More

Social Media

Light
Dark

অজি সভ্যতার নির্মল বাতাস

বয়স তখন সবে নয়। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। ব্যাট-বলের সঙ্গে সখ্য বছর তিনেক হলো। কিছু নাম এরমধ্যেই জায়গা করতে শুরু করেছে মনের মনিকোঠায়। আমাদের শচীন, সৌরভ তো ছিলেনই। বড় রাস্তার পাশের গলিতে গাড়ির বাঁক নেওয়ার মতো করে, সরু পথে উঁকি মারতে শুরু করলেন ওয়াসিম আকরাম, শেন ওয়ার্ন, ল্যান্স ক্লুজনাররা।

বছর আঠাশের এক বাঁ হাতি যুবকে নজর আটকে গেল হঠাৎ। ফাইনালে। পাকিস্তানের দেওয়া ছোট্ট লক্ষ্য তাড়া এসে এমন চালাতে শুরু করলেন, অভিজ্ঞ আক্রাম, তরুণ তুর্কি আখতার – ছিটকে যেতে লাগলেন লর্ডসের আনাচে কানাচে। মধ্য মেধার আমি, ভালো করে ইংরেজি উচ্চারণ তখনও আসে না। বাবা বললেন, ‘ছেলেটার নাম অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। অস্ট্রেলিয়ার উইকেটরক্ষক। কিছুদিন হলো ওপেন করছেন একদিনের ম্যাচে। গত বিশ্বকাপে জয়সূর্যকে দিয়ে যে মাস্টারস্ট্রোকটি খেলেছিলেন রণতুঙ্গা। সেই ব্লু-প্রিন্ট ধরে স্টিভ একই কাজে লাগিয়েছেন গিলক্রিস্টকে।’

আবছা মনে আছে বাবা আরও বলেছিলেন, ‘গিলি অনেক বেশি ধারাবাহিক জয়াসুরিয়ার থেকে। টেস্টে কেন যে অস্ট্রেলিয়া ওকে খেলায় না। ছেলেটা জাত ম্যাচ উইনার। কিপিংয়ের হাতও খারাপ না।’

ads

৭০-এর কোটায় দাঁড়ানো মানুষটার ক্রিকেট প্রজ্ঞার কাছে মাথা ঝোঁকাতে হয়। তখন বুঝিনি, বছর দশেক বাদে, অল্পবিস্তর ক্রিকেট বুঝতে শেখার পর উপলব্ধি করেছিলাম, কোনও দিন পাড়া ক্রিকেটেও ব্যাট না ধরা লোকটা কত বড় কথা বলেছিলেন সেদিন। প্রতি খেলাতেই এমন কিছু মানুষ মাঝে মধ্যে দিকশূন্যপুর থেকে উদয় হন, যাঁদের হাত ধরে খেলাটাই আমূল বদলে যায়।

ফুটবলে হারবার্ট চ্যাপমান, রাইনাস মিখেলসরা দেখিয়েছিলেন বিপ্লব কখনও চেনা ছকে আসে না। সাধারণের বাইরে গিয়ে ভাবতে হয়। সেই যে উইম্বেলডনে বুম বুম বরিস পাওয়ার টেনিস নিয়ে এলেন। সে পথে হেঁটেই নাদাল, জোকোভিচরা আজ সর্বকালের সেরার সরণীতে। টাইগার উডসের জন্য তো গলফ কোর্সে ‘বাঁধা বিপত্তি’ বাড়াতে হয়েছিল কয়েকগুণ! ক্রিকেটে যদি এমন কোনও তালিকা তৈরী হয়, তাতে উপরের দিকেই থাকবেন গিলক্রিস্ট।

বিখ্যাত ক্রিকেট ওয়েবসাইট ক্রিকইনফো সর্ব কালের সেরা টেস্ট একাদশ ঘোষণা করে বছর কয়েক আগে। ইয়ান চ্যাপেল, শিল্ড বেরি-র মত বিশেষজ্ঞরা ভোট দিয়েছিলেন। উইকেটরক্ষক হিসাবে সেই দলে গিলক্রিস্ট। তাঁর হাত ধরে বদলেছে উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানের সংজ্ঞা। সর্ব কালের সেরা দলে বেদি তো তৈরী থাকবেই। গিলি টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখার আগে উইকেটকিপিংয়ের মূল কাজ ছিল দস্তানায়।

ব্যাটিং হাত ততটা ভালো না হলেও দলে আসতে বিশেষ বেগ পেতে হত না। অ্যালেন নট, জেফ দুজোঁ-রা ৩২ এর কাছে ব্যাটিং গড় নিয়ে কিপিং দক্ষতায় কিংবদন্তী। আলেক্স স্টুয়ার্ট, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ছিলেন বটে। কিন্তু তাঁদের কিপিং আবার সেই উচ্চতার নয়। দলে ভারসাম্য রাখতে কিছুটা বাধ্য হয়েই বাড়তি দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল।

গিলক্রিস্ট আসার পর বদলে গেল সব। তিনি এই দুই শ্রেণির নিখুঁত মিশ্রণ। উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে মাছি গলবে না। ক্যাচ, স্টাম্পিংয়ের স্ট্রাইক রেটে বাকিদের থেকে একশো মাইল এগিয়ে। আর ব্যাটিং? ৩৬ গড় নিয়ে প্রায় দশ হাজার একদিনের রান। ৯৬ টেস্টে ৪৭-এর উপর গড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার। তবে শুধু রান দিয়ে ব্যাটসম্যান গিলক্রিস্টকে মাপতে যাওয়া, মারুতি নিয়ে রোলস রয়েসের মোকাবিলা করার মতোই হাস্যকর। ব্যাটিংয়ে মেজাজটাই ছিল তাঁর ইউএসপি।

আগে কালো মানুষের সম্রাট ভিভ, পরে রাঁচির ছোট্ট মহল্লা থেকে উঠে আসা ধোনি ছাড়া ধারাবাহিক পাওয়ার হিটিংয়ের এমন উদাহরণ কি দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব? ব্যাটটা ধরতেন একেবারে হাতলের উপরের দিকে। ঠিক যেন সজনে গাছে ডাঁটা ঝুলছে। বাঁ হাতের ‘ভি’ থাকতো ব্যাটের পেছনের মাঝ বরাবর, ঠিক উপরে সামান্য মুড়ে ডানহাত। তারপর একদিনের ক্রিকেটে নতুন বল ছাতু করা। ছেলেবেলা বাবা ডিফেন্স শেখানোর পরে শেষ কটা বল দিতো ব্যাট চালানোর জন্য।

সেই থেকে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের প্রতি ভালোবাসা। অদ্ভুত লংহ্যান্ডেল গ্রিপও তখন থেকেই। এক হাতে বল মারা প্র্যাক্টিস করতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। কব্জি আর কুনইয়ের জোর বাড়াতে। বোলাররা পরে টের পেয়েছিলেন সেই জোর! অফ স্টাম্পের বাইরে পা গেল কি গেল না, কে ভাবতে বসেছে। বল সামনে পড়লে হয় কভার দিয়ে চার নয়তো কাউ কর্নারে। খাটো লেন্থে হলে ক্ষিপ্র কাট বা পুল। সামনের পায়ে ভর রেখে দুম! ব্যাট ঘুরে শেষ হত ডান কাঁধের পেছনে। বল মাঠের বাইরে।

একটা অপবাদ মাঝে ফুলেফেঁপে উঠেছিল, স্পিন মোটেও খেলতে পারেন না। ২০০১ ভারত সফরে প্রথম টেস্টে মুম্বাইতে ম্যাচের রং বদলে দেওয়া সেঞ্চুরি। ক্যান্ডিতে মুরলিকে নির্বিষ করে ১৪৪। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ফাতুল্লা টেস্টে। প্রথম ইনিংসে ৯৩ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা অস্ট্রেলিয়া শেষে জেতে তিন উইকেটে। ১৪৪ করে দলকে খাদের কিনারা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছিলো গিলিরই চওড়া ব্যাট। স্পিন খেলতে না পারলে এগুলো কী! বলের ঘূর্ণি সামলাতে মূলত দুটো অস্ত্র তূণীর থেকে বার করতেন। সুইপ আর স্টেপ আউট করে মিড অফ থেকে মিড উইকেট বাউন্ডারি।

অথচ এ হেন প্রতিভার শুরুটা ছিল অসম্ভব সাদামাটা। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার জন্য ভিটে ছেড়ে রীতিমতো ৪০০০ মাইল পাড়ি দিতে হয় তাঁকে। নিজের রাজ্য দল নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে প্রথম খেলেন ৯২-৯৩ মরসুমে। প্রথম সারির ব্যাটসম্যান হিসাবে। পরের বছরই বাদ। ব্যাটে রান নেই। আর ফিল এমরিকে সরিয়ে তাঁকে কিপিং করানোর কথা ভাবেননি কোচ স্টিভ রিক্সন।

সটান বলেই দিয়েছিলেন, ‘গিলিকে প্রথমে আমার কিপার মনেই হয়নি। মনে হয়েছিল একজন ব্যাটসম্যান যে মাঝেসাঝে কিপিং করে।’ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার কোচ ড্যারেল ফস্টার কাচ কাঁটা হিরে চিনতে ভুল করেননি। টিম জোরার মতো তারকাকে সরিয়ে ডেকে নেন গিলিকে। ৯৬ বিশ্বকাপের পর সুযোগ এল একদিনের দলে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে নিজেকে খুঁজে পেলেন স্টিভ ওপেন করতে পাঠানোয়। ঠিক যেমন রোহিতকে বলেছিলেন ধোনি, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে, যা ভাই নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেল রান আসবেই।

১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭- বিশ্বকাপ জয়ে অস্ট্রেলিয়ার হ্যাট্রিকের পেছনে গিলক্রিস্টের অবদান অনস্বীকার্য। প্রথম দুটো ফাইনালে ঝড়ের গতিতে অর্ধশতরান করে বিপক্ষকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেওয়া। শেষে নক আউট পাঞ্চ। বাড়তি গ্রিপ পাওয়ার জন্য গ্লাভসে স্কোয়াস বল ঢুকিয়ে ১৪৯। ২০০৭ ফাইনালে মুরলি, ভাসরা কোথায় উড়ে গিয়েছিলেন, খোঁজ পাওয়া যায়নি সারাদিন।

টেস্ট দলে কিছুতেই শিকে ছিঁড়ছিল না। ইয়ান হিলি দরজা আটকে দাঁড়িয়ে। অবশেষে ৯৯-এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভাগ্য দেবী মুখ তুলে তাকালেন। টানা ১৫ টেস্ট হিলি ব্যাট হাতে ঝোলানোর পর অসি নির্বাচকদের নজর পড়ে গিলক্রিস্টের উপর। ততদিনে একদিনের ম্যাচে প্রমাণ করে দিয়েছেন, উইকেটকিপিং দক্ষতায় হিলির চেয়ে বেশি পিছেয়ে নেই তিনি। অভিষেকে ৮১ রানের ঝকঝকে ইনিংস। কত বড় ম্যাচ উইনার প্রমাণ হয়ে গেল দ্বিতীয় টেস্টে হোবার্টে।

১২৬-এ রিকি পন্টিং ফিরে যাওয়ার পর এলেন। অপর প্রান্তে থাকা ল্যাঙ্গার তখন চল্লিশের ঘরে। চতুর্থ দিন চা পানের বিরতির ঘন্টা খানেক পর, ল্যাঙ্গার ৫০ করে ব্যাট তুলে দেখেন গিলক্রিস্ট অপরাজিত ৫৩ রানে। কে আকরাম? কে ওয়াকার? কেই বা আখতার? কাট, পুল, ড্রাইভে নামিয়ে এনেছেন ক্লাব বোলারের পর্যায়ে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সাকলাইন মুস্তাকের। সুইপে কখনও স্কোয়ার লেগ তো কখনও স্টেপ আউট করে মিড উইকেটে, বারবার আছড়ে পড়লো কোকাবুরা। পরে ল্যাঙ্গার বলেন, ‘গিলক্রিস্ট আমাদের মতো সাধারণ ক্রিকেটার নয়। ও ফ্রিক। না হলে নিজের দ্বিতীয় টেস্টেই, ওই বোলিং লাইন আপের বিরুদ্ধে অমন ইনিংস খেলা যায় না।’

আর পাঁচ জনের মতো যে নন বুঝিয়েছিলেন ২০০৬-এর পার্থ টেস্টেও। টানা ১৬ টেস্টে রান নেই। নেটে এমন ব্যাট করছেন যে হেডেন, ল্যাঙ্গাররা চিন্তায়, গিলক্রিস্টের হলোটা কী! একটা বল ব্যাটের মাঝে লাগছে না। বারবার আউট হচ্ছেন নেট বোলারদের বলে। পন্টিং আরষ্ট হয়ে আছেন, প্ৰিয় সহ অধিনায়ককে বোধহয় আর বাঁচানো গেল না। পার্থে রান না পেলে শেষ দুটো টেস্টে হয়তো অন্য কাউকে কিপিং করতে দেখা যাবে। পরে পার্থে যা হলো তা ইতিহাস, ৫৭ বলে সেঞ্চুরি। আর একটু হলে ভিভের করা দ্রুততম টেস্ট শতরানের রেকর্ডটাই ভেঙে দিচ্ছিলেন( পরে যা ভাঙেন ম্যাকালাম)।

দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের ফিল্ডারদের দেখা গেল শুধু বাউন্ডারি থেকে বল কুড়িয়ে আনতে। ওয়াকা-র সবুজ গালিচা ছিঁড়ে চতুর্দিকে ছুটলো লাল বলটা। ১২ টা চার, ৪টে ছয়। পাল্টা আক্রমণের ঝাঁঝে ফ্লিনটফ, হার্মিসন, পানেসররা তখন ভাবছেন কবে ইংল্যান্ডের বিমানে উঠবেন। ঠিকআমাদের কাল বৈশাখী। গ্রীষ্মের দাবদাহের পর মায়াবী ছোঁয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর সুন্দর। নির্মম কিন্তু সঙ্গে মিশে কোমলতার বিস্ময়! ৫-০ অ্যাসেজ জয়ের টেমপ্লেট তখনই লেখা হয়ে গেছিল।

বিধির বিধানে অস্ট্রেলিয়ার বিজয় রথও শুরু হয় গিলক্রিস্ট টেস্ট আঙিনায় পা রাখার বছর থেকেই। দু’বছর পর ২০০১-এ, ১৬ টেস্ট জয়ের শেষে, যা থামে ভারতের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ইডেন টেস্টে। গিলির উত্থানই এর একক কারণ, এমন নয়। সেই দলে তারকার অভাব ছিল না। ব্যাটিংয়ে পন্টিং, হেডেন, স্টিভ, বোলিংয়ে জোড়া ফলা ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রা। কিন্তু এরপরও ‘জিগ স’ সম্পূর্ণ হচ্ছিলো না। গিলি এসে যাওয়ায় যা পূর্ণতা পায়। উপরের দিকের ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ হলেও ড্রেসিংরুমে ততটা বিচলিত হতেন না কেউ। জানতেন সাত নম্বরে এমন এক মহীরুহ আছে, যার ছায়ায় নিশ্চিতে বিশ্রাম নিতে পারে ব্যাগি গ্রিন সভ্যতা।

কেমন উইকেটকিপার ছিলেন? ব্যাটিংয়ে গিলক্রিস্ট যেমন পুরুটাই ‘ন্যাচারাল’, কিপিংয়ে ততটা নন। আকাশ ছোঁয়া উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গেছেন অক্লান্ত পরিশ্রমের পথে হেঁটে। ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা হওয়ায়, অনেকে প্রথমেই নাক সিঁটকেছিলেন। এত লম্বা হয়ে কিপিং করা যায় নাকি! গিলক্রিস্ট নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না! অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে বন্ধুদের বলে ফেলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় পুরোপুরি ব্যাটিংয়ে মন দেওয়া উচিৎ।’

হাল ছাড়েনি শুধু রড মার্শ। শোনা মাত্র হাতের কাজ মাথায় তুলে তিনি দৌড়ান গিলির কাছে। তাঁকে বোঝান দলে কিপারদের গুরুত্ব। ডুবে যেতে বলেন প্র্যাক্টিসে। মার্শ জানতেন বিশ্ব ক্রিকেটকে একটি রত্ন দিতে চলেছেন। গুরুর পরামর্শ মেনে গিলক্রিস্ট ডুবে গেলেন অনুশীলনে। ব্যাটিংয়ের সময় কেটে যোগ হলো কিপিংয়ে। অস্ট্রেলিয়া দলে আসার পরও ফাঁকি দেননি একপ্রহর। প্র্যাক্টিসের প্রায় তিন ভাগের দু’ভাগ বরাদ্দ থাকতো উইকেটের পেছনে।

ভালোবাসা এতটাই বেড়ে গেল যে, বাড়িতে টিভি দেখতে বসেও হাতে থাকতো টেনিস বল। বাঁ হাত থেকে ডান, ডান থেকে বাঁ, বল ঘোরাফেরা করতো। কিছুই না ম্যাচের সময় বল যেন ঠিকঠাক গ্রিপ হয় তালুতে, সেই প্র্যাক্টিস! ম্যাচের দিন সকালে পন্টিংকে নিয়ে চলতো কিপিংয়ের পাঠ। ওই টেনিস বলেই। পায়ের নড়াচড়া যেন ঠিক থাকে। গ্লাভসে বল বসে এক চান্সে। লম্বা হওয়া সত্ত্বেও পুরো স্কোয়াট করে হাঁটু মুড়ে বসতেন। পেসারদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য থাকতো ডান পায়ের থাইয়ের কাছে বল ধরা।

এতটাই ভরসা দিতেন উইকেটের পেছনে যে পন্টিং অনায়াসে প্রথম স্লিপকে কিছুটা দূরে দাঁড় করাতেন। বাকি দুটো স্লিপ আর একটা গালি দিয়েই যেন উইকেটের পেছনে বেশিরভাগ জায়গা মুড়ে ফেলা যায়। বাড়তি আরেকজন ফিল্ডার না লাগে। স্পিনের ক্ষেত্রে কিপিংয়ে শুরুতে কিছুটা সমস্যা হত। আস্তে আস্তে ওয়ার্নাকে কিপ করতে করতে শুধরে নেন। নিজস্ব একটা টেকনিক ব্যবহার করতেন স্পিনার বল করতে এলে। যতক্ষণ না বল মাটিতে ড্রপ পড়ছে, বসে থাকতেন স্কোয়াট করে। উঠতেন বলের বাউন্সের সঙ্গে। যেন আন্ডারএজ হলে বল দস্তানা না এড়ায় বা বল নিচু হয়ে এলে স্টাম্পিং মিস না হয়।

না, কী ক্যাচ, কী স্টাম্পিং, কিছুই সেভাবে ফোস্কায়নি তাঁর হাত থেকে। নীল চোখের সুদর্শন ছেলেটা তালুবন্ধী করত হাসতে হাসতে। যেন কলেজের বান্ধবীর সঙ্গে পার্কে সান্ধ্য ভ্রমণে বেড়িয়েছেন। মধুর সম্পর্কে ছেদ পড়লো ২০০৮-এ ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজে। হাত থেকে দুটো সহজ ক্যাচ পড়লো! এমন অভিমান হলো যে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নয়। একবারের জন্য ভবলেন না, শততম টেস্ট থেকে ‘চার কদম’ দূরে দাঁড়িয়ে।

আসলে গিলক্রিস্টের মতো ক্রিকেটাররা কখনও নিজের জন্য খেলেন না। তাঁদের কাছে জাত্যাভিমান, দলের সম্মানই শেষ কথা। নির্মম, রসকষহীন ক্রিকেট খেলা অস্ট্রেলিয়া দলে গিলক্রিস্ট ছিলেন বসন্তের বিকেলের নির্মল বাতাস। স্লেজিং করেছেন কিন্তু কখনও প্রতিপক্ষকে অসম্মান করেননি। আউট হয়েছেন বুঝলে নিজেই হেঁটে বেরিয়ে গিয়েছেন কত বার! সতীর্থদের কাছে এ জন্য ভর্ৎসনা শুনেছেন। কিন্তু আদৰ্শ থেকে সরেননি। আম্পায়ার আউট না দেওয়া সত্ত্বেও হেঁটে মাঠ ছেড়েছেন বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো হাই ভোল্টেজ ম্যাচে। আসলে গিলক্রিস্টের মতো ক্রিকেটারদের কাছে আদর্শই শেষ কথা। ব্যাট বলের নশ্বর লড়াইও তুচ্ছ তাঁর সামনে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link