমাকেই বাউন্ডারি মারতে হবে। শুধু আমি না ৪০ মিলিয়ন সাউথ আফ্রিকানরাও অ্যালানের প্রতি সেদিন ভরসা রেখেছিলো। তবে, আমি জানতাম শেষ ওভারের ৯ রানের বেশিরভাগই আমাকে করতে হবে।’

শেষ ওভারের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই ছয় বলে যদি তিনটা বাউন্ডারি মারবো, হ্যান্ড শেক করবো আর বেরিয়ে আসবো। শুরুতেই বাউন্ডারি এসেছিলো। সে সময়ে ডেথ ওভারে ফ্লেমিং ছিলো ওয়ার্ল্ডক্লাস বোলার; যে ব্লকহোলে বল করতে পারতো। ভাগ্য ভালো ছিলো প্রথম দুটি বলেই বাউন্ডারি মারতে পারি।’

‘তখন আসলে কথাগুলো এমন বলেছিলাম যে যদি সুযোগ পাই তাহলে ছয়ই মারবো। হ্যান্ড শেক করবো আর আমরা ফাইনালে চলে যাবো। দুই বলে বাউন্ডারি মারার পর ফিল্ডাররা সব কাছাকাছি ছিলো। সিঙ্গেল নেওয়ার সুযোগও ছিলো না। স্ট্রেইটে এবং উইকেটের পেছনেই শুধু কিছুটা গ্যাপ ছিলো। আমরা বাউন্ডারি কিংবা সিঙ্গেল যাই হোক না কেনো কোনো সুযোগ নষ্ট করবো না এমনটাই কথা বলেছিলাম।’, যোগ করেন তিনি।

ওই বলে সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টা না করে পরের বলের জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন এমনটাও অনেকে মন্তব্য করেছিলেন। তবে ল্যান্সনার বলেন তিনি সুযোগ হারাতে চান নি। ম্যাচটা শেষ করাই লক্ষ্য ছিলো। তবে ওই টুর্নামেন্টে জিম্বাবুয়ে এবং অজিদের বিরুদ্ধে প্রথম রাউন্ডের হারটাই বেশি ভুগিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘যদি ওই বলে সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টা না করে পরের বলে আউট হতাম। তাহলে সবাই বলতো আগের বলে সিঙ্গেল নেওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেনো নেইনি। আমরা চেয়েছিলাম সব সুযোগ লুফে নিতে। চেষ্টা ছিলো বাউন্ডারিতেই ম্যাচ শেষ করতে। হয়তো পরের বলে একটা ছক্কা মারতে পারলে সব শেষ হয়ে যেতো। ম্যাচটা টাই হলেও আমরা ভালো খেলেছি। তবে, এর কিছুদিন আগে জিম্বাবুয়ে এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হার টা বেশ কষ্ট দিয়েছে।’

বিশ্বকাপের আগে ইনজুরিতে পড়লেও সেখান থেকে ফিরে এসে বেশ দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন তিনি। আর সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন বিশ্বকাপেও। ৯ ইনিংসে ১৪০.৫ গড়ে ১২২ স্ট্রাইক রেটে ২৯১ রান করেন তিনি! বল হাতেও মাত্র ৩.৮৩ ইকোনমিতে শিকার করেছিলেন ১৮ উইকেট।

ক্লুজনার বলেন, ‘আমি বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগেই ইনজুরিতে পড়েছিলাম। এরপর আমরা নিউজিল্যান্ড সফরে যাই, ঘরের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও খেলি। সেখানেও বেশ সফল হয়েছিলাম। আমি অনেক বেশি অনুশীলনও করেছিলাম। যার কারণে আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলাম বিশ্বকাপে। এমনকি আমি ডেথ ওভারের জন্যও আমি শতভাগ প্রস্তুত ছিলাম।’

২০ বছরের বেশি সময় পার হলেও ওই বিশ্বকাপের স্মৃতি এখনো সবার মনে তাজা। যদি কখনো ওই বিশ্বকাপে কোনো কিছু পরিবর্তনের সুযোগ পেতেন তাহলে কি চাইতেন – এমন প্রশ্নের উত্তরে ক্লুজনার বলেন, ‘আমি আমার জন্য কোনো কিছুই পরিবর্তন করতাম না।  আমি একটা ফ্যাক্ট পরিবর্তন করতাম যাতে করে আমরা যথেষ্ট রান করতে পারি। কারণ সেবার আমাদের বেশ ভালো বোলিং অ্যাটাক ছিলো। যারা দলকে বেশ কিছু ম্যাচে জয় পাইয়েছে। আমি যদি কিছু চাইতাম সেটা হচ্ছে আমাদের ব্যাটসম্যানরা যাতে আরো সফল হতে পারে। আমাদের টপ ছয় ব্যাটসম্যান ব্যর্থ ছিলো যার কারণে আমরা চাপে ছিলাম। কন্ডিশন হয়তো কিছুটা কঠিন ছিলো কিন্তু এই বিভাগে আমরা আরো ভালো করতে পারতাম।’

সেই বিশ্বকাপের অনেক স্মৃতির মাঝে স্মরণীয় কিছু স্মৃতির ব্যাপারে ক্লুজনার বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই রান আউটটা, ৫৮ রানে ৫ উইকেটে থেকেও পাকিস্তানের বিপক্ষে ২২১ রানের টার্গেট টপকে যাওয়া; এটা বেশ স্পেশাল। এছাড়া আরো কয়েকটা ম্যাচের মধ্যে কেনিয়ার বিপক্ষে পাঁচ উইকেট নেওয়াটা আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো একটা মুহূর্তের একটা। ওই ম্যাচে বলে ভালো ভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলাম।’

সেই আক্ষেপ আজো বয়ে বেড়াচ্ছেন ক্লুজনার। তিনি জানতেন, বিশ্বকাপ জয় থেকে সামান্য একটু দূরে আছে দল।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে পড়ে আমি টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার জয়ের পর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ার শিরোপা উঁচিয়ে ধরার উল্লাস দেখছিলাম। আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম, যদি নিজের কোনো অর্জন না থেকে শুধু দলের জন্য বিশ্বকাপটা পেতাম! আমি এটার জন্য সবকিছু করতে চাইতাম। এই জিনিসটা আমি সবসময়ই চিন্তা করি।’

– ফার্স্টপোস্ট অবলম্বনে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link